প্রতিবন্ধীদের ভোটাধিকার

আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর বিশ্বের মোট ৭০০ কোটি জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষের অধিকার আদায়ে বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশ দিবসটি পালন করে। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঁধ ভাঙো দুয়ার খোলো, একীভূত সমাজ গড়ো’। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো, সমাজে বসবাসরত ধনী-গরিব, বর্ণবৈষম্য, ধর্ম, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী, অপ্রতিবন্ধী ও জাতিসত্তাভেদে সব মানুষের অংশগ্রহণে একটি সুন্দর সমাজ তথা সম-অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা; যেখানে সুনিশ্চিত হবে প্রত্যেক মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তথা গণতান্ত্রিক অধিকার। এই গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সুশাসনব্যবস্থা। এই প্রক্রিয়া সমুন্নত হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে। এই সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম শর্ত হলো সব ভোটারের বাধাহীনভাবে ভোটে অংশগ্রহণ। এই নিশ্চয়তা বিধান করবে রাষ্ট্র। ভোটার হওয়ার এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করা সব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র এই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে না পারলে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়।
কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়সহ সব স্তরের নির্বাচনে প্রতিবন্ধী নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের পথ এখনো প্রত্যাশামতো নয়। এর মূল কারণ, ভোট প্রদানের পদ্ধতি, সুবিধাদি এবং উপকরণাদি; অনেকাংশে বাধাহীন, বোধগম্য ও অনায়াসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহারোপযোগী নয়। ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১১ অনুযায়ী, পৃথিবীর ১৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী। সে হিসাবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০ লাখ ভোটার। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমান ভোটারসংখ্যা নয় কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬১ জন; যা মোট ভোটারের প্রতিবন্ধী ভোটার প্রায় ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভাবনার এবং একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং বিষয়ও বটে। কমিশনে থাকাকালীন (২০০৭-২০১২) বিভিন্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন, বিশেষ করে এডিডি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রতিবন্ধী নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিতকল্পে কিছু সুপারিশ পেশ করেছিল; যার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন প্রতিবন্ধী ভোটারের দ্রুত ভোট গ্রহণ, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নিজস্ব সহকারী, নিচুতলায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন, প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সচেতনতা সৃষ্টিসহ বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলোর আর কোনো ধরনের ফলোআপ বা নির্বাচনী আইন ও বিধিতে সংযোজন না করার কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অন্তরায়গুলো এখনো অনেকাংশে বিদ্যমান। বর্তমান ভোটার নিবন্ধন ফরমের ১২ নম্বরে ভোটার কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার কি না, তার ব্যবস্থা সংযোজন করা আছে; তথাপি বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী ভোটারের প্রকৃত সংখ্যা অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্রে ও ভোটার তালিকায় প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণের কোনো ধরনের চিহ্ন ব্যবহার করা হয়নি; যে কারণে ভোটকেন্দ্রে প্রতিবন্ধী ভোটার যে ধরনের সুবিধা পাওয়ার কথা, তা নিশ্চিত করা হয়নি। চিহ্ন না থাকার কারণে কোনো ভোটকেন্দ্রের অধীনে কতজন প্রতিবন্ধী ভোটার আছেন, তা জানা সম্ভব হয় না এবং সে কারণে ভোটকেন্দ্র প্রতিবন্ধীবান্ধব করাও অনেকাংশে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্টেট অব নিউইয়র্ক নির্বাচনী আইন, ২০১১ অনুযায়ী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে টেকটাইল ব্যালট পেপার ব্যবহার করে থাকেন। অতি কম খরচে সহজেই প্রয়োগ করা যেতে পারে এ পদ্ধতি। সদ্য সংসদে পাস করা ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ (সংশোধিত) অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায় অটিজম, শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, বুদ্ধি, বাক, শ্রবণ, শ্রবণ-দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, বহুমাত্রিক এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতাসহ মোট আট ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩২ শতাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাই ‘টেকটাইল’ হতে পারে তাদের ভোট প্রয়োগে সবচেয়ে সহজ উপায়।
যদিও আজারবাইজান, কসোভো, কানাডা, ঘানা, যুক্তরাজ্য এবং অধিকাংশ আফ্রিকান ও এশিয়ান দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ভোট প্রদানে ব্রেইল পদ্ধতিটি প্রচলিত। আমাদের পাশের দেশ ভারতসহ আমেরিকা, জাপান, নেদারল্যান্ডস, স্লোভেনিয়া, আলবেনিয়ায় ভোট প্রদানে প্রতিবন্ধীবান্ধব ইভিএম মেশিন প্রচলিত আছে। ২০১৪ সাল থেকে নেপাল, ভুটান, নামিবিয়া ও কেনিয়ায়ও প্রতিবন্ধীবান্ধব ইভিএম মেশিন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’-এ শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সহযোগী ব্যবহারের বিধান রয়েছে কিন্তু অন্য ধরনের প্রতিবন্ধীদের ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার উল্লেখ নেই। এই বৃহৎ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী ভোটারের অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের গণতন্ত্র কখনো সুসংহত হতে পারে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটাধিকার বিষয়ে মূলত চারটি উপায়ে ওপরের পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে: যেমন কিছু বিষয়ে নির্বাচন কমিশন পরিপত্র জারি করতে পারে, কোনোটাতে ভোটার নিবন্ধনবিধিতে পরিবর্তন আনতে পারে, কোনো বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ে সংশোধনীর প্রস্তাব আনতে পারে, এবং কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে পারে। এই অল্প সময়ের মধ্যেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে; যা চরম প্রতিবন্ধী ভোটারও ভোট প্রয়োগে উৎসাহিত হবেন। তবে ভোটাধিকার প্রয়োগের পাশাপাশি তাঁদের নির্বাচনী কার্যক্রমে পূর্ণ অংশগ্রহণে আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, যেমন নির্বাচনে যাতে তাঁরা প্রার্থী, সমর্থক, প্রচারক ও নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তার জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে প্রায় ৯০ লাখ প্রতিবন্ধী ভোটারের কোনো রূপ বাধাবিঘ্ন ছাড়া গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রয়োগ এবং নির্বাচনে পূর্ণমাত্রায় অংশগ্রহণ ব্যক্তিদের শুধু গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না; সঙ্গে সুসংহত হবে আমাদের গণতন্ত্রও।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক ও মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া: প্রশিক্ষক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.