ঢাকায় নয়া অধ্যায় শুরুর লক্ষ্যই মোদির by জয়ন্ত ঘোষাল

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে তার ঢাকা সফর এক নতুন অধ্যায় সূচিত করতে চলেছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শনিবার আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শান্তি এবং স্থায়িত্ব নিয়ে আসবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে সংসদের অনুমোদন নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তিটি করতে চলেছে ভারত। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে এই সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরও সেই বিতর্ক বহাল রয়ে গেছে। আমরা এ বিতর্কের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছি এবং সেটা সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। এটা আদৌ সামান্য ঘটনা নয়।’ সীমান্ত নিয়ে মনোমালিন্য মিটে গেলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও এ দিন প্রধানমন্ত্রীর সুরেই বলেন, ‘নেহরু প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৪৭-এ। তার পর কেটে গেছে প্রায় ৬৮ বছর। এত দিন পরে দুদেশের সীমান্ত সমস্যা সমাধানের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটা দারুণ ব্যাপার!’ প্রধানমন্ত্রী শনিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ নিয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এগুলো মূলত বন্দর, জলপথে বাণিজ্য, মানব পাচারবিরোধী পদক্ষেপ ইত্যাদি নিয়ে। এ সফরকে কেন তিনি এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের জানান মোদি। তার বক্তব্য, ‘আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও আমাদের কাছে তার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক।’ হাসিনা সরকার বেশ কয়েক বছর ধরেই যে সন্ত্রাস দমনে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা উল্লেখ করেন মোদি। আর এ পরিস্থিতিতে তিনি মনে করেন, উন্নয়নই দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার কাজে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। দুদেশের যোগাযোগ যত বাড়বে, পারস্পরিক আস্থাও তত বাড়বে। সেই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতেই একগুচ্ছ পদক্ষেপ করবে দিল্লি। আর যোগাযোগ বাড়াতে কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে আগরতলা পর্যন্ত তৈরি হয়েছে নতুন বাসরুট। মিলেছে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা সরকারের সহযোগিতাও। শনিবারের মন্ত্রিসভায় ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে জাহাজ পরিবহনবিষয়ক একটি চুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সেই চুক্তি অনুসারে দুদেশের মধ্যে পণ্য পরিবহনের পথ আরও সুগম হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় যেখানে যেখানে চেকপোস্ট আছে, ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন আছে, সেখানে দ্রুত সড়ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ওই বৈঠকে। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশই ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী। ফলে এ চুক্তি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। শনিবার মানব পাচারবিরোধী এক বিশেষ মউ-এর খসড়াতেও অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। অপরাধ দমনের পাশাপাশি এ বিষয়টি নিয়ে দুদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায়ই যে গোলযোগ লেগে থাকে, তা-ও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্থলসীমা নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ছবিটি ঢাকায় সামনে তুলে ধরতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সফরসঙ্গী হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মোদি। মমতা ৫ তারিখ রাতেই কলকাতা থেকে ঢাকা পৌঁছচ্ছেন। শনিবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ওই খবর জানিয়ে বলেছেন, ‘ওখানে স্থলসীমান্ত চুক্তি সই এবং কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে আগরতলা বাসরুটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি উপস্থিত থাকবো।’ ৬ তারিখই ফিরছেন মমতা। মোদি ফিরবেন একদিন পরে, ৭ তারিখে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সূত্রে বলা হচ্ছে, দুদেশের মধ্যে স্থলসীমান্তের সবচেয়ে বড় অংশটি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। সেই কারণে মোদির এ সফরে মমতার সঙ্গী হওয়াটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, মোদির সঙ্গে হাসিনার বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি তোলা হবেই। তবে প্রকাশ্যে তিস্তা নিয়ে মোদি কোন কথা বলবেন না বলেই ঠিক হয়েছে। এমনকি কোন যৌথ বিবৃতিতেও তিস্তার উল্লেখ থাকবে না। কিন্তু গঙ্গা এবং তিস্তা ছাড়া আরও যে ৫৪টি নদীর জলবণ্টন ঘিরে দুদেশের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে, তার সবই খতিয়ে দেখার একটা আশ্বাস ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া হতে পারে। এ বিষয়গুলোকে যৌথ নদী কমিশনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টাও হতে পারে বলে সূত্রের খবর। তবে তিস্তাজট ছাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর তরফে উদ্যোগ যে নেয়া হবে, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। মনমোহন সিংয়ের জমানায় তিস্তা নিয়ে যে সমাধানসূত্রটি তৈরি করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল শুখা মওসুমে তিস্তায় যে পরিমাণ জল থাকবে, তা সমান ভাগে ভাগাভাগি হবে দুদেশে। যার মধ্যে আবার প্রত্যেক দেশ থেকেই চার ভাগ জল বরাদ্দ করা হবে নদী খাতে নাব্য বজায় রাখতে চার্জিংয়ের জন্য। কিন্তু মমতা এ প্রস্তাবে রাজি হননি। তার যুক্তি, শুখা মওসুমে তিস্তায় কার্যত জলই থাকে না। আর বর্ষার সময় বাংলাদেশ জল পায় প্রকৃতির নিয়মেই। তাই সমস্যা মূলত শুখা মওসুমেই। এদিকে সিকিম তিস্তায় প্রায় ৮টি হাইড্রোলিক বাঁধ তৈরি করেছে। মমতার আপত্তি রয়েছে এ নিয়েও। সিকিমের বক্তব্য, তারা জল আটকে বাঁধ দেয়নি। মমতা তবু দাবি করে আসছেন, সিকিমের এ দাবি যাচাই করার দায়িত্ব পুরোপুরি কেন্দ্রের। সূত্রের খবর, তিস্তা চুক্তি সম্ভব হলে ওই নদী সংস্কার এবং জল সরবরাহের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ পাওয়া যাবে। ফলে এখন তিস্তা প্রকল্পে ভারতের যে ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে জল যায়, ভবিষ্যতে তা ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সরবরাহ করা যেতে পারে। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্যের এ বিতর্ক এখনও মেটেনি। ফলে হাসিনা সরকারের থেকে মোদিকে আরও খানিকটা সময় নিতে হবে। তবু মোদির বাংলাদেশ সফরে মমতার সঙ্গে থাকাটা অনেক দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে দাবি করছেন কূটনীতিকদের একাংশ। মমতা নিজেই কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফর করে এসেছেন। জট না কাটলেও আলোচনা হয়েছে তিস্তা নিয়ে। তাই নরেন্দ্র মোদির পক্ষেও এ বার্তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে যে, তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে মনমোহন যা পারেননি, তিনি সেটা করতে পারছেন। অর্থাৎ মমতাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে এগোচ্ছেন। প্রচারে এটাও সাফল্য বলে দেখাতে পারবেন মোদি।
(আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা)

No comments

Powered by Blogger.