জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব by এম মনিরুজ্জামান মিঞা

কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে সরকারের পরিবর্তন হবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুই প্রধান দল [১] আওয়ামী লীগ ও [২] বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। প্রকৃতপক্ষে উভয় দলের মধ্যে এ দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে_ তার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। দ্বন্দ্বের ধরন বোঝার জন্য আমাদের কিছুটা পেছনের দিকে তাকাতে হবে। ১৯৯৬ সাল ছিল ওই সময়ে বিএনপি সরকারের শেষ বছর। ওই সময়ে সুযোগ বুঝে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন আরম্ভ করে, যা ১৯৯৬ সালের শেষাংশে চরমে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি সরকারের পাঁচ বছরে ১৭৩ দিন হরতালের শেষ পর্যায়ে সব কিছুই বন্ধ ছিল। বলা চলে দেশ প্রায় অচল ছিল। আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর যারা যুক্ত ছিল তারা হলো জামায়াতে ইসলামী, যাদের সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হয়েছে এবং কারও কারও প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরও যারা এ আন্দোলনে যুক্ত ছিল তারা হলো জাতীয় পার্টি, যে দলের প্রধানকে আন্দোলনকারী দল আওয়ামী লীগ প্রায়ই স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করে।
আমাদের রাজনীতির টানাপড়েন কীভাবে ঘটেছে তা বুঝবার জন্য একটু পেছনে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ১৯৯০ সালে যখন এরশাদ সাহেব রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনও একসঙ্গে আন্দোলন করে। প্রচণ্ড আন্দোলনের ধাক্কায় জেনারেল এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে, কে হবেন রাষ্ট্রপ্রধান। আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আন্দোলনকারী সব দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেন। নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন খালেদা জিয়া। এ নির্বাচনে জনগণের রায় তার প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ভালোভাবে মেনে নেয়নি। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এমন কথাও উচ্চারণ করলেন যে, তিনি নতুন সরকারকে একদিনের জন্যও শান্ত পরিবেশে কার্য সম্পাদন করতে দেবেন না। তিনি করেছিলেনও তাই। প্রথম থেকেই তিনি বিভিন্ন দাবিদাওয়া উত্থাপন করে সরকারকে সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে রাখলেন। দাবিদাওয়া শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল একটি দাবিতে। আওয়ামী লীগ প্রধান দাবি করলেন, বিএনপি সরকারের কার্যকাল শেষে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন হতে হবে। আর এর জন্য সাংবিধানিক প্রয়োজন ছিল দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন। কিন্তু তা যাতে বিএনপি সরকার না করতে পারে সেজন্য ৩০০ সংসদীয় সদস্যের মধ্যে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্ট ও জামায়াতের সর্বমোট ১৪৯ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলেন। বিএনপি সরকার কোনো উপায়ান্তর না দেখে সংসদ অধিবেশন আহ্বান করে বিরোদীদলের চাহিদা মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় বিল সংসদে আনলেন। বিল পাসও হলো। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিক বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পদত্যাগপত্র দাখিল করলেন এবং রাষ্ট্রপতিকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দান ও সরকার গঠনের অনুরোধ জানালেন। সে মোতাবেক এবং বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নতুন সরকার গঠিত হলো। এ সময় রাস্তায় দণ্ডায়মান অসংখ্য মানুষ করতালি দিয়ে তার কাজের প্রশংসা জানালেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলতে চাইল_ যেহেতু ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে অতএব এর প্রয়োগ অবৈধ। তবে বিষয়টির ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। বিচারপতি খায়রুল হক এ কথা বলেছিলেন যে, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু তিনি তা বাতিল করতে বলেননি, বলেছিলেন আগামী দিনের কোনো এক সময়ে বাতিল বলে গণ্য করতে হবে। বরং তিনি বলেছিলেন, দশম ও একাদশ সংসদীয় নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসারে হতে পারে।
বিচারপতি খায়রুল হক এ রায় দেওয়ার পর ২০১১ সালের ১০ মে একটি পূর্ণাঙ্গ রায় জমা দেন। এর পরবর্তী পর্যায়ে বিচারপতি আর একটি রায় দেন ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে কোনো কোনো বিচারপতি মন্তব্য করেন, বিচারপতি খায়রুল হকের ওই পদে অবস্থানের আর যোগ্যতা নেই, কেননা ওই সময়ে তিনি আর সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক ছিলেন না। তাই বিচারক হিসেবে তার শপথও ছিল না। অতএব তার সর্বশেষ রায়ের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংবিধান সংশোধন করা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এই হচ্ছে আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, যার ভিত্তিতে সংবিধানের মতো পবিত্র দলিলটিও কাটা-ছেঁড়া করা হলো। কিন্তু কেন এমন করা হলো? অনেকের মতে নির্বাচনের সঙ্গে কোনো না কোনো কার্য সম্পাদন করবেন যারা, তাদের মধ্যে অনেকে সরকারি মতাদর্শে দীক্ষিত। ড. কামাল হোসেনের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এরূপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তার ফলাফল কী হতে পারে তা অনুমেয়। সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলের মতাদর্শের সংঘর্ষ এখানেই। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, আগামী ৫ জানুয়ারি নাকি শেখ হাসিনা হবেন নির্বাচনকালীন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সে নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। এ কথা ওই পক্ষ দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছে। আমরা জানি না, কী আছে এ জাতির ভবিষ্যতে? সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে আমাদের সাধারণ জ্ঞানে বুঝি_ কেন বর্তমান সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন চান না তা অনেকটা স্পষ্ট। এদিকে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া বারবার নির্বাচন নিয়ে অপর পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি, যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দোষারোপ করা হয়েছে বিএনপিকে। কিন্তু তা যে হলাহল মিথ্যা তা জানা গেল, যখন জাতিসংঘ প্রেরিত তারানকো কোনো সুরাহা না করতে পেরে ওয়াশিংটন ফিরে গেলেন, তার দিন কয়েকের মধ্যে জাতিসংঘের ঢাকা অফিস থেকে জানানো হয়েছে_ সরকার সংলাপ চায় না বলে জাতিসংঘের উদ্যোগ থেমে গেছে এবং জাতিসংঘ প্রেরিত দূত তারানকো স্বদেশ ফিরে গেছেন, তা ছাড়া আরও বলা হয়েছে, সরকার সংলাপ চায় না বলে জাতিসংঘের উদ্যোগ থেমে গেছে।
এ মুহূর্তে আমরা অনুমান করতে অপারগ কী হতে পারে পরবর্তী পর্যায়ে? 
লেখক
শিক্ষাবিদ
প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.