কাজের খোঁজে মালের রাস্তায় বাংলাদেশিদের অপেক্ষা by শরিফুল হাসান

মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে তখন কেবল ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এর মধ্যেই শহরের প্রাণকেন্দ্র মাজিদা সড়কে জড়ো হতে থাকেন কিছু মানুষ। ক্রমেই তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর পর অপেক্ষা। একসময় কেউ কেউ বিক্রি হয়ে যান এক দিনের জন্য। আর যাঁরা বিক্রি হতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে হতাশা বাড়ে।


মালের মাজিদা সড়কের মাজিদাবাগ মসজিদটির সামনের এই চিত্র এখন প্রতিদিনের। অপেক্ষারত এই মানুষগুলোর সবাই বাংলাদেশি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা বিদেশে এসেছিলেন ভাগ্য বদলাবেন ভেবে। বিভিন্ন কোম্পানির নামে এলেও তাঁরা কিন্তু কাজ পাননি। আর তাই প্রতিদিন দিনভিত্তিক কাজের আশায় এখানে জড়ো হন তাঁরা। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই স্থানের নাম দিয়েছেন আমিলার বাজার। (আমিলা অর্থ যাঁদের কোনো কাজ নেই, কাগজপত্র নেই)।
মুন্সিগঞ্জের নজরুল ইসলাম, চাঁদপুরের শাহাবুদ্দিন, টাঙ্গাইলের আবদুস সামাদ, কুমিল্লার আলাল হোসেনসহ অপেক্ষারত কয়েক শ মানুষের সঙ্গে বুধবার কথা হয়। বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তাঁরা তাঁদের দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে থাকেন।
প্রবাসীরা জানালেন, প্রতিদিন সকালে কয়েক হাজার বাংলাদেশি এই আমিলার বাজারে কাজের আশায় আসেন। সকাল ছয়টা থেকে নয়টার মধ্যে নিয়োগকর্তারাও আসেন এখানে। সারা দিন কাজ করিয়ে ১০০ থেকে ১৫০ রুপিয়া (১ রুপিয়া মানে বাংলাদেশি পাঁচ টাকা) পর্যন্ত দেবেন এমন আশ্বাসে তাঁদের কাজে নিয়ে যান নিয়োগকর্তারা। বেশির ভাগ লোক নেওয়া হয় বিভিন্ন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু অনেক সময় কাজ করিয়ে কেউ কেউ টাকা দেন না। টাকা চাইলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়।
আমিলার বাজারে কাজের অপেক্ষায় থাকা নরসিংদীর শহীদ মিয়া বলেন, দেড় লাখ টাকা খরচ করে এক বছর আগে মালদ্বীপে এসেছিলেন। এসে জানতে পারেন, এখানে তাঁর জন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই। দেশে ফিরে যাবেন, সে অবস্থাও নেই। তাই অবৈধ হয়ে এখানে আছেন।
কুমিল্লার মনির হোসেন জানান, দুই লাখ টাকা খরচ করে দুই বছর আগে এসেছিলেন। বাংলাদেশে দালালেরা বলেছিল, অনেক ভালো চাকরি। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারেন, সব ভুয়া। তিনি জানান, এখন তাঁদের কাজ খুঁজে নিতে হয়। এমনকি মালে পুলিশও কাজ করতে তাঁদের নিয়ে যায়। কিন্তু অনেক সময় বেতনই দেয় না। তাঁদের অনেকেই রাত কাটান রাস্তায়।
কুমিল্লার ওমর ফারুক জানালেন, ১১ মাস একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন, বেতন পাননি। চাকরি ছেড়ে এখন প্রতিদিন কাজের খোঁজে এখানে আসেন। চাঁদপুরের শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘মাসে ২০ থেকে ২৫ দিনই কাজে যাই। কিন্তু ১০ দিনই টাকা মাইর যায়। মালিকেরা টাকা দেয় না।’
দুরবস্থার কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘ভাই দেশে যে জীবন ছিল, সেই জীবন এর চেয়ে অনেক ভালো। এখন না পারি সইতে, না পারি দেশে চলে যেতে।’
প্রবাসী এই বাংলাদেশিদের প্রায় সবারই অভিযোগ, মালেরা ইদানীং তাঁদের কাজ করিয়ে টাকা দিচ্ছেন না। কেন এ ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, মালদ্বীপে এখন যত লোক দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশি চলে এসেছেন। বাংলাদেশের অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক এখন অবৈধ। খুব সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায়। হাইকমিশন কখনই এ দুরবস্থা দেখতে আসে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালদ্বীপের বাংলাদেশ হাইকমিশনের দূতালয় প্রধান (হেড অব চ্যান্সেরি) অহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের একটি চক্র বিভিন্ন কোম্পানির নামে এখানে লোক নিয়ে আসছে। তাঁদের বেশির ভাগই কাজ পাচ্ছেন না। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লোক পাঠাতে পারলে এ সমস্যা হতো না।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের এই দুরবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে মালদ্বীপের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য জিহান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইদানীং আমরা অনেক অভিযোগ পাচ্ছি যে বাংলাদেশিদের কাজ করিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে না। সমস্যাটি খুবই গুরুতর। আমরা নিজেরাও তদন্ত করে এ ধরনের অনেক অভিযোগ পেয়েছি। আমরা সরকারকে বারবার এ বিষয়ে বলছি। কিন্তু আমাদের আইনেই সমস্যা রয়ে গেছে। ফলে অনেক কোম্পানির সামান্য জরিমানা হয় কিংবা লাইসেন্স বাতিল হয়। তবে কিছুদিন পরই তারা আরেকটি নামে লাইসেন্স নেয়।’

No comments

Powered by Blogger.