নির্বাচন বন্ধ করতেই হবে by মামুন আহমেদ

বাংলাদেশ গণতন্ত্রের দেশ। দেশের সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা চায়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী কায়দায় এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। সরকার বিরোধী দলের ওপর যেভাবে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, তা কখনোই গণতন্ত্রের ভাষা হতে পারে না। আজকে দেশ যে সংকটে তার জন্য বিরোধী দল নয়, বরং দায়ী সরকার। সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন নির্বাচন। সরকার একটা প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে_ এই মীমাংসিত বিষয় বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজ স্বার্থে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা জেদ ধরে আছে। কেবল প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটই নয়, গোটা দুনিয়া এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে। একতরফাভাবে, স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে যখন আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে যাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই সবাই এর বিরোধিতা করবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, এই নির্বাচন নিয়ে কেউ কথা বলতে গেলেই তাকে ঘায়েল করছে আওয়ামী লীগ।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সব মানুষের অংশগ্রহণেই কেবল একটি নির্বাচন হতে পারে। অথচ এ নির্বাচনে কী দেখলাম? আমরা দেখলাম নির্বাচনের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে গেছেন। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের এই একতরফা একগুঁয়েমিপূর্ণ নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে বিরোধী দল। কিন্তু সরকার বিরোধী দলকে আন্দোলনের কোনো রকম সুযোগ দিচ্ছে না। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে যোগ দিতে তারা পদে পদে বাধা দিয়েছে। সরকারের একতরফা এ কর্মকাণ্ডে সংকট তো বাড়ছেই। একই সঙ্গে ব্যাহত হচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।
সবাই জানেন, এ সংকট উত্তরণে এবং গণতন্ত্র রক্ষায় বিরোধীদলীয় নেতা ঘোষণা করেছিলেন মার্চ ফর ডেমোক্রেসি। বিরোধী দলের মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি বা গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা একটি সম্পূর্ণ অহিংস কর্মসূচি। যেখানে বিরোধীদলীয় নেতা দেশের সর্বস্তরের মানুষকে লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে ঢাকায় মার্চ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিরোধীদলীয় নেতার এই কর্মসূচিতে জনগণ আসবে কি-না সেটা তাদের বিষয়। কিন্তু এই অহিংস কর্মসূচি বন্ধে সরকার যা করেছে তাকে স্বৈরতন্ত্র ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! সরকার তার দলীয় ক্যাডার বাহিনী ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে সারাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এ সমাবেশে যাতে কেউ আসতে না পারে সে জন্য সরকার এক অঘোষিত কারফিউ জারি করেছে। সংবাদপত্রগুলো যাকে বলছে সরকারি অবরোধ। অতি প্রয়োজনেও কাউকে পরপর কয়েক দিন ঢাকা আসতে দেওয়া হয়নি।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, একই কর্মসূচিতে যখন পেশাজীবী শিক্ষক-আইনজীবী-সাংবাদিক সমাজ একাত্মতা ঘোষণা করতে যাচ্ছিল, তখন তাদের ওপর পুলিশের সামনেই আওয়ামী গুণ্ডা বাহিনী দিয়ে হামলা চালানো হয়। এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। শুধু তাই নয়, তারা সুপ্রিম কোর্ট ও প্রেস ক্লাবের মতো জায়গায় ঢুকে হামলা চালিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সবাই সে দৃশ্য দেখেছেন। দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এটি এক নজিরবিহীন ঘটনা। এর সঙ্গে যারা জড়িত, অবিলম্বে তাদের শনাক্ত করে যথাযথ শাস্তি প্রদানের আহ্বান জানাই।
অবশ্য এ সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ আমরা অনেক আগে থেকেই প্রত্যক্ষ করছি। তারা যেন কার্যত সব বিরোধী মত সমূলে বিনাশ করতে চায়। বিরোধী দলের কার্যালয় দিনের পর দিন অবরুদ্ধ করে রাখা, বিরোধী দলের নেতাকে অবরুদ্ধ রাখাই যার বড় প্রমাণ। অথচ খালেদা জিয়া বর্তমানে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। সেই নেতার বাড়ি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে, ট্রাকভর্তি বালি দিয়ে যেভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, যেভাবে তাকে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী কায়দায় সমাবেশে যাওয়ার জন্য বাধা সৃষ্টি করেছে, তার প্রতিবাদের ভাষা আমাদের জানা নেই।
আমরা কখনোই সহিংসতা চাই না। পুড়িয়ে মানুষ হত্যা আমরা মেনে নিতে পারি না। রাজনৈতিক কর্মসূচি সবসময় অহিংস হোক তা-ই চাই। এটা সব মানুষেরই প্রত্যাশা। মানুষ স্থিতিশীলতা চায়, গণতন্ত্রের সুফল পেতে চায়। জনমানুষের সে আকাঙ্ক্ষা পূরণে সর্বোপরি দেশের বর্তমান সংকটের এখন একমাত্র সমাধান হলো ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করা। নির্বাচন বন্ধ করে, পুনরায় তফসিল ঘোষণা করে, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দিতে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সরকার যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা চায়, তাহলে অবশ্যই তা করতে হবে। অন্যথায় বর্তমান অস্থিতিশীলতায় দেশের ও মানুষের ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।
ড. মামুন আহমেদ :অধ্যাপক
প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ও সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষক সমিতি

No comments

Powered by Blogger.