দাবদাহে বিপদে গরিব ও কৃষক

ভারতের চলমান তাপদাহে নয়া দিল্লিতে নিজেকে
ঠান্ডা করার চেষ্টায় এক শিশু। ছবি: মণি শর্মা/এএফপি
ভারতের চলমান তাপদাহে এলাহাবাদে
রাস্তায় একটু শীতল আশ্রয়ের খোঁজে এক
গৃহহীন ব্যক্তি। ছবি: সঞ্জয় কানোজিয়া/এএফপি
ভারতে ভয়াবহতম তাপদাহের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামনের বছরগুলোতে দেশে দেশে এমন তাপদাহ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাপদাহে পুড়ে খাক ভারতে প্রায় ২ হাজার মানুষের মৃত্যু শুধু ভারত নয় গোটা পৃথিবীর সামনেই ভবিষ্যতের প্রশ্নটি বড় করে তুলে ধরেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন তাপদাহে গরিব ও কৃষকেরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে এবং এর ফলে হুমকির মুখে পড়তে পারে বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা। দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে জানিয়েছে। ভারতে প্রখর খরতাপে রাস্তার পিচ গলা অবস্থা। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গরিব, বয়স্ক আর শিশুরা। অবশ্যই ছাতা বা ছড়ানো ঝালরের টুপি ব্যবহার করা, হালকা রঙের সুতি কাপড় পড়া আর পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পানের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সব চিকিৎসকেদের ছুটি নিষিদ্ধ করেছে এবং জনগণকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়িঘর থেকে না বেরোতেও পরামর্শ দিয়েছে ভারত সরকার।
কিন্তু সোয়া শ কোটি মানুষের এই দেশে অনেকেরই তো বাড়ি বসে থাকার কোনো উপায় নেই। এদিকে সপ্তাহ দু-এক ধরে তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। আশার কথা হলো খুব শিগগিরই হয়তো বজ্র আর বিদ্যুতের চমকে চরাচর জুড়িয়ে দিতে আসবে বর্ষা। প্রাণঘাতী এই দাবদাহের হয়তো আপাত অবসান হবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বছরের পর বছর যদি এমন দাবদাহে পুড়তে হয় তাহলে মানুষ কীভাবে তার সঙ্গে মানিয়ে নেবে। মাঠ-ঘাটের কাজকর্ম, কল-কারখানা, অফিস-আদালত আর জনজীবন কী করে সইবে এমন দাবদাহ!
জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির নেপথ্যে পৃথিবীর বুকে মানুষের পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডই যে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে সে বিষয়ে তেমন কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু ভারতের এই দাবদাহের মতো চরম আবহাওয়ার এ রকম কোনো একটা একক ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত করে ব্যাখ্যা করাটা কঠিন। তবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী বছরগুলোতে দুনিয়ার নানা প্রান্তে এমন চরম আবহাওয়ার নমুনা আমাদের প্রায়শই দেখতে হবে।
গ্রিনপিসের এক মুখপাত্র বলেছেন,‘সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, পৃথিবীতে মানবসৃষ্ট উষ্ণায়ন না ঘটলে যতটা হতো এখন তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি দাবদাহ দেখতে পাচ্ছি আমরা। আর কোনো একটি নির্দিষ্ট দাবদাহ এমন মানবসৃষ্ট কারণ থেকে ঘটার আশঙ্কাই প্রায় ৮০ ভাগ।’ কার্বন নির্গমন কমানো না গেলে ২০৪০ সালের মধ্যে এই ধরনের দাবদাহ এখনকার চেয়ে প্রায় ১২ গুণ বেড়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন ওই মুখপাত্র।
এ ধরনের চরম আবহাওয়ায় দীর্ঘ দিনের অভিযোজনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মানব শরীরের বর্তমান সক্ষমতা মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে খাদ্য উৎপাদনে। বিশ্বজুড়ে মোট কর্মঘণ্টার অর্ধেকেরও বেশি সময় ব্যয় হয় খোলা আকাশের নিচে, প্রধানত কৃষিকাজে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমশক্তিই এমন কায়িক শ্রমে নিয়োজিত যেখানে অতিরিক্ত তাপমাত্রাতেও মাঠে-ঘাটে কাজ করতে বাধ্য হয়ে থাকে তারা।
ভবিষ্যতে, এমন তাপদাহ নিয়মিত ঘটনা হয়ে পড়লে মানুষের কর্মক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। ভারতের বর্তমান তাপদাহের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, যারা মাঠে-ময়দানে, রাস্তা-ঘাটে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন তারাই এমন ঘটনায় ‘হিটস্ট্রোকের’ সবচেয়ে বড় শিকার।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মার্ক মাসলিন বলেন,‘যদি সবাই ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের মতো জীবনমানে থাকতেন তাহলে এটা কোনো বড় ইস্যু হতো না। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ খাদ্য উৎপাদিত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার কিছু অংশে ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছ থেকে।’
তিনি আরও বলেন,‘যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাক্টরে করে বিশাল বিশাল সব শস্যক্ষেত্র চাষ করেন শিল্পোন্নত কৃষিকাজে যুক্ত কৃষকেরা। কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ক্ষুদ্র চাষিরাই নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করেন এবং স্থানীয় শহর ও নগরগুলোর জন্য উদ্বৃত্ত খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করেন।’ কিন্তু ভারত কিংবা এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোতে যত তাপদাহই থাকুক না কেন কাজে না গেলে মজুরি না পাওয়া কিংবা ফসল না পাওয়ার কারণেও মারাত্মক পরিণতির মধ্যে পড়তে হতে পারে তাঁদের।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানায় পারডিউ ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চ সেন্টারের ম্যাথিউ হিউবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত তাপমাত্রায় মানুষ কতটা মানিয়ে নিতে পারবে সে বিষয়ে গবেষণা করছেন। ম্যাথিউ বলেন,‘বাতাস শুকনো থাকলে একটা কাবাব পুড়িয়ে খাওয়ার মতো পরিবেশেও মানুষ কিছুটা সময় টিকে থাকতে পারে। কিন্তু ওই একই তাপমাত্রায় বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে আমরা পুড়ে মারা যাব। ঘাম ঝরিয়ে নিজের শরীরকে ঠান্ডা করার প্রায় বিরল সক্ষমতা আছে মানুষের। কিন্তু এটা কেবল অপেক্ষাকৃত শুকনো পরিবেশেই কার্যকর হয়।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন গ্রুপ বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় শ্রমশক্তির কর্মক্ষমতা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছেন। ন্যাচার ক্লাইমেট চেঞ্জ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বাড়তে থাকার কারণে ইতিমধ্যেই গ্রীষ্মকালে বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের সক্ষমতা হ্রাস পেয়ে ৯০ ভাগে নেমে এসেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কট্টর হিসাব-নিকেষে ২২০০ সালের দিকে এই সক্ষমতা আরও কমে গিয়ে ৪০ ভাগে নেমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পৃথিবীর যেসব জায়গায় তাপমাত্রার এই প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে তার মধ্যে রয়েছে ভারত, উত্তর-অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও।

No comments

Powered by Blogger.