মাদক ব্যবসার জন্য রেলপথ ঘিরে অবৈধ স্থাপনা? by কমল জোহা খান

আরজতপাড়ার রেললাইনের পাশে আবার গড়ে উঠেছে
দোকানপাট ও রিকশা গ্যারেজ। ছবি: মনিরুল আলম
‘ভাই, কোনটা লাগব, বড় না ছোট?’ সন্ধ্যার আলো চলে যাওয়ার আগে এখন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের রেলপথ ধরে হাঁটতে গেলে এমন কথা কানে আসে। প্রথম শুনলে একটু অবাক হতে হয়। তবে একটু দাঁড়ালেই কারণটা বোঝা যায়, ‘ছোট-বড়’ বলতে ইঙ্গিত করা হয় মরণঘাতী ইয়াবাকে।
যাঁরা ‘ছোট-বড়’র কথা বলেন, তাঁরা সবাই ইয়াবা বিক্রেতা। এঁদের অধিকাংশই আবার নারী। দিনের আলো সরে যেতেই এই বিক্রেতাদের গলার জোর বাড়ে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রমতে, রাজধানীতে এটি সবচেয়ে বড় মাদকের বাজার। তেজগাঁওয়ের এই রেলপথ ঘিরে প্রতিদিন অর্ধকোটি টাকার মাদকের লেনদেন চলে।
মাত্র আট মাস আগেই রেলপথের এই জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রেলপুলিশ। মাছবাজার উচ্ছেদ হওয়ার সঙ্গে মাদক ব্যবসাও তখন বন্ধ হয়ে যায়। মাছবাজার না বসলেও মাদকের ব্যবসা এখন আগের চেয়ে জমজমাট।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, বারবারই এ জায়গা দখল নেওয়া হয় মাদক ব্যবসার জন্যই। কারণ মাদক কেনা-বেচার জন্য জায়গাটি বেশ সুবিধার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এফডিসি রেলক্রসিং ও কারওয়ান বাজারের দিকে একাধিক রাস্তা থাকায় এখানে সহজে গা-ঢাকা দেওয়া যায়। তাই মাদকের ক্রেতাও বেশি। তা ছাড়া মাদকবিরোধী অভিযান হলে বিক্রেতারা ছোট ছোট বস্তিঘরে লুকিয়ে পড়তে পারেন। ধাওয়া খেয়ে কারওয়ান বাজারের পথচারীদের মধ্যেও মিশে যেতে অসুবিধা হয় না তাঁদের।
অন্যদিকে টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালানগুলো চট্টগ্রাম হয়ে ট্রেনে করে রাজধানীতে আনা যায়। এসব কারণে কারওয়ান বাজারের কাছের রেলপথকে বেছে নিয়েছে মাদক বিক্রেতারা। পাশে শুঁটকির বাজারও মাদক ব্যবসায়ীদের আরেকটি বাড়তি সুবিধার কারণ। টেকনাফ থেকে শুঁটকির চালান এখানকার দোকানে আসে। এই চালানের ভেতর ইয়াবা সহজে বহন করা যায়। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, শুঁটকির ভেতর ইয়াবার গন্ধ ও সন্ধান কিছুই পাওয়া যায় না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইয়াবা ছাড়াও গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন—এসব মাদক এখানে খুব সহজেই মেলে। তবে ইয়াবার ব্যবসা এখন বেশ রমরমা।
তেজগাঁও এফডিসি ক্রসিং থেকে শুরু করে কারওয়ান বাজারের শুঁটকিপট্টি পর্যন্ত রেললাইনে মাদকের ব্যবসা চলে তুলনামূলক বেশি। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানা বয়সের নারীদের হাতে প্যাকেট নিয়ে রেললাইনের ওপর হাঁটতে দেখা যায়। পথচারী দেখলেই তাঁরা বলা শুরু করেন, ‘কোনটা লাগব, ছোট না বড়?’ যাঁদের প্রয়োজন, ইশারাতেই তাঁরা বুঝে ফেলেন।
গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজার রেললাইনে দুর্ঘটনায় চারজন নিহত হওয়ার ঘটনার পরদিন উচ্ছেদ অভিযান চালায় রেলপুলিশ। সে সময় রেলপথের আশপাশের মাছবাজারসহ বহু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এরপর তেজগাঁও এফডিসি রেলক্রসিং থেকে শুরু করে মালিবাগ, মগবাজার, নাখালপাড়া ও মহাখালী পর্যন্ত রেললাইনের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। অভিযান শেষে এই রেলপথ পাহারায় ছিলেন আনসার সদস্যরা। এখন পাহারায় কেউ নেই।
এফডিসি রেলক্রসিংয়ের পাশে স্থানীয় যুবলীগ একটি কার্যালয় বসিয়েছে। এখান থেকে মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ আছে। ছবি: মনিরুল আলম
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর এই রেললাইনে মাদকের ব্যবসা বেশ কমে গিয়েছিল। এ বছরের হরতাল-অবরোধের সময় মাদক ব্যবসায়ীরা আবারও ফিরে আসে রেললাইনের ওপর। এর পাশের স্থাপনাগুলোও দখলদারদের আয়ত্তে চলে যায়। বাঁশ-টিন দিয়ে দোকান বসানোর কাজও চলছে। মাছ ব্যবসায়ীরাও বড় বড় বাক্স ফেলে রেখে জায়গা দখলে রেখেছেন।
পাশের নাখালপাড়া, আরজতপাড়ার রেললাইনের পাশে উচ্ছেদ হওয়া দোকানপাট ও রিকশা গ্যারেজ আবার গড়ে উঠেছে। স্থানীয় যুবলীগ একটি কার্যালয় বসিয়েছে একেবারে এফডিসি রেলক্রসিংয়ের পাশে। এখান থেকেই বর্তমানে এই মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
১৫ মে রাতে রামপুরার একটি বাসা থেকে ১২ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ জরিনা (৪৫) নামের এক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। জরিনা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, রেলপথে মাদক ব্যবসায় জড়িত একটি দলের নেতৃত্ব দেন মরিয়ম বেগম কুট্টি (২৮)। তেজগাঁও রেললাইন বস্তিতে থাকেন মরিয়ম। তাঁর কাছ থেকে কাছ থেকে ইয়াবার চালানটি কেনেন জরিনা।
জানা গেছে, ১৫ মার্চ তেজগাঁও থেকে মরিয়মকে গ্রেপ্তার করা হয়। অল্পদিনের মধ্যে জামিনে বের হয়ে আবার ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর ২৩ মে সন্ধ্যা সাতটার দিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে মরিয়মকে গ্রেপ্তার করে। মরিয়মের কাছ থেকে ৭০০ পিস ইয়ারা জব্দ করা হয়। তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় অভিযান পরিচালনাকারীদের ওপর হামলা চালায় মাদক বিক্রেতারা।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, শুধু মরিয়ম নন, পারভিন, আকলিমা, শিল্পী, লীলা, দুলাল, গাঁজা সেন্টু, বাবু, সোহেল, তজু নামে বেশ কয়েকজন এই এলাকায় মাদক বিক্রি করেন। প্রশাসন থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতাদের কমিশন দিয়ে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা। তবে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা সব সময়ই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
নাখালপাড়া এলাকায় রেললাইনের পাশে আবার গড়ে উঠেছে দোকানপাট ও রিকশা গ্যারেজ। ছবি: মনিরুল আলম
অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মাদক বিক্রেতাদের দাপট আগের চেয়ে বেশ বেড়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ মে পর্যন্ত ১০ বার অভিযান চালানো হলেও সব অভিযানই ছিল নিষ্ফল। মামলা হয়েছে মাত্র দুটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই, সর্ষের ভেতরই তো ভূত আছে। আমাদের লোকজনই অভিযানের আগাম খবর দিয়ে দেন। সঙ্গে আছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা, পুলিশ, রেলপুলিশের লোকজন। গডফাদারও আছে। এঁদের সামনে যাওয়ার সাহস আমাদের নেই।’
নাম প্রকাশ না করা ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আশপাশে অসংখ্য বস্তি ও পালানোর পথ থাকায় জড়িত ব্যক্তিদের ধরা সম্ভব হয় না। বস্তির ভেতরে গেলে হামলার শিকার হতে হয় অভিযান পরিচালনাকারীদের।
অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক খুরশীদ আলম বলেন, ‘আমরা সব সময়ই অভিযান চালিয়ে আসছি। কিন্তু আমাদের লোকবল কম। যারা মাদক ব্যবসা করে, তারা নিজেদের সাহসী মনে করে।’
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযান চালানোর মতো লোকবল আছে মাত্র ছয়জন। এঁদের মধ্যে চারজন সিপাহি, একজন উপপরিদর্শক ও একজন পরিদর্শক।
রেলপুলিশের পরিদর্শক আবদুল মজিদ বলেন, ‘সব তুলে দেব। আজকেও অভিযান চালিয়েছি।’
রেলপুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোর্শেদ আলম গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমি তিন দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি আমি দেখছি।’

No comments

Powered by Blogger.