বিমানের ডিজিএম এমদাদের যত সম্পদ by নুরুজ্জামান লাবু

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে ঠিক যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়েছিলেন উপ-মহাব্যবস্থাক (ডিজিএম) এমদাদ হোসেন। তার এই চেরাগ ছিল স্বর্ণ চোরাচালানের সিন্ডিকেট। মাসে কয়েক কোটি টাকা আয় করতেন স্বর্ণ চোরাচালান থেকে। আর এ থেকে পান্থপথে বানিয়েছেন বিলাসবহুল ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন- যাতে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয় করেছেন তিনি। ছাদে তৈরি করেছেন বাগান। ছয় তলার ‘ডাবল ফ্ল্যাটে’ নিজে থাকতেন। অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটও বিক্রি করেননি। কারণ ফ্ল্যাট বিক্রি করার প্রয়োজনই হয়নি। প্রতি মাসেই চোরাচালান সিন্ডিকেটের কাছ থেকে আসতো কয়েক কোটি ‘কাঁচা টাকা’। সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে অর্ধেক টাকা নিজে বণ্টন করতেন। বাকি পুরোটাই ভরতেন নিজের পকেটে। চোরাচালানের টাকায় প্রথম কেনেন গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের একটি দোকান। চালু করেন কসমেটিক্সের ব্যবসা। নাম দেন ‘মড’। যমুনা ফিউচার পার্ক চালু হওয়ার পর সেখানেও চালু করেন একই নামের আরেকটি দোকান। দুই দোকানের বিদেশী সব কসমেটিক্সও আসে চোরাচালানের মাল হিসেবে। চোরাচালানকারী সিন্ডিকেট ছাড়াও ডিজিএম এমদাদের প্রতিষ্ঠানে কসমেটিক্স সরবরাহ করতেন পাইলট ও কেবিন ক্রুরাও। আর নিরাপদে চোরাচালান বিমানবন্দর পার করে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন ডিজিএম এমদাদ। এমনকি কখনও কখনও নিজের মার্সিডিজ বেঞ্জেও বহন করেছেন বিভিন্ন চোরাচালানের মালামাল।
গত মঙ্গলবার রাতে প্রথমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সার্ভিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এমদাদ হোসেনকে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তার সঙ্গে আরও দুই বিমানকর্মী, এক ঠিকাদার ও এক মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীকেও গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর পাঁচ জনকেই তিন দিনের রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে একে একে ডিজিএম এমদাদ চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। চোরাচালান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এমদাদের বিপুল অর্থসম্পদ অর্জনের তথ্যও বেরিয়ে আসে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আবদুল আহাদ বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গতকাল ডিজিএম এমদাদের পান্থপথের ৪৪/এফ/৬ নম্বর ঠিকানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা খরচ করে সুদৃশ্য ও বিলাসবহুল ছয় তলা অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করেছেন। ভবনের ছয় তলার পুরোটা নিয়ে থাকেন এমদাদ নিজেই। বাকি ফ্লোরগুলো বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। নিচতলায় গ্যারেজ আর ছয় তলার ছাদে বিশেষ উপায়ে তৈরি করেছেন দৃষ্টিনন্দন বাগান। ২০০৩-০৪ সালে এই ভবন তৈরি করেন তিনি। সবই করা হয় চোরাচালানের টাকায়। বাসার কেয়ারটেকার সুজন জানান, স্যার (এমদাদ) গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি অন্য বাসায় গিয়ে থাকছেন। সূত্র জানায়, শেয়ারবাজারে ডিজিএম এমদাদের কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। তার নামে- বেনামে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটও রয়েছে। ব্যক্তিগত দু’টি গাড়ি ব্যবহার করতেন তিনি। একটি এক্স করোলা,  অন্যটি মার্সিডিজ বেঞ্জ। ২০১০ সালে তিনি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটি কেনেন কোটি টাকার বিনিময়ে। ডিজিএম এমদাদ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমানে ফ্লাইট স্টুয়ার্ড হিসেবে যোগ দেন। এরপর পর্যায়ক্রমে সে পদোন্নতি পান। ২০১০ সালে তিনি ডিজিএম হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। সূত্র জানায়, ৯০ দশকের শুরুর দিকে বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালান শুরু হয়। ডিজিএম এমদাদ ৯০ দশকের শেষের দিকে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন।
এমদাদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী ডিবি’র একটি সূত্র জানায়, ডিজিএম এমদাদ অনেক চতুর। তিনি তার অঢেল সম্পদের কিছু অংশের কথা স্বীকার করেছেন। চোরচালানের টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। কিন্তু বাকি সম্পদের তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছেন। কারণ, আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদকও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে। ডিবি’র একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকার বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ কেজি স্বর্ণ চোরাচালান হতো। এর অল্প কিছু অংশ মাঝে-মধ্যে কাস্টমস বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়তো। বাকি পুরোটাই নির্বিঘ্নে পাচার করে দিতেন এমদাদ ও তার সিন্ডিকেটের লোকজন। সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে চোরাচালানের ‘কাঁচা টাকা’র লেনদেন এত বেশি হয় যে, এখানকার সুইপার-ক্লিনাররাও কয়েক বছরে কোটিপতি বনে যায়। বিমানবন্দর, আশকোনা, দক্ষিণখান, উত্তরখান এলাকার বেশির ভাগ বাড়িওয়ালাই কোন না কোনভাবে বিমানবন্দরের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। চোরাচালানের কাঁচা টাকা দিয়েই তারা রাজধানীতে বাড়ির মালিক হতে পেরেছে। গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) মিনহাজুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত আরও ক’জনকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলানো হচ্ছে।
ডিজিএম এমদাদের সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক: এদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন মধ্যম সারির কর্মকর্তা হয়ে কয়েক শ’ কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। সূত্র জানায়, পত্র-পত্রিকায় ডিজিএম এমদাদ, চিফ অব প্ল্যানিং অ্যান্ড শিডিউলিংয়ের ক্যাপ্টেন শহীদ ও ম্যানেজার (শিডিউলিং) তোজাম্মেলের আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি উঠে আসায় বিষয়টি দুদকের গোচরীভূত হয়েছে। তারা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিমানের এই তিন কর্মকর্তার সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করবে। খুব শিগগিরই তাদের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৪৬ ফ্লাইটের স্টুয়ার্ড মাজহারুল ইসলাম রাসেল দুই কেজি স্বর্ণসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে। গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বিমান বাংলাদেশের কারা কারা স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তা ফাঁস করে দেয়। রাসেলের দেয়া জবানবন্দি অনুযায়ী ডিজিএম এমদাদসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.