পাকিস্তান-সামরিক-বেসামরিক আইনি অধিকারের সীমা by নাজাম শেঠি

সামরিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বেসামরিক আদালতের আইনগত অধিকারের ব্যাপ্তির প্রশ্নটি পাকিস্তানের জনসাধারণের মনের একটা বড় জায়গা দখল করে আছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে মনে করা হয় এমন শত শত বালুচ জাতীয়তাবাদী নাগরিক বিগত কয়েক বছরে ‘অদৃশ্য হয়ে গেছে’ সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গোয়েন্দা বাতাবরণের কৃষ্ণগহ্বরে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কবল থেকে তাদের বের করে আনার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের প্রয়াস সফল হয়েছে সামান্যই।


কিন্তু সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানোর অভিযোগে আটক ও কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি চার সন্ত্রাসবাদীর নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা সম্প্রতি সংবাদপত্রের ‘সংবাদ’ শিরোনাম হওয়ায় পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ও পেশোয়ার হাইকোর্ট বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হলো।
সমস্যাটির এক অংশ বেসামরিক আদালতের আইনগত অধিকারের সীমার সঙ্গে জড়িত; অন্য অংশটি জড়িত সামরিক বাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী ও জবাবদিহিবিহীন ক্ষমতার সঙ্গে। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখন সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তাই মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করতে এখন প্রয়োজন আইনের যথার্থ সংশোধনীর পক্ষেও কথা বলা।
যেসব আইন-বিধানের সংশোধনীর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো হলো সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী-সম্পর্কিত ১৯৫২ সালের বিভিন্ন আইন ও পাকিস্তানের সংবিধানের ১৯৯ (৩) ও ১৮৪ (৩) অনুচ্ছেদ। সংবিধানের ১৯৯ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর কোনো একটির সদস্য, অথবা এই বাহিনীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি তাঁর চাকরির শর্তাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁর চাকরিকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত যেকোনো বিষয় অথবা এ ধরনের কোনো আইনের অধীন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীগুলোর কোনো একটির সদস্য হিসেবে যার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এ রকম কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য ধারা-১-এর অধীনে কোনো আদেশ (হাইকোর্ট) দেবে না।’
সংবিধানের ১৮৪ (৩) বলছে, ‘সুপ্রিম কোর্টের যদি মনে হয় সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের প্রথম অধ্যায়ে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উদয় ঘটেছে, তাহলে ১৯৯ অনুচ্ছেদের বিধানাবলির প্রতি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা রয়েছে উল্লিখিত অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিষয়ের অনুরূপ ক্ষেত্রে আদেশ প্রদানের।’
এ ধরনের আইন ও সাংবিধানিক বিধানগুলো মিলিতভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যার ফলে সামরিক বাহিনী-সংক্রান্ত আইনগুলোর প্রয়োগ সম্পর্কে হাইকোর্টের আইনগত অধিকারের সীমা খর্বিত হয়েছে। এমনকি শান্তিকালীন ‘অস্থিরতামুক্ত’ বা বিশেষ অঞ্চলগুলোতেও সামরিক বাহিনীর হাতে আটক বেসামরিক নাগরিকদের আদালতে হাজির করার আদেশদানের অধিকার থেকেও হাইকোর্ট বঞ্চিত। ফলে সামরিক আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া বা আপিল আবেদনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যায় না। সামরিক বাহিনীর জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেলরা সব সময়ই উর্দিধারী। আর ১৮৪ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের আইনগত এখতিয়ার সেই সব বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যেগুলো একই সঙ্গে ‘জনগুরুত্বসম্পন্ন’ এবং মৌলিক অধিকারগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত।
সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত আইনগুলো এসেছে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে। ঔপনিবেশিক যুগের পর থেকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে সামরিক বিষয়াদির ওপর বেসামরিক আদালতের আইনগত এখতিয়ার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওই সব আইন সংশোধন করা হয়েছে; কিন্তু পরিহাসের বিষয়, পাকিস্তানে বিভিন্ন সামরিক সরকারের আমলে তার ঠিক উল্টোটাই করা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশে স্থায়ী সামরিক আদালতের অস্তিত্ব নেই। স্পেন ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক আদালতগুলো রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। যুক্তরাজ্যে সামরিক আপিল ট্রাইব্যুনালগুলোর নেতৃত্বে থাকেন আইন পেশায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জাজ-অ্যাডভোকেটরা; যুক্তরাজ্যে সামরিক আপিল ট্রাইব্যুনালের পরেও আপিল করার সুযোগ থাকে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও সামরিক আইনের অধীনে বেসামরিক নাগরিকেরা রাজ্যগুলোর হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তানে শান্তিকালীনও কোনো সামরিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বেসামরিক কোনো ব্যক্তির আপিল হাইকোর্ট গ্রহণ করতে পারেন না।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০৭ সালের নভেম্বরে আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে সেনা আইনকে আরও কঠোর করতে ২(১) (ডি) ধারায় নানা ধরনের বিধান ঢুকিয়ে দিয়েছেন; সেগুলোর কিছু ‘পাকিস্তানের নিরাপত্তা’ আর ‘পাকিস্তানের ভাবাদর্শ’ ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব নতুন অন্তর্ভুক্তির ফলে সামরিক বাহিনী সামরিক শাসন না থাকা অবস্থায়ও যেকোনো অজুহাতে যেকোনো বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার, আটক রাখার এবং সংক্ষিপ্ত বিচারে দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা পায়। সৌভাগ্যবশত ২০০৯ সালের মার্চে বিখ্যাত ‘বিচারকদের মামলায়’ বিচারকেরা ফিরে এলে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বরের পর সেনা আইনের কালাকানুনসহ মোশাররফের করা আইনের সংশোধনীগুলো বেশির ভাগই বাতিল করে দেন।
সুপ্রিম কোর্টে তিনটি বিষয়ে শুনানি চলছে; সামরিক-বেসামরিক আইনগত এখতিয়ারের বিষয়টির জন্য এগুলো তার‌্যাপর্যপূর্ণ। প্রথম বিষয়টি একটি মামলা নিয়ে, যেখানে আইএসআইয়ের মহাপরিচালক ও পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ১৯৯০ সালে একটি সাধারণ নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারণের লক্ষ্যে রাজনীতিকদের টাকা দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বেলুচিস্তানে বেসামরিক নাগরিকদের গুম হয়ে যাওয়া সম্পর্কে, আর তৃতীয়টি সামরিক বাহিনীর হেফাজতে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর ঘটনা-সম্পর্কিত মামলা। মেমোগেট কেলেঙ্কারি সম্পর্কে সামরিক বাহিনীর দেওয়া বিবৃতিকে যদি সুপ্রিম কোর্ট ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র মতো একটি মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘জনগুরুত্বসম্পন্ন’ বিষয় বলে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে, তাহলে একই মাপকাঠিতে সামরিক বাহিনী-সংক্রান্ত আইনগুলোকে বেসামরিক আইনের অধীন করতে কেন সংবিধানের ১৯৯ (৩) ও ১৮৪ (৩) সংশোধন বা বাতিল করতে পারবে না এবং সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেসামরিক কর্তৃত্বের খর্বকারী সংস্থা হিসেবে আইএসআইয়ের রাজনৈতিক শাখাটি বিলুপ্ত করতে পারবে না? সংবিধানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ ধরনের ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীর এযাবর‌্যাকালের সব রূপান্তরমূলক জনপ্রিয় পদক্ষেপের কৃতিত্বকেও অতিক্রম করে যাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
 নাজাম শেঠি: পাকিস্তানের সাংবাদিক, ফ্রাইডে টাইমস পত্রিকার সম্পাদক।

No comments

Powered by Blogger.