বেশ ফুরফুরে কাটল মোদির প্রথম বছর by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

মনে হচ্ছে এই সেদিন, অথচ দেখতে দেখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম বছরটা কেটে গেল। আগে বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান ঘটা করে হতো। আজকাল উদ্যাপনের হরেক রকম হেতুর খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রথম হইহল্লা প্রথম মাসপূর্তিতে, তারপর এক শ দিন অতিক্রান্ত হলে, এরপর ছয় মাস, তার পরে প্রথম বছর। এ সময় খুব ঘটা করে প্রচার চলে। সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে কাগজে-কাগজে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। করদাতাদের টাকায় সে এক এলাহি ব্যাপার। এবার অবশ্য নরেন্দ্র মোদি ঘটা করে কিছু করতে চাইছেন না। তবে সরকারের এক বছরের ‘সাফল্য’ তুলে ধরতে তিনি মন্ত্রী ও সাংসদদের নির্দেশ দিয়েছেন। দলও তাঁর মতো করে সক্রিয়।
প্রথম বছরটা কেমন কাটল, কতটা সাফল্য কতটা ব্যর্থতা, সব মহলেই শুরু হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি অবশ্য কটাক্ষ করে বলেছেন, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে এই সরকারের মেজাজ ঠিক টি-টোয়েন্টির মতো। প্রকল্প ঘোষণাতেও পিছিয়ে নেই। ওয়ান ডে ক্রিকেটের ঢঙে একটার পর একটা প্রকল্প ঘোষণা করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পগুলোর কার্যকর রূপায়ণের ক্ষেত্রে সরকার চলছে পরিত্যক্ত টেস্ট ম্যাচের মতো, ঢিমেতেতালায়। রাজনীতিকেরা তাঁদের মতোই সবকিছু রাজনীতির আলোয় দেখবেন। অতএব কংগ্রেসের বক্তব্য নিয়ে মন্তব্যের প্রয়োজন নেই। তবে জনতার মত যদি মাপকাঠি হয়, তাহলে সাম্প্রতিক এক জরিপের ফল অনুযায়ী দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ মনে করছেন নরেন্দ্র মোদির সরকার প্রথম বছরটা বেশ ভালোই চালিয়েছে।
মোদির শপথ গ্রহণের দিন সার্ক সদস্যভুক্ত আট দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা উপস্থিত ছিলেন। মোদি তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই আমন্ত্রণে আন্তরিকতা যেমন ছিল, তেমনি ছিল একটা বার্তাও। তা হলো, প্রতিবেশীদের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও ভালো করতে আগ্রহী। সেই আগ্রহ যে স্রেফ কথার কথা নয়, মোদি এই এক বছরে তার কিছুটা প্রমাণ রাখতে পেরেছেন। বিশেষ করে দলের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে শেষ মুহূর্তে যেভাবে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল সংসদের দুই কক্ষে সর্বসম্মতভাবে পাস করিয়েছেন, তা অভিনন্দনযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আজ উপদ্রবমুক্ত। এই প্রান্তের নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতকে আজ বহুদিন বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হচ্ছে না। শেখ হাসিনার এই দৃঢ়তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত মোদিও তাই সীমান্ত বিল বাস্তবায়নে বাড়তি রাস্তাটুকু হেঁটেছেন। মোদি ও হাসিনার মধ্যে অল্প দিনেই গড়ে উঠেছে সখ্য। রাজনীতির মতো কূটনীতিতেও ব্যক্তিগত রসায়ন অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে।
শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, এই এক বছরে মোদি এর প্রমাণ তাঁর বিদেশনীতির ছত্রে ছত্রে রেখেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং, জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবেসহ অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গেই তিনি ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে তুলেছেন। এই এক বছরে বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে মোদির যে দুটি পরিচয় স্পষ্ট হয়েছে, তার একটি হলো তিনি এক শক্তপোক্ত নেতা, অন্যটি হলো তাঁর স্থির লক্ষ্য। লক্ষ্য বা দৃষ্টিটা কী? ভারতকে তিনি অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করে তুলতে চান। এ কারণে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র যে স্লোগান তিনি দিয়েছেন, পশ্চিমা শক্তি তা উপেক্ষা করতে পারছে না। মোদির জন্যই ভারত সম্পর্কে তাঁদের মূল্যায়ন নতুনভাবে করতে হচ্ছে।
আঞ্চলিক স্তরে বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও মোদি বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। ভারতের বিশালত্ব এমনিতেই প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে সমীহ আদায়ে যথেষ্ট। কিন্তু অতীতে কখনো-সখনো কোনো কোনো ভারতীয় নীতি ছোট প্রতিবেশীদেরও ক্ষুব্ধ ও বিরূপ করেছে। নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওঠানামা তার প্রমাণ। ক্ষমতায় এসে ভারত সম্পর্কে সেই সন্দেহ ও সংশয়ের বেড়াটা মোদি ভাঙতে চেয়েছেন। নির্বাচনের পর শ্রীলঙ্কা-ভারত সম্পর্ক এখন অনেক সহজ, মালদ্বীপও এখন মোদিকে সেই দেশ সফরে আসতে অনুরোধ করছে। আর বাংলাদেশকে ভারত তো পরীক্ষিত সেরা মিত্র বলে মনে করছে। মোদি চাইছেন অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্য দিয়ে সবাইকে নিয়ে এগোতে, যাতে উপমহাদেশে শান্তি থাকে এবং ভারতীয় প্রাধান্য সম্পর্কে কেউ সন্দিহান না হয়।
এই এক বছরে মোদি মোট ১৮টি দেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশ হতে চলেছে উনিশতম দেশ। তার পরপরই তিনি যাবেন রাশিয়ায়। তাঁর এই ‘পায়ের তলায় সর্ষে’ থাকা নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতেও বেশ কথা চালাচালি হচ্ছে। রাহুল গান্ধী তো বলেই দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী বিদেশ ঘুরেই চলেছেন, অথচ ঋণগ্রস্ত আত্মঘাতী কৃষকদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সময় তাঁর নেই। মোদি এসব সমালোচনা কানে তুলছেন না। দেশনেতা থেকে তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক নেতায় উত্তরণ ঘটাচ্ছেন।
মোদির পক্ষে স্বস্তির কথা, সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অন্য কারও দিকে তাকানোর প্রয়োজন তাঁর নেই। কট্টর বিরোধীদের মন জেতা বা বশ করার ক্ষমতাও তাঁর রয়েছে এবং চমৎকারভাবে তিনি তা প্রয়োগও করছেন। উদাহরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিদেশনীতিতে এই এক বছরে মোদি যত নম্বর পাবেন, প্রায় তত নম্বরই তাঁর প্রাপ্য অর্থনীতির ক্ষেত্রেও। ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের আর্থিক বছরগুলোতে ভারতের অর্থনীতিতে সার্বিক যে হতাশা ছিল, এই এক বছরে তা কেটে গিয়ে নিঃসন্দেহে ফুরফুরে ভাব এসেছে। এতটাই যে আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলো ঘোষণা করেছে, ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার চীনকেও ছাপিয়ে যাবে। ফুরফুরে এই ভাবের পাশাপাশি মোদি আর একটা জিনিসও করেছেন। রাজনৈতিক, আমলাতন্ত্রসহ সরকারি স্তরে ঘুষের যে রমরমা ছিল, তা প্রায় শেষ করে দিয়েছেন। এই এক বছরে সরকারি স্তরে দুর্নীতির একটা অভিযোগও কেউ আনতে পারেনি। কয়লার ব্লক বণ্টন করা হয়েছে স্বচ্ছভাবে। সে জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এর ফলে সরকারের ওপর সাধারণের মধ্যে একটা আস্থার ভাব এসেছে। মোদি ক্ষমতায় আসার মাস দুয়েকের মধ্যেই দুর্নীতি-সংক্রান্ত একটা কাহিনি খুব চালু হয়েছিল। গল্পটা এ রকম, এক সিনিয়র মন্ত্রীর ছেলে নাকি ট্রান্সফার-পোস্টিংয়ে নাক গলিয়ে মোটা টাকা কামাচ্ছিলেন। মোদি সেই মন্ত্রীকে সপরিবারে একদিন দাওয়াত দেন। সেখানে বাবার সামনেই ছেলেকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে এসব কথা শোনা যাচ্ছে। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। অতএব, সাবধান হও! আর এক মন্ত্রী এক পাঁচতারা হোটেলে এক অতিপরিচিত শিল্পপতির সঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন। মোদি তাঁকেও ডেকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
অর্থনীতি আর যাই হোক, পোলট্রির ব্রয়লার মুরগির মতো নয় যে ঠিক ৪৫ দিনের মাথায় ডিম দেওয়া শুরু করবে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান রঘুরাম রাজন সম্প্রতি নিউইয়র্কে বলেছেন, মোদি সরকারের ওপর মানুষের চাহিদা ‘বাস্তবোচিত নয়’। অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় দিতে হবে। সেই সময়ের আগেই হলো–না হচ্ছে–না বলে চিল-চিৎকার করা ঠিক নয়। মুদ্রাস্ফীতি কমেছে, উৎপাদনশিল্প ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, কর্মসংস্থান ধীরে হলেও বাড়ছে, লগ্নিকারকেরা ভারতীয় বাজারের ওপর আস্থা রাখতে ভালোবাসছেন। এ সবই অর্থনীতির দিক থেকে সুলক্ষণ। প্রথম বছরে দুশ্চিন্তার একটা বড় ভার লাঘব করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম এবং রুপির শক্তিশালী হওয়া। এর ফলে কোষাগার ঘাটতি যেমন কমে গেছে, তেমনি কমেছে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতির সমস্যা। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে, তার জন্য মোদি ও তাঁর দলই দায়ী। নির্বাচনের সময় যে স্লোগান তাঁদের কোল ভরিয়ে দিয়েছে, সেই ‘আচ্ছে দিন আনে বালা হ্যায়’, কিংবা বিদেশে পাচার করা কালোটাকা দেশে ফিরিয়ে প্রত্যেকের ব্যাংকে ১৫-১৬ লাখ করে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেশের সাধারণ মানুষকে এমন একটা ধারণা দিয়েছিল, যেন মোদির হাতে এক জাদুদণ্ড রয়েছে, যার ছোঁয়ায় রাত পোহালেই সুদিন এসে দরজায় কড়া নাড়বে। ভারতের অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ এখনো নেই। তবে সবুর করতে হবে। সবুরেই মেওয়া ফলে।
ভর্তুকি সরাসরি উপভোক্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ফেলে অপচয় বন্ধে মনমোহন সিং যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, মোদি সেটাকেই নতুন মোড়কে ছেড়েছেন। জনধন প্রকল্প ও সবার জন্য ব্যাংক খাতা সারা দেশে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে। স্বচ্ছ ভারত অভিযান, গঙ্গা সংস্কারের মধ্য দিয়ে তিনি পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতনতাকে একটা আন্দোলনের রূপ দিতে চেয়েছেন। সফল হবেন কি না, সে জন্যও তাঁকে সময় দিতে হবে।
মোদিকে সমালোচনাবিদ্ধ হতে হচ্ছে সামাজিক ক্ষেত্রে। ‘ঘর ওয়াপসি’ অথবা সাম্প্রদায়িক অশান্তি বিষয়ে এই এক বছরে তিনি একবারের জন্যও মুখ খোলেননি। রাম জেঠমালানি, অরুণ শৌরির মতো দলীয় নেতারা সরাসরি তাঁর কাজের স্টাইল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নরেন্দ্র মোদি, অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও দলীয় সভাপতি অমিত শাহ ছাড়া বাকি সবাই ‘অকিঞ্চিৎকর’, এই অভিযোগ মোদির দল ও সরকারের মন্ত্রীরাই তুলছেন। মোদির মত ছাড়া কোনো মন্ত্রীরই ক্ষমতা নেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। ভালোর কৃতিত্ব যেমন মোদির ঝুলিতে জমা হচ্ছে, খারাপের দায়িত্বও তেমনি তাঁরই। বিকেন্দ্রীকরণের যুগে ক্ষমতার এই বাড়াবাড়ি রকমের কেন্দ্রীকরণ মোদিকে শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড় করাবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। এখনো পর্যন্ত ৬৮ শতাংশ মানুষ তাঁর পক্ষে আছেন ঠিকই, কিন্তু এ বছর ভরা বর্ষা না হলে (যে আশঙ্কা এখনো ভালোমতোই রয়েছে) স্রেফ মূল্যবৃদ্ধি মোদিকে হিরো থেকে ভিলেন করে দিতে পারে।
মোদির পক্ষে স্বস্তির কথা, সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অন্য কারও দিকে তাকানোর প্রয়োজন তাঁর নেই। কট্টর বিরোধীদের মন জেতা বা বশ করার ক্ষমতাও তাঁর রয়েছে এবং চমৎকারভাবে তিনি তা প্রয়োগও করছেন। উদাহরণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহির জন্যও তাঁর হাতে সময় রয়েছে আরও চারটি বছর। ভাগ্য এখনো তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছে। প্রথম বছরটা মোটের ওপর তাঁর ভালোই কাটল। কিন্তু একটা খরা অথবা বিহারে দলের ভরাডুবি ঘটলে অনেক দাঁত-নখ ঝপাঝপ বেরিয়ে পড়বে। ফুরফুরে ভাব কাটিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে তখন মোকাবিলা করতে হবে সংকটের।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.