রোহিঙ্গা সমস্যা-এদিকে ‘রাজনীতি’ ওদিকে নিপীড়ন by জোসেফ আলচিন

বাংলাদেশ সরকার অনেক আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের বাসভূমি পশ্চিম মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল। মিয়ানমারের ফৌজি জান্তা বছরের পর বছর ধরে যতভাবে পারে, সমস্যাটাকে আরও পাকিয়ে তুলেছে। রোহিঙ্গারা হলো বৌদ্ধপ্রধান একটি দেশের মুসলিম সংখ্যালঘু।

যুগের পর যুগ ধরে তারা তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তার পরও সে দেশের গত নির্বাচনের সময় সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের ভোট পেতে তাদের বহু কাঙ্ক্ষিত নাগরিক অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সেসবের কিছুই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বরং বাংলাদেশ সীমান্তের ৩০০ কিলোমিটার জুড়ে তড়িঘড়ি করে কাঁটাতারের বেড়া বানাতে ব্যস্ত। এটা হবে এমন এক অঞ্চলকে বিভক্তকারী বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের বেড়া, যে অঞ্চলের মাত্র কয়েকটি বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপারের ঘটনাবলি দেখে বাংলাদেশ মনে হয় হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। বাংলাদেশিদের চোখে মিয়ানমার হলো এক অস্পষ্ট ও অন্ধকার দেশ। তা হলেও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনীকে নিয়ে তারা সন্ত্রস্ত। সীমান্তজুড়ে নাসাকা বাহিনীর কাঁটাতার আর নজরদারি চৌকিগুলো ঘুমন্ত বাংলাদেশি গ্রামগুলোকে চোখে চোখে রাখে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের নতুন ও পুরোনো শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। এর শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত একটি সংযোগ-সড়ক নির্মাণের প্রস্তাবের মাধ্যমে। এর জন্য তিনি এ বছরের এপ্রিলে কক্সবাজারে এই সড়কের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, মিয়ানমারের গোঁয়ার শাসকেরা এই স্বপ্নের অংশীদার হবে না। একই ঘটনা ঘটেছিল মিয়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির চেষ্টার বেলায়ও। সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই এই লক্ষ্যে মিয়ানমারের শাসকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করে।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বাংলাদেশে মিয়ানমারের নতুন রাষ্ট্রদূত একটি অস্পষ্ট উক্তি করেন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে নিজের পরিচয়পত্র পেশ করতে গিয়ে রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে বলেন, উভয় দেশেরই উচিত বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে ‘আলোচনায়’ বসা। তখন থেকেই ঢাকার সরকার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের একটি অর্থসাহায্য আটকে রাখে। স্থানীয় বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সাহায্য হিসেবে জাতিসংঘ ৩৩ মিলিয়ন ডলারের একটি সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। বলা হয়, এই সাহায্যের ছুতো ধরে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা আরও তুঙ্গে ওঠার আশঙ্কায়ই ঢাকা প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিচ্ছে।
প্রকল্পটি চারটি জাতিসংঘ সংস্থার সমবায়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা, শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন যার অন্যতম। বাংলাদেশে এখন অবধি শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে ২৮ হাজার রোহিঙ্গা। কিন্তু আরও হাজার হাজার শরণার্থীর ঢল বইছে মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে। বলা হয়, গত শরতেই এসেছে ছয় হাজার। বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপস্থিতি শুধু একটা রাজনৈতিক সমস্যাই নয়; ফরাসি মেডিকেল সান ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ) নামক সেবা সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের কথায়, এটা এক মানবিক বিপর্যয়। কুতুপালং এলাকায় ক্ষুধার্তের হার ১৮ শতাংশ। এখানে আশ্রয় নেওয়া ৫৫ শতাংশ রোহিঙ্গা শিশু ডায়রিয়ায় ভুগছে। এ রকম এক অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের মধ্যে যা বয়ে আনছে জীবনের প্রতি হুমকি।
প্রকল্প আটকে দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘের এই প্রকল্প ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমানোর বদলে কেবল রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনাই বাড়াবে। কোনো সন্দেহ নেই যে এই প্রকল্প স্থানীয়দের খেপিয়ে তুলবে। শরণার্থীদের প্রতি অতি কদরে স্থানীয়দের বিরোধিতার ঝুঁকির মুখে তাই কিছুই হলো না। মাঝখান থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নতুন কাঁটাতারের বেড়া উঠতে থাকল। কুনমিংমুখী রেলপথ নির্মাণে ঢাকার স্বপ্নও সেই কাঁটাতারে বিদ্ধ হয়ে থাকল।
জাতিগত বিদ্বেষ এবং জাতীয়তাবাদী অসন্তোষ গত জুন মাসের গোড়ায় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিরোধী দল বিএনপির প্রতি অভিযোগ তোলেন যে তাঁদের আমলে রোহিঙ্গাদের অনেককেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। একজন বিশ্লেষক তো বলেই ফেললেন যে বিএনপি ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে এ রকম পাসপোর্ট দিয়েছে ভোট পাওয়ার আশায়। ঠিক একই অভিযোগ উঠেছিল মিয়ানমারের সামরিক জান্তা-সমর্থিত এইএসডিপি সরকারের প্রতিও যে তারা ভোটের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের টোপ দেখাচ্ছে।
এ রকম রেষারেষি আরও তুঙ্গে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কূটনৈতিক কর্মকর্তা এরিক শোয়ার্টজয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়। শোয়ার্টজ সে সময় বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সবাইকে নিবন্ধিত করতে বলেন। জবাবে খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখন যদি উপস্থিত সবাইকে নিবন্ধিত করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যারা আসবে, তাদেরও তা করতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশের পক্ষে এত বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গার ভার বহন করা সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখার স্বার্থেই রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে চাইছে।
ফাতেমা নামের এক রোহিঙ্গা শরণার্থী মনে করেন, তিনি এখানে শান্তিতে আছেন। ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। আরও অনেক রোহিঙ্গার মতো ওই সমুদ্রে ভেসে থাইল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চান না তিনি। শিবিরের বাইরে এত বিপদ ও নির্যাতন শরণার্থীদের, তার পরও মিয়ানমারের চেয়ে এখানে বেশি সুখী বোধ করেন তাঁরা। ১৯৯২ সালের এক সকালে ফাতেমা আরাকানে তাঁর বাড়িতে বসে কোলের শিশুকে খাওয়াচ্ছিলেন। সে সময় নাসাকা বাহিনী তাঁর বাড়িতে আসে। তারা তাঁর শিশু বাচ্চাটির পরিচয়পত্র চায়। নিজের বা শিশুর পরিচয়পত্র ছিল না ফাতেমার। ফাতেমা জানান, নাগরিকত্বের কাগজপত্র না পেয়ে ফাতেমার সামনেই তাঁর শিশুসন্তানকে পুড়িয়ে মারে সেনারা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর ঘরবাড়ি।
এ ধরনের অবস্থায় অনেক সমস্যা সত্ত্বেও ফাতেমার কাছে বাংলাদেশিরা হলো রক্ষক ও আশ্রয়দাতা। তাদের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতারও শেষ নেই। কুতুপালং জুড়ে এ রকম অজস্র ভয়াবহ গল্প শোনা যাবে। তবু ফাতেমা মনে করেন, এখানে এসে তিনি কিছুটা শান্তির দেখা পেয়েছেন।
নেপালের হিমল ম্যাগাজিন থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ।
জোসেফ আলচিন: দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা।

No comments

Powered by Blogger.