নৃত্যনাট্য-শাপমোচনের ছন্দে স্পন্দিত সন্ধ্যা by আশীষ-উর-রহমান

মানুষের বাহ্যিক রূপের পরিচয় যে নিতান্তই গৌণ, সে বিষয়টিই তুলে ধরেছিলেন কবিগুরু তাঁর শাপমোচন নৃত্যনাট্যে। কাহিনি আবর্তিত হয়েছে দুটি প্রণয়পিয়াসী হূদয়ের চিরন্তন আবেগানুভূতির মধ্য দিয়ে। সেই আখ্যানের মিলনের আকুতি, বিরহের বেদনা, প্রকৃতির লাবণ্যমাধুরী আর সংগীতের সুরমূর্ছনা নৃত্যের ছন্দে স্পন্দিত হয়েছে পল্লবী ড্যান্স সেন্টারের শিল্পীদের অনবদ্য পরিবেশনায়।


গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তনে পরিবেশিত হলো নৃত্যনাট্যটি। ঢাকায় পল্লবীর শাপমোচন নৃত্যনাট্যের এটিই প্রথম পরিবেশনা। এর আগে গত ৫ এপ্রিল এটি পরিবেশিত হয়েছিল দিল্লির আমানি মিলনায়তনে, কবিগুরুর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ আয়োজনে বছরব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে। সেখানেও দর্শকদের কাছে প্রযোজনাটি প্রশংসিত হয়েছিল। তবে দেশের দর্শকদের কাছে নিজেদের সৃজনকর্ম তুলে ধরার পরিতৃপ্তিই আলাদা। সেই তাগিদ থেকেই ঢাকায় এ পরিবেশনা। পাশাপাশি সামনেই কবিগুরুর ১৫১তম জন্মদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনও ছিল একটি বিশেষ উপলক্ষ—বলছিলেন পল্লবীর পরিচালক মিনু হক। ঢাকার দর্শকও যে অনাবিল আনন্দ লাভ করেছে, তা বোঝা গেল পরিবেশনা শেষে করতালিতে শিল্পীদের অভিনন্দিত করায়। শাপমোচন-এর কাহিনি শুরু দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় এক নৃত্যানুষ্ঠান থেকে। গীতনায়ক সৌরসেন সেদিন বড়ই অন্যমনা প্রেয়সী মধুশ্রীর বিরহে। সূর্য প্রদক্ষিণে মধুশ্রী গিয়েছেন সুমেরুশিখরে। সৌরসেনের মৃদঙ্গবাদনে তাল কেটে গেলে বাধাগ্রস্ত হলো অপ্সরা উর্বশীর নৃত্য।
ক্রুদ্ধ ইন্দ্র অভিশাপ দিলেন সৌরসেনকে। তিনি গান্ধার রাজগৃহে জন্ম নিলেন অরুণেশ্বর নামে কুশ্রী রূপে। আর মধুশ্রী আত্মবিস্মৃত হয়ে জন্ম নিলেন মদ্ররাজকুলে কমলিকা নামে। শ্রীহীন অরুণেশ্বরকে কমলিকা স্বেচ্ছায় ভালোবাসলেই শাপমুক্ত হবেন তাঁরা। এ নিয়েই নাটকের কাহিনি।
মানুষের অন্তরের সৌন্দর্যই তার প্রকৃত পরিচয়, অন্তরের ঐশ্বর্য দিয়েই যে মানুষ সব অসুন্দর-অকল্যাণকে পরাভূত করে কল্যাণের প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেটিই দেখিয়েছেন কবি।
অরুণেশ্বর ও কমলিকার বিয়ে হলো এক অদ্ভুত নিয়মে অরুণেশ্বরকে না দেখেই তাঁর পাঠানো এক বীণাকে বরমাল্য দিলেন মধুশ্রী। কিন্তু বাসরশয্যা অন্ধকার। দেখা হলো না দুজনার। একপর্যায়ে চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কমলিকার বারংবার অনুরোধে প্রাসাদশিখর থেকে কমলিকা দেখলেন নাগকেশর বনে সখাদের সঙ্গে অরুণেশ্বরের নৃত্য। নাচে মুগ্ধ হলেও কুৎসিত ব্যক্তিটিকে মানতে পারলেন না স্বামী হিসেবে। ত্যাগ করলেন তাঁকে। দীর্ঘ বিরহকালে অরুণেশ্বরের বীণাবাদন ও নৃত্য তাঁর মনে এনে দিল নতুন ভাবাবেগ। উপলব্ধি করলেন অরুণেশ্বরের অন্তরের সৌন্দর্য। ফিরে এলেন পতিগৃহে। পরম ভালোবাসায় তাকালেন তাঁর মুখপানে। এবং শাপমুক্ত হলেন তাঁরা।
নৃত্যনাট্যে কমলিকার ভূমিকায় ছিলেন কস্তুরী ব্যানার্জি, অরুণেশ্বর—অনিক বসু, সৌরসেন—এ বি এম শহিদুল ইসলাম, মধুশ্রী—সালমা বেগম, ইন্দ্র—নূরে আলম, ইন্দ্রাণী—মৈত্রী সরকার, রাজা—তোফায়েল আহমেদ, উর্বশী—স্মিতা দে। অন্যান্য চরিত্রে সুব্রত কুমার দাশ, অনন্যা, মুনমুন বিশ্বাস, রুম্পা বিশ্বাস, ঐন্দ্রিলা চক্রবর্তী, আতাউল ফাতেমা, নাজনিন আলম ও অন্তু মজুমদার।
ধ্রুপদি নৃত্য আঙ্গিকের সঙ্গে সৃজনশীল মুক্ত নৃত্যশৈলীর সমন্বয়ে এর পরিকল্পনা করা হয়। এ নাটকের গানগুলোও শ্রোতাদের অনেকবারই শোনা। এসব গানের সঙ্গে নৃত্যের সাবলীল গতিছন্দ ভিন্নতর ব্যঞ্জনা দিয়েছিল। শিল্পীরা কাহিনির নাটকীয়তা, প্রেম-বিরহের চিরন্তন মানবিক আবেদনের অভিব্যক্তি অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলে পরিবেশনাকে হূদয়গ্রাহী করে তুলেছিলেন। শাপমোচন-এর নৃত্য পরিচালনা ও পোশাক পরিকল্পনা করেছেন পল্লবীর পরিচালক মিনু হক। মঞ্চসজ্জায় ছিলেন আইরিন পারভিন।

No comments

Powered by Blogger.