টিকফা এবং ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০ by ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া
টিকফা
চুক্তি হয়ে গেল ভালোভাবেই, কোনো বাদ-প্রতিবাদ ছাড়া। যা কিছু প্রতিবাদ
করার, করেছে কয়েকটি বাম সংগঠন। আর তথাকথিত বামেদের মুখে রা নেই। তারা
ক্ষমতার সুরা পানে নিমগ্ন। টিফা’র অন্য রূপ টিকফা- যেমন নতুন বোতলে পুরনো
মদ। মাঝখানে একটু ‘কো-অপারেশন’ যোগ করা হয়েছে আইওয়াশের জন্য। ফলে টিকফা
হয়েছে- ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট।
বাংলাদেশ কীভাবে কো-অপারেট করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হয়ে! এই
চুক্তির কথা প্রথম শোনা যায় ২০০১ সালে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট
ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ (টিফা) নামে। প্রথম খসড়ায় ১৩টি ধারা ও ৯টি
প্রস্তাবনা ছিল। ২০০৪ ও ২০০৫ সালে এই খসড়ায় আরও পরিবর্তন আনা হয়। তৎকালীন
সরকার নানা বাদ-প্রতিবাদের মুখে চুক্তি সম্পাদনের পথে এগোয়নি। এ ধরনের
চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব,
শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ ত্রিশটিরও বেশি দেশের সঙ্গে। লক্ষণীয়,
এ দেশগুলোর প্রায় সবই উন্নয়নশীল ও দুর্বল গণতান্ত্রিক কিংবা
স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যেখানে গণমানুষের চাওয়া-পাওয়া গুরুত্বহীন।
চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের উদারতার অর্থ হচ্ছে অবাধে মার্কিন বাণিজ্যিক আধিপত্য কোনো রকম সুরক্ষা ছাড়া মেনে নেয়া। এর আগে বাংলাদেশ এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যেসব ছাড় বা সুবিধা পাচ্ছিল, তা থেকে বঞ্চিত হওয়া। এছাড়া বাংলাদেশ এলডিসি দেশগুলোর নেতা হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও অন্যান্য ফোরামে যেভাবে ভূমিকা পালন করছিল, তা এই চুক্তির মাধ্যমে অনেকটাই টেনে ধরল বিশ্ব-মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। তারা বাংলাদেশের ভয়েসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশের বাজারকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিতে হবে, সেই সঙ্গে মার্কিন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে। মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির ওপর করারোপ করতে পারবে না সরকার, সেই সঙ্গে কোনো মার্কিন কোম্পানি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনিতে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিককৃত হয়ে গেছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ফলে সরকার অনেক ক্ষেত্রেই প্রাপ্য কর দেশীয় কোনো কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করতে পারে না কিংবা অন্যভাবে ম্যানেজড হয়ে যায়। সেখানে বিদেশী কর্পোরেট জায়ান্টদের করমুক্ত করার চুক্তি কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের সক্ষমদের ওপর আরও করারোপ করা উচিত। সেখানে কর অবকাশ দেশের কোন উন্নতিতে সাহায্য করবে, তা বোধগম্য নয়। দেশীয় কোম্পানিগুলো এ চুক্তির ফলে কোনো সুরক্ষা পাবে না। ফলে এক অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে এবং দেশীয় শিল্প বিকাশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে কর্মসংস্থানের ওপর তৈরি হবে চাপ, বাড়বে বেকারত্ব।
এমনিতেই বাংলাদেশ দোহা ঘোষণা অনুযায়ী কৃষি খাতে ৫ শতাংশের বেশি ভর্তুকি দিতে পারে না, তার ওপর টিকফা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে হাজির হয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে সবরকম ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। এগ্রোবেজড প্রোডাক্টে কয়েক বছর ধরে বেশকিছু দেশীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল এবং কিছু কোম্পানি ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে এ সেক্টরে ভালো করছিল। ফলে কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এগ্রোনির্ভর মশলা তৈরির শিল্পও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়েছিল। টিকফা চুক্তির ফলে উদীয়মান এই এগ্রো শিল্প হুমকির সম্মুখীন হবে এবং কৃষি পণ্যের দামও বাড়বে। তবে মজার ব্যাপার হল, টিকফার মাধ্যমে আমাদের কৃষি খাতে ভর্র্তুকি প্রত্যাহারে বাধ্য করার সুযোগ পেলেও খোদ যুক্তরাষ্ট্রই কৃষি খাতে ১৯ শতাংশেরও বেশি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি খাত ও এগ্রোবেজড শিল্পকে সুরক্ষা করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের ওপর উল্টো ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে। তাহলে আমরা কেন এই অসম চুক্তিতে সই করলাম, তাও আবার এই অসময়ে, যখন নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্তই নেয়ার কথা নয়?
এ চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে পেটেন্ট আইনের আওতায় আমাদের দেশীয় ওষুধ, কম্পিউটার সফটওয়্যার, কৃষিপণ্যসহ আরও অনেক কিছুকে নকল প্রোডাক্ট হিসেবে বিক্রয়-নিষিদ্ধ করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারবে। দোহা ডিক্লারেশন ২০০০ অনুযায়ী এলডিসি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব আইন থেকে প্রাপ্ত ছাড় অনুযায়ী বিভিন্ন পেটেন্ট ওষুধ উৎপাদন ও রফতানি করছে বিভিন্ন দেশে। কিন্তু টিকফাতে কোনো রক্ষাকবচ না থাকায় তা বাধাগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ গার্মেন্টের পর ওষুধ রফতানি থেকে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশের ওষুধনীতি ভারতের চেয়েও ভালো, কিন্তু এ চুক্তির ফলে হয় অনেক ওষুধ বাংলাদেশী কোম্পানি তৈরি করতে পারবে না, অথবা বিপুল রয়্যালটি প্রদানের ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে বেশি দামে বিদেশী ওষুধ কিনে খেতে হবে দেশবাসীকে। এতে জনস্বাস্থ্য হবে হুমকির সম্মুখীন। এছাড়া মেধাস্বত্ব আইনের ফলে কেবল উদীয়মান তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই লাইসেন্স বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশসহ পৃথিবীর নানা দেশের ফ্লোরা-ফনার বিভিন্ন প্রজাতি নিজ নামে পেটেন্ট করে রেখেছে। একটি উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হবে- আমাদের অতি পরিচিত ও ঐতিহ্যবাহী ঔষধি গাছ ‘নিমে’র পেটেন্ট আছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে নিম গাছ থেকে উৎপাদিত সব পণ্যের ওপর টিকফা অনুযায়ী রয়্যালটি দাবি করতে পারবে তারা। এছাড়াও হয়তো এমন আরও অনেক কিছুর পেটেন্ট থাকতে পারে মার্কিনিদের, যা আমাদের মতো দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের চিন্তার বাইরেই রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইন তার কোম্পানিগুলোকে দায়মুক্তি দিয়েছে। যদি কোনো কোম্পানি টাকার জোরে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অন্য দেশের উৎপাদন পদ্ধতি, জীববৈচিত্র্য কিংবা শস্যবীজ পেটেন্ট করিয়ে নেয়, তবে তার নৈতিক ভিত্তি খুঁজে দেখবে না যুক্তরাষ্ট্রের আইন। ফলে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত গরিব দেশ, যেখানে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী, সেখানে যে কোনো কৃষিবীজ যেমন ধরা যাক কোনো ধান কিংবা ডাল বীজ যদি পেটেন্ট করিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি, তাহলে কৃষক তার বীজ উৎপাদন কিংবা সংরক্ষণের যে পদ্ধতি ঐতিহ্যগতভাবে ও বংশপরম্পরায় ব্যবহার করছে তার অধিকার হারাবে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কিংবা তার নির্ধারিত আমদানিকারক কিংবা ডিলারই হবে বৈধ অধিকারী। প্রয়োজনে জেনেটিক কোড পরিবর্তন করে বীজ উৎপাদন একচেটিয়াভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে পেটেন্টকারী প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে কেবল বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ মনে হলেও ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যে কোনো প্রকার অসন্তোষ ও কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরির মাধ্যমে অবাধ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিবর্তনের ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে পারে কর্পোরেট হাউসগুলো। গার্মেন্ট সেক্টর থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টর এই পেটেন্ট-কপিরাইট-ট্রেডমার্কের চোরাবালিতে আটকে যাবে। এভাবে বিদেশী কর্পোরেট রাজনীতির ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারে দুর্বল গণতন্ত্র ও ব্যাপক দুর্নীতির বাংলাদেশ।
এদিকে টিকফা চুক্তির পর বাংলাদেশ আরেক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। প্রথম আলোর সংবাদ অনুযায়ী ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্থান নির্ধারণে আরব আমিরাতের পরিবর্তে রাশিয়াকে সমর্থন করার কথা ভাবছে বাংলাদেশ। যেখানে আরব আমিরাতের জেতার সম্ভাবনা প্রবল এবং দেশটিতে আমাদের প্রচুর শ্রমিক কাজ করে এবং নিয়মিত রেমিটেন্সের জোগান দিচ্ছে, সেখানে এহেন সিদ্ধান্ত কোনো যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইতিমধ্যে নেপাল আমিরাতকে আগাম সমর্থন দানের মাধ্যমে তিন বছরে তিন লাখ জনশক্তি রফতানির বিষয় চূড়ান্ত করেছে। সেখানে বাংলাদেশ অদ্ভুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী রাশিয়া বাংলাদেশকে কোন খাতে সাহায্য করবে, আর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বাংলাদেশ সফর করলেইবা কী লাভ হবে? সরকার টিকফার মতো চুক্তিটি এ সময়ে না করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারত। সংসদে স্বাভাবিক অধিবেশনের সময় আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। যখন দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও অসন্তোষ বিরাজ করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র মোক্ষম সময়টি বেছে নিয়েছে। কিন্তু চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিত হয়নি সরকারের। আর যে আশায় এটি করা হল, সেটি কাজে নাও লাগতে পারে। একটি-দুটি চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হয়ে যাবে সেটা ভাবা ঠিক নয়। কারণ আমেরিকা চলে তার পলিসির ওপর আর আমাদের দেশ চলে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। ফলে ব্যক্তির পরিবর্তনে আমাদের নীতি পরিবর্তিত হয় আর আমেরিকার নীতি ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, যার প্রমাণ এত বছর পরও টিকফা চুক্তি সম্পাদন।
ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উদারনীতি গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের উদারতার অর্থ হচ্ছে অবাধে মার্কিন বাণিজ্যিক আধিপত্য কোনো রকম সুরক্ষা ছাড়া মেনে নেয়া। এর আগে বাংলাদেশ এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যেসব ছাড় বা সুবিধা পাচ্ছিল, তা থেকে বঞ্চিত হওয়া। এছাড়া বাংলাদেশ এলডিসি দেশগুলোর নেতা হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও অন্যান্য ফোরামে যেভাবে ভূমিকা পালন করছিল, তা এই চুক্তির মাধ্যমে অনেকটাই টেনে ধরল বিশ্ব-মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। তারা বাংলাদেশের ভয়েসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে। বাংলাদেশের বাজারকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিতে হবে, সেই সঙ্গে মার্কিন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে। মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির ওপর করারোপ করতে পারবে না সরকার, সেই সঙ্গে কোনো মার্কিন কোম্পানি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনিতে বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিককৃত হয়ে গেছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ফলে সরকার অনেক ক্ষেত্রেই প্রাপ্য কর দেশীয় কোনো কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করতে পারে না কিংবা অন্যভাবে ম্যানেজড হয়ে যায়। সেখানে বিদেশী কর্পোরেট জায়ান্টদের করমুক্ত করার চুক্তি কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের সক্ষমদের ওপর আরও করারোপ করা উচিত। সেখানে কর অবকাশ দেশের কোন উন্নতিতে সাহায্য করবে, তা বোধগম্য নয়। দেশীয় কোম্পানিগুলো এ চুক্তির ফলে কোনো সুরক্ষা পাবে না। ফলে এক অসম প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে এবং দেশীয় শিল্প বিকাশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে কর্মসংস্থানের ওপর তৈরি হবে চাপ, বাড়বে বেকারত্ব।
এমনিতেই বাংলাদেশ দোহা ঘোষণা অনুযায়ী কৃষি খাতে ৫ শতাংশের বেশি ভর্তুকি দিতে পারে না, তার ওপর টিকফা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে হাজির হয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে সবরকম ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। এগ্রোবেজড প্রোডাক্টে কয়েক বছর ধরে বেশকিছু দেশীয় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল এবং কিছু কোম্পানি ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে এ সেক্টরে ভালো করছিল। ফলে কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এগ্রোনির্ভর মশলা তৈরির শিল্পও এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট এগিয়েছিল। টিকফা চুক্তির ফলে উদীয়মান এই এগ্রো শিল্প হুমকির সম্মুখীন হবে এবং কৃষি পণ্যের দামও বাড়বে। তবে মজার ব্যাপার হল, টিকফার মাধ্যমে আমাদের কৃষি খাতে ভর্র্তুকি প্রত্যাহারে বাধ্য করার সুযোগ পেলেও খোদ যুক্তরাষ্ট্রই কৃষি খাতে ১৯ শতাংশেরও বেশি ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষি খাত ও এগ্রোবেজড শিল্পকে সুরক্ষা করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের ওপর উল্টো ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে। তাহলে আমরা কেন এই অসম চুক্তিতে সই করলাম, তাও আবার এই অসময়ে, যখন নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্তই নেয়ার কথা নয়?
এ চুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে পেটেন্ট আইনের আওতায় আমাদের দেশীয় ওষুধ, কম্পিউটার সফটওয়্যার, কৃষিপণ্যসহ আরও অনেক কিছুকে নকল প্রোডাক্ট হিসেবে বিক্রয়-নিষিদ্ধ করতে সরকারকে বাধ্য করতে পারবে। দোহা ডিক্লারেশন ২০০০ অনুযায়ী এলডিসি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব আইন থেকে প্রাপ্ত ছাড় অনুযায়ী বিভিন্ন পেটেন্ট ওষুধ উৎপাদন ও রফতানি করছে বিভিন্ন দেশে। কিন্তু টিকফাতে কোনো রক্ষাকবচ না থাকায় তা বাধাগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ গার্মেন্টের পর ওষুধ রফতানি থেকে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশের ওষুধনীতি ভারতের চেয়েও ভালো, কিন্তু এ চুক্তির ফলে হয় অনেক ওষুধ বাংলাদেশী কোম্পানি তৈরি করতে পারবে না, অথবা বিপুল রয়্যালটি প্রদানের ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে বেশি দামে বিদেশী ওষুধ কিনে খেতে হবে দেশবাসীকে। এতে জনস্বাস্থ্য হবে হুমকির সম্মুখীন। এছাড়া মেধাস্বত্ব আইনের ফলে কেবল উদীয়মান তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই লাইসেন্স বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশসহ পৃথিবীর নানা দেশের ফ্লোরা-ফনার বিভিন্ন প্রজাতি নিজ নামে পেটেন্ট করে রেখেছে। একটি উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হবে- আমাদের অতি পরিচিত ও ঐতিহ্যবাহী ঔষধি গাছ ‘নিমে’র পেটেন্ট আছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে নিম গাছ থেকে উৎপাদিত সব পণ্যের ওপর টিকফা অনুযায়ী রয়্যালটি দাবি করতে পারবে তারা। এছাড়াও হয়তো এমন আরও অনেক কিছুর পেটেন্ট থাকতে পারে মার্কিনিদের, যা আমাদের মতো দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের চিন্তার বাইরেই রয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইন তার কোম্পানিগুলোকে দায়মুক্তি দিয়েছে। যদি কোনো কোম্পানি টাকার জোরে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অন্য দেশের উৎপাদন পদ্ধতি, জীববৈচিত্র্য কিংবা শস্যবীজ পেটেন্ট করিয়ে নেয়, তবে তার নৈতিক ভিত্তি খুঁজে দেখবে না যুক্তরাষ্ট্রের আইন। ফলে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত গরিব দেশ, যেখানে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী, সেখানে যে কোনো কৃষিবীজ যেমন ধরা যাক কোনো ধান কিংবা ডাল বীজ যদি পেটেন্ট করিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি, তাহলে কৃষক তার বীজ উৎপাদন কিংবা সংরক্ষণের যে পদ্ধতি ঐতিহ্যগতভাবে ও বংশপরম্পরায় ব্যবহার করছে তার অধিকার হারাবে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কিংবা তার নির্ধারিত আমদানিকারক কিংবা ডিলারই হবে বৈধ অধিকারী। প্রয়োজনে জেনেটিক কোড পরিবর্তন করে বীজ উৎপাদন একচেটিয়াভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে পেটেন্টকারী প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে কেবল বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ মনে হলেও ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যে কোনো প্রকার অসন্তোষ ও কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরির মাধ্যমে অবাধ্য সরকারকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিবর্তনের ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে পারে কর্পোরেট হাউসগুলো। গার্মেন্ট সেক্টর থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টর এই পেটেন্ট-কপিরাইট-ট্রেডমার্কের চোরাবালিতে আটকে যাবে। এভাবে বিদেশী কর্পোরেট রাজনীতির ক্রীড়নকে পরিণত হতে পারে দুর্বল গণতন্ত্র ও ব্যাপক দুর্নীতির বাংলাদেশ।
এদিকে টিকফা চুক্তির পর বাংলাদেশ আরেক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। প্রথম আলোর সংবাদ অনুযায়ী ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্থান নির্ধারণে আরব আমিরাতের পরিবর্তে রাশিয়াকে সমর্থন করার কথা ভাবছে বাংলাদেশ। যেখানে আরব আমিরাতের জেতার সম্ভাবনা প্রবল এবং দেশটিতে আমাদের প্রচুর শ্রমিক কাজ করে এবং নিয়মিত রেমিটেন্সের জোগান দিচ্ছে, সেখানে এহেন সিদ্ধান্ত কোনো যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইতিমধ্যে নেপাল আমিরাতকে আগাম সমর্থন দানের মাধ্যমে তিন বছরে তিন লাখ জনশক্তি রফতানির বিষয় চূড়ান্ত করেছে। সেখানে বাংলাদেশ অদ্ভুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী রাশিয়া বাংলাদেশকে কোন খাতে সাহায্য করবে, আর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বাংলাদেশ সফর করলেইবা কী লাভ হবে? সরকার টিকফার মতো চুক্তিটি এ সময়ে না করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারত। সংসদে স্বাভাবিক অধিবেশনের সময় আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। যখন দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও অসন্তোষ বিরাজ করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র মোক্ষম সময়টি বেছে নিয়েছে। কিন্তু চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিত হয়নি সরকারের। আর যে আশায় এটি করা হল, সেটি কাজে নাও লাগতে পারে। একটি-দুটি চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন হয়ে যাবে সেটা ভাবা ঠিক নয়। কারণ আমেরিকা চলে তার পলিসির ওপর আর আমাদের দেশ চলে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। ফলে ব্যক্তির পরিবর্তনে আমাদের নীতি পরিবর্তিত হয় আর আমেরিকার নীতি ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, যার প্রমাণ এত বছর পরও টিকফা চুক্তি সম্পাদন।
ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments