শ্রদ্ধাঞ্জলি-আতিকের মা ইংরেজি জানতেন না by সুমনা শারমীন

যেন জসীমউদ্দীনের সেই কবিতার মতোই, ‘পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক’। ঠিক এমনই বয়সে বিয়ে হয়েছিল নুরুননাহার বেগমের। মা-বাবার আদরের ডাক ‘হেনা’। ঢাকার কাছেই আড়াইহাজার থানার প্রভাকর্দি গ্রামের মেয়েটি এসে সংসার পাতল ময়মনসিংহের রসুলপুর গ্রামে।

পরে অবশ্য ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর কর্মসূত্রে ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে সংসার পেতেছেন। যৌথ পরিবারের বউ। বয়স মাত্র ১৩। ঝোলমাখা ভাত খেতে পারে না। তার অভ্যাস ভুনা তরকারিতে। মেজো জা তাই ভাতের ঢিবিতে আগেই লুকিয়ে রাখতেন বাড়তি মাছের টুকরো—সবার মাঝে বসে খেতেও কিশোরী হেনার যেন কষ্ট না হয়, লজ্জা না পায়। স্বামী কর্মক্ষেত্রে। ফ্রকপরা হেনা শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে ভাগনেদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলত। স্বামী আসার সময় হলেই খেলার সাথিদের সহযোগিতায় শাড়িটা পেঁচিয়ে নিত গায়ে। যে বয়সে পঞ্চম শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার কথা, সেই বয়স থেকেই মা হলেন হেনা—একবার নয়, গুনে গুনে ১৫ বার। তিনটি সন্তান জীবনের মুখ দেখতে পায়নি, তাই ১২টি ছেলেমেয়ে নিয়েই হেনার জীবনসংগ্রাম। হয়তো রেখাকে ননাসের কাছে রেখে বুলবুলকে খাওয়াতেন, আতিককে আঁচলের সঙ্গে বেঁধে মীরাকে ঘুম পাড়াতেন...ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে ছিলেন সংসার পেতে। বড় মেয়ের বয়স যখন ১৯, তখন স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নুরুননাহার বেগমকে ঢাকা ছেড়ে আবার ফিরে যেতে হলো গ্রামে। শুরু হলো দুই নারীর সংগ্রাম। ঢাকায় বড় মেয়ের চাকরি আর ময়মনসিংহে হেনার জমি থেকে তোলা ফসল। বারান্দায় দুই ইটের ফাঁকে পড়া ধানের কণাটুকুও অপচয় হতে দেননি তিনি। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখল, একে একে চাকরিতে যোগ দিতে শুরু করল, সংসার শুরু হলো কারও কারও। মেজো ছেলে আতিক যোগ দিল সেনাবাহিনীতে। বড় ভগ্নিপতিকে চিঠি লিখল আতিক, ‘খুব শিগগিরই আপনাদের পাশে আমি এসে দাঁড়াচ্ছি, আব্বার চিকিৎসা, ছোট ভাইবোনদের নিয়ে ভাববেন না।’ অসম্ভব পরিশ্রমী, টনটনে আত্মসম্মান জ্ঞানের নুরুননাহার বেগমের মনে সাহস জাগে আরও, ‘এত দিন যখন মচকাইনি, আর বোধ হয় ভাঙব না।’ আধুনিক মনের শৌখিন মানুষটি এত কিছুর মধ্যেও সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস ছাড়েননি। হাতে পেলেই পড়তেন এ-মাথা থেকে ও-মাথা। নাতির সংগ্রহ থেকে মাসুদ রানা সিরিজ পড়তে বসলে ভুলে যেতেন নাওয়া-খাওয়া-ঘুম। নাতিও কম যায় না। আপু (নাতি-নাতনিদের ডাক) গোসলে গেলেই একই চেহারার অন্য একটি মাসুদ রানার একই পৃষ্ঠা বের করে রাখত। ফিরে এসে নুরুননাহার বেগমের মাথা গরম। বেশ কিছুক্ষণ পড়ার পর ধাঁধায় পড়তেন, ‘কী পড়ছিলাম, আর এ কী দেখছি!’ অতঃপর নাতির সঙ্গে হইচই, বই কাড়াকাড়ি, হাসিতে লুটিয়ে পড়া। কে বলবে এই মানুষটির জীবনে এত সংগ্রাম?
গ্রামের বাড়ির পুরোনো নকশার ঝকঝকে ড্রেসিং টেবিলের ওপর নিজের গাছের লিলি ফুল সাজাতে সাজাতে গুনগুন করা ‘প্রলয়নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে...’ মানুষটিকে দেখলে কে বুঝবে, তাঁর ভেতরেই চলছে যুদ্ধ জয়ের প্রলয়!
১৯৭১ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হলেন টগবগে তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান। স্বাধীনতার পর অনেক খোঁজাখুঁজি, শেষমেশ এই কঠিন সত্য জানা। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টেই পাওয়া গেল বিশাল এক গুহা—ভেতরে শুধু লাশ আর লাশ। বাঙালি সেনাসদস্যদের লাশ। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁরা ঘুমিয়ে রইলেন সমাধিক্ষেত্রে, যার ফটকে লেখা, ‘যাদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ’। ঢুকেই বাঁ দিকে—আতিক ঘুমিয়ে সেখানে। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে বাবাও চলে গেলেন ১৯৭২-এর মার্চে। বিয়ের কয়েক মাস পরেই বড় ছেলের মাথায় ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। ঢাকা-জার্মানি মিলিয়ে ১২টি অস্ত্রোপচার। মাসের পর মাস নুরুননাহার বেগম থাকেন ছেলের পাশে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নুরুননাহার বেগমকে প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখেছেন কমজনই। তিনি যে অধিক শোকে পাথর!
দিন যায়, বছর যায়, ছেলেমেয়েরা যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে ছোট মেয়েটিও কর্মস্থলে লড়াই করতে শিখেছে। সেজো ছেলে থাকে কানাডায়। ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নুরুননাহার বেগম গেলেন সেখানে। আতিকের মা ইংরেজি জানতেন না। কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো ইংরেজি শিখতে ভর্তি হলেন এক কোর্সে। ক্লাসে আছেন তাঁরই বয়সী এক ভদ্রলোক। দেশ তাঁর পাকিস্তান। শিক্ষক প্রশ্ন করলেন নুরুননাহারকে, তাঁর দেশ কোনটি। ইংরেজি না জানা নুরুননাহার সংকোচ কাটিয়ে মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন, ‘বাংলাদেশ’। পাকিস্তানের সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘ইস্ট পাকিস্তান’। মুহূর্ত দেরি না করে নুরুননাহার তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে প্রতিবাদ করে জোরে বলে উঠলেন, ‘নো, সেপারেট, নাইনটিন সেভেনটিওয়ান।’ তিনি কাঁপছেন। ক্লাসের সবাই তাঁর আবেগ আর উত্তেজনা দেখে বিস্মিত। বিস্মিত শিক্ষকও। নুরুননাহারের ছেলেকে এই ঘটনার বর্ণনা করে শিক্ষক পরে বলেছিলেন, ‘স্বতঃস্ফূর্ত সত্যিকার অনুভূতি প্রকাশে ভাষা কোনো বাধা নয়।’
গত বছরের জুলাই মাসের ১৬ তারিখে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। মৃত্যুর আগে হাসপাতালে চিনতে পারছিলেন না অনেককেই। সন্তানেরা তাঁকে ঘিরে ছিলেন সব সময়। ঘুম হতো না, সারাক্ষণ হাসপাতালের বিছানায় বসে নিজের একটা কাপড় ভাঁজ করতেন আর খুলতেন, খুলতেন আর ভাঁজ করতেন। হ্যাঁ, সেই যে ১৩ বছর বয়স থেকে কাজ করা শুরু তাঁর, অবচেতনে তা-ই যেন করে যাচ্ছেন। ছেলেমেয়েরা যখন চাইত, আম্মা এবার বিশ্রাম নেবেন, তখনো ৮৩-৮৪ বছর বয়সে নিজে গোসল করে নিজের কাপড় ধুয়ে বের হতেন। নিজের বিছানা নিজে ঝাড়তেন দিনে কয়েকবার। নাতনির বাড়িতে গিয়ে নিজ হাতে খাসির গ্লাসি রান্না করে বলতেন, ‘তোর নানাভাইয়ের সঙ্গে “ওকে” রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম, স্বাদটা কেমন?’ আপু নেই, শুধু মনে পড়ে, হাসপাতালে যখন তাঁর স্মৃতির চেয়ে বিস্মৃতি বেশি, তখনো তিনি আউড়েছিলেন কবিতাটি, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’
যেন ঠিক দেশের জন্য জীবন দেওয়া একজন শহীদের মায়ের মতোই কথা।
সুমনা শারমীন

No comments

Powered by Blogger.