ইতিউতি-রেলগাড়িতে উঠবে নাকি সোনার তরী by আতাউস সামাদ

আমার মতো পচা ছাত্রদের জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এক মহাভরসাস্থল। তাঁর সব কবিতাই এত ছন্দময় যে দু'চারবার পড়লেই কোনো কোনোটার অন্তত কয়েকটা পঙ্ক্তি মুখস্থ হয়ে যেত। ওইভাবে তাঁর কিছু কবিতা ঠোঁটস্থ করে মাঝে মাঝেই আওড়াতাম, যাতে বড়রা মনে করেন, ছেলেটা পড়ুয়া বটে।


স্কুলে বাংলা ক্লাসের স্যার যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা মুখস্থ বলতে আদেশ করতেন তখন সহজেই পার পেয়ে যেতাম। আর কিছু মনে না পড়লে অন্ততপক্ষ 'শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই', 'ভূতের মতো অদ্ভুত যেমন নির্বোধ অতি ঘোর', 'নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে' অথবা 'রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম'_এসব তো ছিলই; আর ছিল অগতির গতি 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।' (বাংলাদেশে এখন হয়েছে অমন কত শত পানিবিহীন ছোট নদী?)। পরীক্ষার সময় অবশ্য সেই সহজলভ্য বিদ্যা অতটা কাজে দিত না। কারণ তখন ভাবার্থ, ব্যাখ্যা_এসব লিখতে বলা হতো। জানলে তবেই তো লিখব। কিন্তু না জানলে? মানে জানিনি, অর্থ শিখিনি, প্রেক্ষাপট পড়া নেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমন যেসব কবিতার খানিকটা 'আবৃত্তি' করতে পারতাম তার মধ্যে 'সোনার তরী' ছিল একটি। সংকটপূর্ণ ও সংঘাতময় প্রায় পাঁচ দশক ধরে খবরের কাগজ ও রেডিওর জন্য যত রিপোর্ট লিখতে হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগেরই বিষয়বস্তু ছিল কবিতার জগতের অনেক বাইরে তো বটেই, এমনকি ওসবকে 'গদ্যময়' বললেও কম শুকনো বলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু আমার পড়ার বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য, তাই পরীক্ষা পাস করার জন্য বহু কবিতা পড়তে হয়েছিল এবং বিখ্যাত অনেক কবি সম্পর্কে জানতে হয়েছিল। কিন্তু রিপোর্টারের চাকরি করতে করতে তাঁদের দু-চারজন ছাড়া আর সবার নাম পর্যন্ত মন থেকে মুছে গিয়েছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শেকসপিয়র, কিটস, টি এস ইলিয়ট ও ওমর খৈয়ামের নাম মনে ছিল। তাঁদের দু-তিন পঙ্ক্তি মাঝে মাঝে আপন মনে বলেও ফেলতাম। এখন অবাক হয়ে খেয়াল করি, ওই সময়গুলোতে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ত 'সোনার তরী' কবিতার কয়েকটি লাইন_তবে এলোমেলোভাবে। 'গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।/কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।' কবিতাটির শুরুর এই দুটি লাইন আমার এক ভাই মাঝে মাঝেই শুনিয়ে দিতেন। তখন আমাদের বুঝে নিতে হতো, তিনি এমন কোনো গভীর সমস্যায় পড়েছেন যে তার কোনো সমাধান করতে পারছেন না। তবে কেন জানি কারণে-অকারণে আমার মনে পড়ত_'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী/আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।/শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরেফিরে/শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি_যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।' বেশি করে মনে পড়ত এই দুটি পঙ্ক্তি_'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী/আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।' মাঝে মাঝে এ কথাগুলোর মানে ভাবতে গেলে কেবলই মনে হতো কবির 'সোনার তরী'র মাঝিটি খুবই লোভী ও নিষ্ঠুর।
গত বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে মিলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড় শততম জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে পালন করবে। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাঁর ভারত সফর সম্পর্কে অনেক সংবাদ বের হচ্ছিল। তখন একটা খবর পড়লাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মদিন পালন উপলক্ষে ভারত থেকে কিছু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশে আসবেন ট্রেনে করে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকি প্রস্তাব করেছেন, ওই ট্রেনটার নাম রাখা হোক 'সোনার তরী'। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, কারণ আমার মাথায় ঘুরছে 'সোনার তরী' কবিতাটির মূলকথা হচ্ছে বঞ্চনা। যিনি তাঁর সব ধান নৌকায় তুলে দিলেন তাঁকেই উদ্ধার করেননি সেই তরীর মাঝি। এখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটা যদি তেমনই হয়ে যায়, অর্থাৎ কি না বাংলাদেশ কেবল দিয়েই যাচ্ছে, পাচ্ছে না কিছুই আর ভারত কেবল নিয়েই নিচ্ছে, দিচ্ছে না কিছুই। ভাবলাম, এ কথাটা লিখেই ফেলি কোনো পত্রিকার জন্য। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও মনে হলো, আমি মূর্খ তো 'সোনার তরী' কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ বা দর্শন নিয়ে মাথা ঘামাইনি কোনো দিন বা পড়িনি কিছুই। দ্বিতীয় দফা বোকা বনার আগে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের শরণাপন্ন হলাম। তাঁর মোবাইল ফোনে খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিনি তখন চট্টগ্রামে। নাছোড়বান্দা হয়ে ফোনেই প্রশ্ন করলাম_'আনিস ভাই, সোনার তরী কবিতার ভাবার্থ কী?' তিনি সংক্ষেপে বললেন, 'এ কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন মহাকালের কোলে আমাদের কর্ম বেঁচে থাকবে, যদিও আমরা থাকব না এবং বিস্মৃত হয়ে যাব।' বুঝলাম। মনে ভাবলাম, বেঁচে গেলাম। 'সোনার তরী'কে বঞ্চনার প্রতীক আখ্যা দিলে কী বিপদই না হতো! তখন আর লেখা হলো না। তা ছাড়া ওই একটি বাক্যে অত বিখ্যাত কবিতার ব্যাখ্যা দিতে গেলে তো আর কলাম হয় না। তাই মন খুঁতখুঁত করছে। বন্ধু অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদকে খোঁজ করলাম এই আশায়, যদি তাঁর কাছ থেকে আর গুটিকয় বাক্য ধার পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর যে ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল তাতে কেউ সাড়া দিলেন না।
অবশেষে কবি সাযযাদ কাদিরকে ধরলাম। তিনি বললেন, 'রবিঠাকুর একবার ইউরোপ ঘুরে এসে কবিতাটি লিখেছিলেন। তিনি সেখানে দেখেছিলেন, শিল্পোন্নত পাশ্চাত্যে মানুষ কাজ করেই চলেছে। কাজ ছাড়া সে আর কিছু বোঝে না। সেখানে মানুষ নিজেকেও আর সময় দিচ্ছে না। এই দেখে কবিগুরুর মন খুব খারাপ হয়েছিল। বস্তুবাদী জগতের চেহারা দেখে তিনি বেদনাহত হয়েছিলেন।' সাযযাদ কাদির বললেন, এ রকম একটা ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্নপত্রে দিয়েছেন বলে তাঁর মনে পড়ে। তো এসব শুনে সে যাত্রা আমার কিছু আর লেখা হলো না। তবে সম্প্রতি দেখলাম, সাযযাদ কাদির তাঁর একটা লেখায় 'সোনার তরী' সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যাতে কবি বলছেন, 'মানুষ তার সমস্ত জীবনের কর্মফল সংসারের তরণীতে তুলে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না। কিন্তু মানুষ যখন সংসারকে বলে আমাকে নাও, আমাকেও রাখো তখন সংসার বলে তোমার জন্য জায়গা কোথায়?' সাযযাদ কাদিরের লেখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের কথা পড়ে মনে হলো, গোড়াতে আমি একেবারে ভুল বুঝিনি। 'সোনার তরী' কবিতায় বঞ্চিত হওয়ার ভাব আছে বটে। তাই কালের কণ্ঠ পত্রিকা মারফত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, ঢাকা-কলকাতা ট্রেনের নাম 'সোনার তরী' রাখবেন না। বঞ্চনার শিকার হয়ে লাভ কী? তা ছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের যে অমূল্য সহায়তা দিয়েছে তা আমরা যত গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই এখনো স্মরণ করি না কেন, বর্তমানের নয়াদিলি্ল অর্থাৎ ভারতীয় শাসকরা বাংলাদেশের প্রতি ইদানীং খুব কি মমতাময় আছেন? তাঁরা গঙ্গা আর তিস্তা নদীর পানি নিয়েছেন, ট্রানজিট নিয়েছেন, অঢেল মুনাফা নিচ্ছেন একতরফা বাণিজ্য থেকে, সীমান্তে তাঁদের দেওয়া তারকাঁটার বেড়ায় দিচ্ছেন আমাদের কিশোরী কন্যা ফেলানী আর কিশোর রেকাতুলের রক্ত দিয়ে প্রলেপ। এর পরও বোনাস হিসেবে তাঁরা আদায় করেছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের সমর্থন। এসবের পরিবর্তে আমরা অনেক কান্নাকাটি করার পর তাঁরা আমাদের ফেরত দেন বিএসএফের হাতে গুলিবিদ্ধ ফেলানীদের প্রাণহীন দেহ। তার পরও হয়তো কেউ বলবেন, কেন, ভারত বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে না? হ্যাঁ, দিচ্ছে। তবে ভাই, ওই টাকা তো ঋণ, ওটা তো আমরা সুদে-আসলে শোধ করব। আর এই যে বারবার দুইবার নগদ অর্থ দিয়ে চাল কিনতে চাইল বাংলাদেশ, ভারত নাকি রাজিও হলো তা বেচতে; কিন্তু কই, সেই চাল তো এল না! অবশেষে খাদ্যমন্ত্রীকে ভিয়েতনাম আর থাইল্যান্ডের দ্বারস্থ হতে হলো চাল কিনতে। অবস্থাদৃষ্টে যে কেউ মনে করতেই পারেন কবিগুরুর 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে' ভারত তাঁর সেই দর্শন মন থেকে মুছে ফেলেছে। রবিঠাকুর বেঁচে থাকলে আজকে হয়তো 'সোনার তরী' কবিতার 'অপর পৃষ্ঠা' লিখতে চাইতেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.