সহিংস রাজনীতি অর্থনীতিকে গ্রাস করছে by ড. আর এম দেবনাথ
সহিংস
রাজনীতি ধীরে ধীরে অর্থনীতিকে গ্রাস করে ফেলছে। রাস্তা অবরোধ, হরতাল,
রেললাইন উপড়ে ফেলা, ককটেল ফাটিয়ে নিরীহ মানুষের দেহ ঝলসে ফেলা, বাসে-ট্রাকে
আগুন, টায়ারে আগুন দিয়ে খেলা করা, আইন-শৃংখলা বাহিনীর লোকদের পিটিয়ে হত্যা
করা ইত্যাদি ধরনের সহিংসতার খবর আমরা প্রতিদিন কাগজে পাচ্ছি। পাচ্ছি অনেক
দিন থেকেই। প্রথম প্রথম কেউ এর পরিণতি সম্যক বুঝতে পারেনি। মনে হয়েছিল,
সময়ে সময়ে বাজারে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বাড়বে- এই যা। এটা হবে সরবরাহে
বিঘ্ন ঘটতে থাকায়। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, আসলে বিষয়টি এতেই সীমাবদ্ধ নয়।
ধীরে ধীরে তা সমগ্র অর্থনীতিকে গ্রাস করে ফেলছে। জিডিপি (গ্রস ডমেস্টিক
প্রোডাক্ট) প্রবৃদ্ধি, আমদানি-রফতানি, রেমিটেন্স, রাজস্ব আয়-ব্যয়, কৃষি
উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন, পর্যটন ব্যবসা থেকে শুরু করে অর্থনীতির সব খাত ধীরে
ধীরে আক্রান্ত। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার একটা খবর দেখলাম আমদানির ওপর। খবরটিতে বলা হয়েছে, জুলাই মাসে
চট্টগ্রাম বন্দরে ৮৯টি জাহাজ এসেছিল। আগস্ট মাসে আসে ৮৭টি। সেপ্টেম্বরে তা
কমে দাঁড়ায় ৭৬টিতে। অক্টোবরে আরও হ্রাস পায়। সে মাসে আসে মাত্র ৬৯টি।
নভেম্বরের ২৬ তারিখ পর্যন্ত এসেছে মাত্র ৬১টি। বিপরীতে গেল অর্থবছরের এই
সময়ে প্রতি মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভিড়েছিল গড়ে ১০০টি করে। এটা একটা
বড় খবর। আরেকটা ছোট খবর দিই। সেটি গাঁদা ফুলের। গাঁদা ফুলের খবরে বলা
হচ্ছে- যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গায় ফুল চাষে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ১৫ লাখ
টাকার। ঢাকার আশপাশ অঞ্চলে কপি, আলু, বরবটি, বেগুন, পটোল, কচু, ধনেপাতা,
শসা, বাঁধাকপি, টমেটো, ঝিঙা, ঢেঁড়স, ডাঁটা ইত্যাদি শাক-সবজি চাষ হয়।
ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, সুনামগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে আসে
মাছ। আসে মোরগ-মুরগি। এসবের চাষীদের মাথায় হাত। পাইকাররা ওইসব অঞ্চলে যেতে
পারছেন না। এই যে খবরটি দিলাম, এটাও টাকার অংকে ছোট খবর। খবর আছে চিনি
শিল্পের। সয়াবিনের। জাহাজভাঙা শিল্পের। এসব শিল্প ও ব্যবসা ভীষণভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গার্মেন্ট খাতও ধীরে ধীরে হরতাল ও অবরোধের কুফল পেতে
শুরু করেছে। পাটশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চা রফতানি নেই। সব কিছু মিলিয়ে এক
ভীতিপ্রদ চিত্র।
এই চিত্র অর্থনীতির। এর তাৎক্ষণিক শিকার হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন। এরা শিল্পে, ব্যবসায়, বাণিজ্যে, পর্যটনে অর্থের জোগান দেয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সমানে আসছেন ব্যাংকে। তাদের ‘ঋণখেলাপি’ হয় হয় অবস্থা। ব্যাংকের টাকা দিতে পারছেন না। কিস্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ‘ক্যাশ জেনারেশন’ নেই। ‘ফান্ড ফ্লো’ তাদের বিঘ্নিত। আমদানি বিঘ্নিত। রফতানি বিঘ্নিত। অভ্যন্তরীণ বেচাকেনা স্থবির। অনেক শিল্প বন্ধ হয় হয় অবস্থায়। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতেও অনেকে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমি ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’দের কথা বলছি না। সাধারণ ব্যবসায়ীদেরও অবস্থা একই। উপায়ান্তর না দেখে তারা আসছেন ব্যাংকে। আসছেন ঋণ পুনঃতফসিল (রিসিডিউলিং) করাতে। সুদ মওকুফ করাতে। এটি করতে ‘ডাউন পেমেন্ট’ লাগে। সেই টাকাও অনেকের নেই। তাই পুনঃতফসিল করা যায় না। যেতে হবে কেন্দ্রীয় বাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও হাত-পা বাঁধা। নতুনভাবে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে অনেক কড়াকড়ি করা হয়েছে। পুনঃতফসিল আবার তিনবারের বেশি করা যাবে না। ইতিমধ্যেই অনেকে তা দুবার করে ফেলেছেন। হাতে আছে আর একবার মাত্র। ভবিষ্যৎ সেই অর্থে অন্ধকার। অনেকে আসছেন ব্যাংকে ‘ব্লক্ড অ্যাকাউন্ট’ করাতে, যাতে সুদারোপ আর না হয়। এসবই বড় ব্যবসায়ীদের সমস্যা।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা এখন সব ব্যাংকের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছেন। তাদের টাকা আটকে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো তাদের সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে। মামলা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু মামলা করে ব্যাংকের টাকা আদায় করার উদাহরণ খুব কম। একটু সমস্যা হলেই গ্রাহক চলে যাচ্ছেন উচ্চ আদালতে। হচ্ছে ‘রিট’, যার থেকে মুক্তি পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকরা ঠুকে দিচ্ছেন ক্ষতিপূরণ মামলা (কমপেনসেশন সুট)। এটা হচ্ছে ব্যাংকের ওপর বেশতি ঝামেলা বা চাপ। এ চাপ সৃষ্টি করে গ্রাহক ফায়দা লুটতে চাইছে। প্রায় সব ব্যাংকেই এসব ঘটনা ঘটছে। এদিকে সব ব্যাংকের মুনাফাতেই নেমেছে ধস। খুব কম ব্যাংকই ২০১৩ ক্যালেন্ডার বছরে ভালো মুনাফা দেখাতে পারবে। আমানত ২০১৩ সালে ছিল ব্যয়বহুল। সে তুলনায় ‘লেন্ডিং রেট’ ব্যাংকগুলো ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে পারেনি। অনেক ব্যাংকে এসব কারণে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক ব্যাংক প্রভিশনিং ঘাটতিতে পড়েছে। আগামীতে আরও বেশি পড়ার আশংকা। কারণ বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা যদি চলতে থাকে, অব্যাহত থাকে অশান্তি তাহলে ব্যাংকের ব্যবসা বাড়ার কোনো কারণ নেই। ব্যাংকের সবচেয়ে বড় আয় আসে সুদ থেকে। এটা ঋণের ওপর সুদ। আর বেশকিছু আয় আসে আমদানি-রফতানি থেকে। এসব ব্যবসায় ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়। এতে ব্যাংকের বেশ ‘কমিশন’ আয় হয়। এ ছাড়া রয়েছে নানাবিধ আয়। এ অবস্থায় আমদানি-রফতানিতে টান পড়লে স্বাভাবিকভাবেই ওইসব আয়েও টান পড়বে। এর ফল একটি। পরিকল্পনা মোতাবেক ‘প্রফিট’ না হওয়া।
এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ব্যবস্থা কী? এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী, বিশেষ করে সরকারি বড় ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকগুলোতে এখন অনেক উদ্বৃত্ত টাকা আছে। একশ’ টাকার আমানতের বিপরীতে ১৯ টাকা ‘লিক্যুইডিটি’ হিসেবে রেখে ব্যাংকগুলো ৮১ টাকা ঋণ দিতে পারে। ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। দেশে টাকা আছে। কিন্তু ঋণ সংকোচন নীতির ফলে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলো। সরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সমঝোতা’ চুক্তি আছে, যা অবশ্য পালনীয়। এর অধীনে ব্যাংকগুলো কত ঋণ দিতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়- তা হবে নিয়মভঙ্গ করা। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেছে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্য বেশ কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে- এটা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা কারও নেই। অতীতে ঋণ সম্প্রসারণ অনেক বেশি হয়েছে। অনেকেই ঋণের টাকা অন্য খাতে ডাইভার্টও করেছে। এর অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। তাছাড়া আরও অনেক কারণ আছে, যার কারণে ঋণ সম্প্রসারণ বেশি হয়েছে। যা রোধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথভাবেই ঋণপ্রবাহ কিছুটা সংকুচিত করার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এখন সমস্যা অন্যত্র। ব্যাংকে ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমছে। যদি এসব ‘ফান্ড’ ব্যবহার না করা যায়, তাহলে ব্যাংকের হাতে কাজ থাকে একটি- আর কোনো আমানত গ্রহণ না করা। এর ফল ব্যাংকিং খাতের জন্য হবে মারাত্মক, এমনকি অর্থনীতির জন্যও হবে মারাত্মক। ব্যাংকিং খাতে বরাবর এটা ঘটছে। কখনও কখনও প্রচুর আমানত পাওয়া যায় বাজারে। আবার কখনও কখনও আমানতের সংকট দেখা দেয়। দুটো সমস্যা দুই ধরনের। ব্যাংক কোনোদিন এ পরিস্থিতিতে চরম অবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। অর্থাৎ ব্যাংক যখন আমানত বেশি করে পায়, তখন বলতে পারে না যে, আমরা আমানত নেব না। কারণ গ্রাহকদের একবার বিদায় করে দিলে আবার আনতে সময় লাগে। কাজেই ব্যাংককে গ্রহণ করতে হয় মধ্যপন্থা। এ অবস্থায় বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে ব্যাংক ‘আমানত’ বিদায় করে দিয়ে ভবিষ্যতে ঝুঁকিতে পড়ার মতো অবস্থায় যেতে পারে না।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ব্যাংক যদি ‘আমানত’ না নেয়, তাহলে টাকা যাবে কোথায়? টাকা যাওয়ার রাস্তা হচ্ছে শেয়ারবাজার অথবা সঞ্চয়পত্র। শেয়ারবাজারে যদি হঠাৎ বেশি বেশি টাকা যেতে শুরু করে, তাহলে দুই বছর আগের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। শেয়ার কম অথচ ‘লিক্যুইডিটি’ বেশি। এতে শেয়ারের দামে ‘বাবল’ সৃষ্টি হবে। এ অবস্থা কাম্য নয়। এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতেও যে হাওয়া লাগবে, তাও মনে হয় সম্ভব নয়। আর সঞ্চয়পত্রে সব লোক যাবে না। অতএব কী থাকে বিকল্প? বিকল্প থাকে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়, শিল্পের অবস্থা ভালো নয়, আমদানি-রফতানির অবস্থা ভালো নয়। এসবই সত্য কথা। কিন্তু এর মধ্যেই অনেকে ব্যবসা করতে চান, শিল্প করতে চান। তারা ব্যাংকে আসছেন। কিন্তু ঋণসীমা নির্ধারিত থাকায় সরকারি ব্যাংকগুলো কোনো ঋণ দিতে পারছে না। অথচ ঋণ বাড়াতে পারলে ব্যাংকের আয় বাড়বে। শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণের শতাংশ হিসাব কমে।
ইদানীং দেখা দিচ্ছে আরেক সমস্যা। দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায় প্রত্যেকটি বড় ও নতুন ঋণের ক্ষেত্রে ‘চিফ ইন্টারনাল অডিটরের’ সার্টিফিকেট। এটা তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতেই একটা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পর্যায়ে নিতে বেশ সময় লাগে। ঋণ প্রস্তাব বড় বড় ব্যাংকে প্রথমে ব্রাঞ্চে তৈরি হয়। তা যায় আঞ্চলিক অফিসে, তারপর যায় বিভাগীয় অফিসে। এরপর যায় প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যায় ক্রেডিট কমিটিতে, যেখানে ব্যাংকের সিনিয়ররা বসেন। তারপর যায় এমডি মহোদয়ের কাছে। এতসব করার পর যদি চিফ ইন্টারনাল অডিটরের সার্টিফিকেট দরকার হয়, তাহলে তো পুরো কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া চিফ ইন্টারনাল অডিটরের কাজ হচ্ছে ঋণ-পরবর্তী ঘটনা। তিনি দেখবেন ঋণ অনুমোদনে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে তা প্রতিপালিত হয়েছে কি-না, সব নিয়মনীতি মেনে ঋণটির কাজ চলছে কি-না, ঋণে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি-না, শর্তের বাইরে কিছু হচ্ছে কি-না ইত্যাদি। এখন যদি তাকে ‘ঋণ-পূর্ববর্তী’ পর্যায়ে জড়ানো হয়, তাহলে তো তার পরবর্তী কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। একই ব্যক্তি দুই পর্যায়ের কাজে জড়িত হলে তা নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ে বাধা সৃষ্টি করবে। বস্তুত তিনি হয়ে উঠবেন সর্বোচ্চ ‘পাওয়ার সেন্টার’। তাই নয় কি? বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা দরকার বলে মনে করি।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
এই চিত্র অর্থনীতির। এর তাৎক্ষণিক শিকার হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশন। এরা শিল্পে, ব্যবসায়, বাণিজ্যে, পর্যটনে অর্থের জোগান দেয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সমানে আসছেন ব্যাংকে। তাদের ‘ঋণখেলাপি’ হয় হয় অবস্থা। ব্যাংকের টাকা দিতে পারছেন না। কিস্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ‘ক্যাশ জেনারেশন’ নেই। ‘ফান্ড ফ্লো’ তাদের বিঘ্নিত। আমদানি বিঘ্নিত। রফতানি বিঘ্নিত। অভ্যন্তরীণ বেচাকেনা স্থবির। অনেক শিল্প বন্ধ হয় হয় অবস্থায়। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতেও অনেকে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমি ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি’দের কথা বলছি না। সাধারণ ব্যবসায়ীদেরও অবস্থা একই। উপায়ান্তর না দেখে তারা আসছেন ব্যাংকে। আসছেন ঋণ পুনঃতফসিল (রিসিডিউলিং) করাতে। সুদ মওকুফ করাতে। এটি করতে ‘ডাউন পেমেন্ট’ লাগে। সেই টাকাও অনেকের নেই। তাই পুনঃতফসিল করা যায় না। যেতে হবে কেন্দ্রীয় বাংকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও হাত-পা বাঁধা। নতুনভাবে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে অনেক কড়াকড়ি করা হয়েছে। পুনঃতফসিল আবার তিনবারের বেশি করা যাবে না। ইতিমধ্যেই অনেকে তা দুবার করে ফেলেছেন। হাতে আছে আর একবার মাত্র। ভবিষ্যৎ সেই অর্থে অন্ধকার। অনেকে আসছেন ব্যাংকে ‘ব্লক্ড অ্যাকাউন্ট’ করাতে, যাতে সুদারোপ আর না হয়। এসবই বড় ব্যবসায়ীদের সমস্যা।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা এখন সব ব্যাংকের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছেন। তাদের টাকা আটকে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো তাদের সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে। মামলা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু মামলা করে ব্যাংকের টাকা আদায় করার উদাহরণ খুব কম। একটু সমস্যা হলেই গ্রাহক চলে যাচ্ছেন উচ্চ আদালতে। হচ্ছে ‘রিট’, যার থেকে মুক্তি পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকরা ঠুকে দিচ্ছেন ক্ষতিপূরণ মামলা (কমপেনসেশন সুট)। এটা হচ্ছে ব্যাংকের ওপর বেশতি ঝামেলা বা চাপ। এ চাপ সৃষ্টি করে গ্রাহক ফায়দা লুটতে চাইছে। প্রায় সব ব্যাংকেই এসব ঘটনা ঘটছে। এদিকে সব ব্যাংকের মুনাফাতেই নেমেছে ধস। খুব কম ব্যাংকই ২০১৩ ক্যালেন্ডার বছরে ভালো মুনাফা দেখাতে পারবে। আমানত ২০১৩ সালে ছিল ব্যয়বহুল। সে তুলনায় ‘লেন্ডিং রেট’ ব্যাংকগুলো ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে পারেনি। অনেক ব্যাংকে এসব কারণে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক ব্যাংক প্রভিশনিং ঘাটতিতে পড়েছে। আগামীতে আরও বেশি পড়ার আশংকা। কারণ বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা যদি চলতে থাকে, অব্যাহত থাকে অশান্তি তাহলে ব্যাংকের ব্যবসা বাড়ার কোনো কারণ নেই। ব্যাংকের সবচেয়ে বড় আয় আসে সুদ থেকে। এটা ঋণের ওপর সুদ। আর বেশকিছু আয় আসে আমদানি-রফতানি থেকে। এসব ব্যবসায় ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়। এতে ব্যাংকের বেশ ‘কমিশন’ আয় হয়। এ ছাড়া রয়েছে নানাবিধ আয়। এ অবস্থায় আমদানি-রফতানিতে টান পড়লে স্বাভাবিকভাবেই ওইসব আয়েও টান পড়বে। এর ফল একটি। পরিকল্পনা মোতাবেক ‘প্রফিট’ না হওয়া।
এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ব্যবস্থা কী? এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী, বিশেষ করে সরকারি বড় ব্যাংকগুলোর। ব্যাংকগুলোতে এখন অনেক উদ্বৃত্ত টাকা আছে। একশ’ টাকার আমানতের বিপরীতে ১৯ টাকা ‘লিক্যুইডিটি’ হিসেবে রেখে ব্যাংকগুলো ৮১ টাকা ঋণ দিতে পারে। ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। দেশে টাকা আছে। কিন্তু ঋণ সংকোচন নীতির ফলে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলো। সরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সমঝোতা’ চুক্তি আছে, যা অবশ্য পালনীয়। এর অধীনে ব্যাংকগুলো কত ঋণ দিতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়- তা হবে নিয়মভঙ্গ করা। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেছে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্য বেশ কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে- এটা স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা কারও নেই। অতীতে ঋণ সম্প্রসারণ অনেক বেশি হয়েছে। অনেকেই ঋণের টাকা অন্য খাতে ডাইভার্টও করেছে। এর অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। তাছাড়া আরও অনেক কারণ আছে, যার কারণে ঋণ সম্প্রসারণ বেশি হয়েছে। যা রোধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথভাবেই ঋণপ্রবাহ কিছুটা সংকুচিত করার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এখন সমস্যা অন্যত্র। ব্যাংকে ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমছে। যদি এসব ‘ফান্ড’ ব্যবহার না করা যায়, তাহলে ব্যাংকের হাতে কাজ থাকে একটি- আর কোনো আমানত গ্রহণ না করা। এর ফল ব্যাংকিং খাতের জন্য হবে মারাত্মক, এমনকি অর্থনীতির জন্যও হবে মারাত্মক। ব্যাংকিং খাতে বরাবর এটা ঘটছে। কখনও কখনও প্রচুর আমানত পাওয়া যায় বাজারে। আবার কখনও কখনও আমানতের সংকট দেখা দেয়। দুটো সমস্যা দুই ধরনের। ব্যাংক কোনোদিন এ পরিস্থিতিতে চরম অবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। অর্থাৎ ব্যাংক যখন আমানত বেশি করে পায়, তখন বলতে পারে না যে, আমরা আমানত নেব না। কারণ গ্রাহকদের একবার বিদায় করে দিলে আবার আনতে সময় লাগে। কাজেই ব্যাংককে গ্রহণ করতে হয় মধ্যপন্থা। এ অবস্থায় বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে ব্যাংক ‘আমানত’ বিদায় করে দিয়ে ভবিষ্যতে ঝুঁকিতে পড়ার মতো অবস্থায় যেতে পারে না।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ব্যাংক যদি ‘আমানত’ না নেয়, তাহলে টাকা যাবে কোথায়? টাকা যাওয়ার রাস্তা হচ্ছে শেয়ারবাজার অথবা সঞ্চয়পত্র। শেয়ারবাজারে যদি হঠাৎ বেশি বেশি টাকা যেতে শুরু করে, তাহলে দুই বছর আগের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। শেয়ার কম অথচ ‘লিক্যুইডিটি’ বেশি। এতে শেয়ারের দামে ‘বাবল’ সৃষ্টি হবে। এ অবস্থা কাম্য নয়। এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতেও যে হাওয়া লাগবে, তাও মনে হয় সম্ভব নয়। আর সঞ্চয়পত্রে সব লোক যাবে না। অতএব কী থাকে বিকল্প? বিকল্প থাকে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়, শিল্পের অবস্থা ভালো নয়, আমদানি-রফতানির অবস্থা ভালো নয়। এসবই সত্য কথা। কিন্তু এর মধ্যেই অনেকে ব্যবসা করতে চান, শিল্প করতে চান। তারা ব্যাংকে আসছেন। কিন্তু ঋণসীমা নির্ধারিত থাকায় সরকারি ব্যাংকগুলো কোনো ঋণ দিতে পারছে না। অথচ ঋণ বাড়াতে পারলে ব্যাংকের আয় বাড়বে। শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণের শতাংশ হিসাব কমে।
ইদানীং দেখা দিচ্ছে আরেক সমস্যা। দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায় প্রত্যেকটি বড় ও নতুন ঋণের ক্ষেত্রে ‘চিফ ইন্টারনাল অডিটরের’ সার্টিফিকেট। এটা তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতেই একটা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পর্যায়ে নিতে বেশ সময় লাগে। ঋণ প্রস্তাব বড় বড় ব্যাংকে প্রথমে ব্রাঞ্চে তৈরি হয়। তা যায় আঞ্চলিক অফিসে, তারপর যায় বিভাগীয় অফিসে। এরপর যায় প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যায় ক্রেডিট কমিটিতে, যেখানে ব্যাংকের সিনিয়ররা বসেন। তারপর যায় এমডি মহোদয়ের কাছে। এতসব করার পর যদি চিফ ইন্টারনাল অডিটরের সার্টিফিকেট দরকার হয়, তাহলে তো পুরো কার্যক্রমই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া চিফ ইন্টারনাল অডিটরের কাজ হচ্ছে ঋণ-পরবর্তী ঘটনা। তিনি দেখবেন ঋণ অনুমোদনে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে তা প্রতিপালিত হয়েছে কি-না, সব নিয়মনীতি মেনে ঋণটির কাজ চলছে কি-না, ঋণে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি-না, শর্তের বাইরে কিছু হচ্ছে কি-না ইত্যাদি। এখন যদি তাকে ‘ঋণ-পূর্ববর্তী’ পর্যায়ে জড়ানো হয়, তাহলে তো তার পরবর্তী কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। একই ব্যক্তি দুই পর্যায়ের কাজে জড়িত হলে তা নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ে বাধা সৃষ্টি করবে। বস্তুত তিনি হয়ে উঠবেন সর্বোচ্চ ‘পাওয়ার সেন্টার’। তাই নয় কি? বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা দরকার বলে মনে করি।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
No comments