শহীদ মিনার ভাঙতে দেখেছি by অধ্যাপক এম শামসুর রহমান

পাকিস্তানের একমাত্র স্নাতকোত্তর ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় বছর শিক্ষকতার পাট চুকিয়ে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকায় এলাম। পরদিন ১৯৭০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগদান করি। প্রসঙ্গত, আমি ছাড়াও ইসলামাবাদে তখন অধ্যাপনা করতেন (বাঙালি) এএম হারুন অর রশিদ (পদার্থবিজ্ঞান), আনিসুর রহমান (অর্থনীতি), সুনামউদ্দিন মলি্লক (রসায়ন)। কর্মকর্তা ছিলেন রেজিস্ট্রার এমএ বাতেন। গ্রন্থাগারিক এম ওয়াহিদুজ্জামান।
চানখাঁরপুল এলাকায় ৪নং রশিদ বিল্ডিংয়ে বড় ভাইয়ের বাসায় উঠেছি। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেন স্বীয় বাসভূমিতে আসতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ওদিকে ভুট্টোর তলোয়ারের ঝনঝনানি, এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নৌকার জয়ধ্বনিতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
ক'দিন বাদেই ডিসেম্বর পেরিয়ে শুরু হলো ১৯৭১। মার্চ থেকে ছড়িয়ে পড়ল অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ নিবিষ্ট চিত্তে শুনলাম রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ।
পত্রপত্রিকা থেকে জেনেছি, ব্রিটিশ আমলে জালিয়ানওয়ালাবাগে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ যেমন 'স্যার' উপাধি বর্জন করেছিলেন, কিছু স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব তথাকথিত পশ্চিম পাকিস্তানের দুঃশাসনের প্রতিবাদে এখানেও তেমনি পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন 'খেতাব' প্রত্যাখ্যান করেন। দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত রাখায় তাদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ২৫ মার্চ মর্নিং নিউজে ঊহঁহপরধঃরড়হ ড়ভ ঞধমযসধং শীর্ষক আমি একটি চিঠি প্রকাশ করি। ২৫ মার্চের কালরাতে ভাইয়ের বাসা থেকে গোলাগুলির তাণ্ডবলীলা শুনে প্রায় অনিদ্রায় রাত কাটাই। জগন্নাথ হলসহ ঢাকার অন্যান্য স্থানে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী যে বীভৎস ধ্বংসলীলা চালায়, তা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমাদের ছাত্র আজিম, রণদার নিথর দেহ পড়ে রয়েছে সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল চত্বরে। রশিদ বিল্ডিংয়ের অনতিদূরে শহীদুল্লাহ হলের সম্প্রসারিত এক কক্ষে অবস্থানরত গণিত শিক্ষক শরাফত আলী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শেলের আঘাতে ২৬ মার্চ আলোছায়া-মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন অনন্তের কল্যাণলোকে। '৭২-এর ২৬ মার্চ প্রথম শাহাদাতবার্ষিকীতে ঝযধযববফ ঝধৎধভধঃ অষর : অ ঞৎরনঁঃব শীর্ষক আমার লেখা বের হয়েছে সেদিন মর্নিং নিউজে। শহীদদের নিয়ে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত 'স্মরণিকা'য়ও শরাফত আলী সম্পর্কে আমার লেখা রয়েছে।
রশিদ বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে চুপি চুপি দেখেছি, কীভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হলো! উত্তর পাশের দেয়ালে আরবিতে লেখা হয়েছে :লা-ইলাহা...রাসূলাল্লাহ। ঐড় িঝযধযরফ গরহধৎ ধিং ফবসড়ষরংযবফ শিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আমার বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি '৭২ সংখ্যায়।
একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান অকুতোভয় শিক্ষাবিদ হবিবর রহমানকে কদর্য পাকিস্তানি সেনারা নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। জগন্নাথ কলেজের গণিত শিক্ষক ড. আবুল কালাম আজাদও ১৪ ডিসেম্বর আলবদর-আলশামস-রাজাকারদের চরম হিংস্রতা থেকে রেহাই পাননি। রেহাই পাননি রাজশাহী কলেজের গণিত শিক্ষক ফজলুল হকও।
আমার অনুজ মো. সাহিদুর রহমান (নওগাঁর তুলাপট্টি জনতা ব্যাংক শাখার অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসার) একজন মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী মো. আবদুল জলিলের অধীনে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে সে। প্রয়াত আবদুল জলিল আমার অনুজপ্রতিম। আমরা দু'জনেই নওগাঁর বাসিন্দা। নওগাঁ কেডি স্কুলের ছাত্র।
১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান নিয়াজির আত্মসমর্পণ প্রত্যক্ষ করলাম। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে জয় বাংলা স্লোগানে মুক্তির দল ও জনতা আনন্দ-উল্লাসে বিশ্বের মানচিত্রে নবঅভ্যুদিত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলল। নতুন দেশে নতুন আবহে আমি নতুন করে অনুধাবন করলাম ডিসেম্বর_ বিজয়ের ডিসেম্বর।
সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ফেলো, ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশন

No comments

Powered by Blogger.