রাজনৈতিক বিরোধ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি by ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদ

এবারের বছর শুরুতে অর্থনীতি নিয়ে ইতিবাচক ভাবনার সুযোগ খুব নেই, বিশেষত স্বল্প মেয়াদের সম্ভাবনা নিয়ে। দেশের রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অর্থনীতিও। চলমান রাজনৈতিক সংকটের কী করে রাত-দিনে সমাধান হবে। সে সম্বন্ধে বিবদমান দুই পক্ষের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন তাদেরও কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। তাদের তৈরি সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিকে যে কত বড় মূল্য দিতে হতে পারে, সে সম্বন্ধে তাদের তেমন ভাবনা-চিন্তা আছে বলেও দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতির সাময়িক ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই। তবে বিগত প্রায় দুই দশকের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কতখানি ঝুঁকির মুখে যাচ্ছে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত প্রায় দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের নানা সূচকের বিচারে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশ বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। দারিদ্র্যের হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। জনসংখ্যার গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার, সক্ষম দম্পতিদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকেও অনেক পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের এ অর্জন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একটা কারণে_ বাংলাদেশ শুধু যে একটি মুসলিম প্রধান দেশ তাই নয়, এটি উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত এমন একটি অঞ্চলের অংশ_ যেখানে রয়েছে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। এ কারণেই বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোর এ অগ্রগতিকে একটি 'উন্নয়নের বিস্ময়' বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর পেছনে কাজ করেছে জনগণের উন্নয়ন সচেতনতা, গোত্র-বর্ণের ভেদাভেদহীন সমাজ এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর নানা কার্যকর কর্মসূচি ও সামাজিক উদ্যোগ। এর মাধ্যমে নানা ধর্মীয় গোঁড়ামিকেও ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। এখন ধর্মের নতুন করে রাজনীতিকরণ বাংলাদেশের এ নীরব সামাজিক বিপ্লবকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। নব্বইয়ের দশক থেকে যে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এ পর্যন্ত আমরা টিকিয়ে রাখতে পেরেছি_ আর্থসামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে তারও একটা ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, দুর্নীতি, দলীয়করণ ও স্বেচ্ছাচারিতা অর্থনৈতিক সুশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তা সত্ত্বেও নব্বই-পরবর্তী প্রতিটি সরকারকে মেয়াদান্তে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। দুর্নীতি ও অপশাসনের একটা অলিখিত সীমারেখা অতিক্রম করার কারণে জনগণ প্রতিবার ক্ষমতাসীন সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে নিজেরা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন; কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছুটা হলেও জনকল্যাণ সাধনের তাগিদ অনুভব করেছেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবীদ অমর্ত্য সেনের মতে, 'গণতন্ত্রে দারিদ্র্য নিরসন করা না গেলেও বড় ধরনের খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ হয় না।' বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে শুধু খাদ্য নিরাপত্তারই উন্নতি হয়নি, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মৌসুমি খাদ্যাভাব বা মঙ্গার সমস্যারও অনেকাংশেই নিরসন হয়েছে। নাগরিক সমাজ ও স্বাধীন গণমাধ্যম এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করে সরকারকে জবাবদিহি করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারেরও কৃতিত্ব আছে। এর আগের জাতীয় নির্বাচনগুলো ঘিরেও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল এবং তাতে অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয় তাতে টানা হরতালের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দুই মাস কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। তা কাটিয়ে উঠতে পরবর্তী সময় অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। তবে নানা কারণে এবারের রাজনৈতিক সংকটের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতি আরও অনেক ব্যাপক ও গভীর হওয়ার আশঙ্কা আছে। অতীতের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির আকাশ যেমন বড় হয়েছে, তেমনি বিশ্ববাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ততাও অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন খাতের উৎপাদনের মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। এর ফলে পণ্য উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও জাহাজীকরণ_ এসব কিছু নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল রাখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এর কোথাও বিঘ্ন ঘটলে একাধিক খাতের ক্ষতির বোঝা পুঞ্জীভূত হয়ে অর্থনীতির ওপর বড় আঘাত আসতে পারে। চলমান সহিংস রাজনৈতিক বিরোধের ফলে তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন। লক্ষণীয়, অবরোধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু সম্ভাব্য রাজনৈতিক বিরোধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত সূচকগুলোর অবনতি শুরু হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের হিসাব থেকে দেখা যায়, বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার। বিদেশি বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স প্রবাহ_ সবই নিম্নমুখী। রফতানির প্রবৃদ্ধি এখনও ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও এর ওপর বিলম্বিত প্রভাব পড়বে। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প এমনিতেই বিশ্বজুড়ে ভাবমূর্তির সংকটে আছে, তার ওপর আছে শ্রমিক অসন্তোষ। যুক্তরাষ্ট্র সে দেশের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য শর্ত বেঁধে দিয়েছে। আরও আশঙ্কার বিষয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নও আমাদের পোশাক রফতানির শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিলের বিষয়ে বিবেচনা করছে। এ মুহূর্তে আমাদের দরকার শক্তিশালী অর্থনৈতিক কূটনীতি, কিন্তু দেশে শক্ত গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া তা সম্ভব নয়। এবারের সংঘাতময় রাজনৈতিক সংঘাতের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো_ এটা ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়ে ছোট ছোট শহরে ও গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ দুটোই বিঘি্নত হচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হলো যে, বাজার ব্যবস্থার প্রচলিত কাঠামো দিয়ে এটি তেমন নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং এর ভিত্তিগুলো সামাজিক অনুশাসন ও ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ব্যক্তিগত আস্থার সম্পর্ক। অর্থনীতির ভাষায় এটা হলো এক ধরনের সামাজিক মূলধন_ যা গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়া সহিংস রাজনৈতিক বিরোধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা হলো, গোত্র-বর্ণ দ্বারা বিভাজিত সমাজে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, আমাদের সমাজের রাজনৈতিক বিভাজন এখন গোত্র-বর্ণের বিরোধের পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছেছে।
গত দুই দশকের আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অন্ততপক্ষে একটা চলনসই গণতন্ত্র হলেই চলে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই ক্রমে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তবে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির নূ্যনতম ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই এখন আশু জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষ শুরুতে এটিই এখন জাতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ, অর্থনীতি ও রাজনীতি দুই ক্ষেত্রেই। হ লেখক
অর্থনীতিবিদ
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.