প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক-‘শেয়ারবাজার কোন পথে’

১৯ জানুয়ারি প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘শেয়ারবাজার কোন পথে’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো। যাঁরা অংশ নিলেন এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম


সাবেক অর্থ উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং সাবেক চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সাবেক উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী
সাবেক চেয়ারম্যান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)
অধ্যাপক আবু আহমেদ
অর্থনীতিবিদ
সালাহউদ্দিন আহমেদ খান
সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও অধ্যাপক ফাইন্যান্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শাকিল রিজভী
সভাপতি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)
শেখ মর্তুজা আহমেদ
সভাপতি, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন
শওকত হোসেন: যুগ্ম বার্তা ও বাণিজ্য সম্পাদক, প্রথম আলো
সূচনা বক্তব্য
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
মতিউর রহমান
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা এ ধরনের আলোচনার আয়োজন করে থাকি। এর ফলে মানুষের কাছে কিছু বলা কিংবা এসব বিষয়ে তাদের সচেতন করে তোলা যায়।
আমাদের আজকের গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম দিয়েছি ‘শেয়ারবাজার কোন পথে’। শেয়ারবাজারের এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আমাদের সবারই জানা প্রয়োজন, কোন পথে যাচ্ছে শেয়ারবাজার। অনেক দিন ধরেই বাজার স্বাভাবিক আচরণ করছিল না। বাজারে ভালো ও নতুন শেয়ারের সরবরাহ ছিল কম, অথচ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। এ কারণে বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে। আবার এই বাজার থেকে যেকোনো উপায়ে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনার কথাও শুনি আমরা।
আমরা একটা স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল শেয়ারবাজার চাই। এক দিনে সূচক ৬০০ পয়েন্ট কমে যাওয়া যেমন স্বাভাবিক নয়, আবার একদিনে এক হাজার পয়েন্ট বেড়ে যাওয়াও স্বাভাবিক নয়। সুতরাং এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, শেয়ারবাজার কোন পথে এবং সঠিক পথে আনতে হলে কী করতে হবে। শেয়ারবাজারের এই অস্বাভাবিক আচরণে হঠাৎ হঠাৎ লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
শেয়ারবাজারকে সঠিক পথে আনতে বা এটি যেন সত্যিকার অর্থে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করে এবং সাধারণ, মধ্যবিত্ত বা যেকোনো বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা করে, সে জন্য কী করা প্রয়োজন? আপনারা যাঁরা বিশ্লেষক আছেন, তাঁদের পরামর্শ কী? সেগুলো দেশবাসীকে জানানোর মাধ্যমে তাদের সচেতন করতে পারি। এটিই আজকের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য।
এমন নয় যে শেয়ারবাজারের পতন এবারই আমরা প্রথম দেখলাম। ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারির কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। মামলা-মোকদ্দমা ও জামিন হলো, কিন্তু তিনটি সরকার চলে গেলেও সেই ঘটনার এখনো বিচার হয়নি। ফলে বাজারে যা ইচ্ছা করে পার পাওয়া যাবে, এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েই আছে। এ অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কতটুকু সম্ভব, সে প্রশ্ন থেকেই যাবে। ১৯৯৬ সালে যাঁরা দায়ী বলে অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে কথা বলতে হবে। এসব চিহ্নিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তির মুখোমুখি করার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
বাজার কারও নিয়ন্ত্রণে নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। আস্থা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। অথচ শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা ফেরানো জরুরি। কেননা এর সঙ্গে কেবল অর্থনীতিই জড়িত নয়, ৩৩ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী যুক্ত হয়েছেন শেয়ারবাজারের সঙ্গে। এর মধ্যে অনেক মধ্যবিত্ত ও সাধারণ লোকও যুক্ত হয়ে পড়েছেন। সুতরাং এর সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিও জড়িত হয়ে পড়েছে।
দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সরকার, বিরোধী দল—সবাইকে নিয়েই দেশ। আমরাও এর মধ্যে আছি। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বক্তব্য, আলোচনা, উদ্যাপন শুরু করেছি। আমরা জানি, গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের অনেক অনেক অর্জন রয়েছে। আবার অনেক সমস্যা আমরা নিজেরা সৃষ্টি করেছি। অনেক সমস্যা বৃদ্ধি করে চলছি। আমরা সাধারণভাবেই বুঝি, রাজনৈতিক সরকার বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সংসদকে কার্যকর করা যদি না হয়, তাহলে শুধু একটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি, অন্য ক্ষেত্রে অধোগতি—এ রকম হয়তো হতে থাকবে। সেসব বিষয়ে আমাদের পাঠকদের জন্য আপনারা কিছু বলবেন আজকের আলোচনায়। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আলোচনায় উপস্থিত হওয়ার জন্য। আলোচনার শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আজকে এ ধরনের একটি আলোচনা আয়োজনের জন্য। আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পরিপ্রেক্ষিতে যে সম্প্রতি শেয়ারবাজার আবারও অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আমি এই শেয়ারবাজারের সঙ্গে একসময় সম্পৃক্ত ছিলাম। বর্তমানে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে শেয়ারবাজারে, তা বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের সাম্প্রতিক অতীত ইতিহাসের দিকে লক্ষ করতে হবে। সে ইতিহাসটি হচ্ছে, প্রায় দুই বছর ধরে বাজারের সূচক ক্রমশই ঊর্ধ্বগতির দিকে এবং তা বেশ ত্বরিত গতিতেই এগিয়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ইনডেক্স বা সূচক ছিল দুই হাজার ৭৯৫; ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে এটি দাঁড়িয়েছিল চার হাজার ৫৩৫ এবং ২০১০ সালের শেষে এসে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২৯০। পরবর্তী সময় এক দিনে ৯ জানুয়ারি ২০১১ সালে সূচকের প্রায় ৬০০ পয়েন্ট পতন ঘটে। সেদিন সূচক নেমেছিল সাত হাজার ১৩৫। তার পরের দিনও প্রায় ৬০০ পয়েন্ট সূচকের পতন ঘটে দাঁড়িয়েছিল ছয় হাজার ৪৯৯। এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তার পরদিন প্রায় এক হাজার পয়েন্ট বেড়েছে।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ সূচক উঠেছিল আট হাজার ৯১৮ পর্যন্ত। এই যে ঊর্ধ্বগতিটি ছিল, তার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের সংযোগ ছিল বলে আমি মনে করি। এর মধ্যে সরকারি যে সঞ্চয়পত্রগুলো ছিল, তার ওপর করারোপ করা বা ফিক্সড ডিপোজিট ও সেভিং ডিপোজিটের ওপর ব্যাংকগুলোর সুদের হার কমানো উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটালের ওপর ট্যাক্স দেওয়ার যে প্রস্তাব ছিল, বাজেটে তা পরে তুলে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রচুর নতুন বিনিয়োগকারী এসেছেন শেয়ারবাজারে। এঁরা হচ্ছেন তথাকথিত বিনিয়োগকারী, যাঁদের উদ্দেশ্য হলো, ‘আমি আজকে বাজারে ঢুকব এবং দুই দিন পর একটা বিরাট অঙ্কের টাকা লাভ করব।’ এটিকে সহায়তা করেছে স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকার হাউসগুলো, যাদের প্রায় ২৭০টি শাখা অফিস বেড়েছে গত এক বছরে। মোট ৬১৩টি ব্রোকার হাউস রয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেসব বিনিয়োগকারী স্টক মার্কেটে এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই বিনিয়োগের ঝুঁকি বা কী সূচকের ভিত্তিতে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করা দরকার, সে সম্পর্কে ধারণা নেই। সব মিলিয়ে একটা হার্ড ‘বিহেভিয়ার’ সৃষ্টি হয়েছে। কিছু লোক শেয়ার কিনতে শুরু করলেন, দেখা গেল তাঁরা লাভ করেছেন। তখন সবাই কিনতে শুরু করলেন। পরে একটা পর্যায়ে গিয়ে তাঁরা বুঝবেন, আমি যে দামে কিনেছি, তার চেয়ে বেশি দাম হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, যে মূল্য দিয়ে যে কোম্পানির শেয়ার কেনা হয়েছে, তার ফান্ডামেন্টালের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এর ফলে যে পতনটি হয়েছে, সেটি মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। আমরা যাঁরা বিশ্লেষক আছি, তাঁরা সবাই বলেছি, বাজার অতিরিক্ত মূল্যায়িত হয়েছে। ফলে একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দেননি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করেছে। কিন্তু বাজার যে পরিস্থিতিতে পৌঁছে গিয়েছিল, সেখানে তারাও কিছুটা দায়ী ছিল। তাদের দিয়ে জোর করে শেয়ার ধরে রাখার মতো খুব বেশি যৌক্তিকতা ছিল না। তারা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবে, যে দামে তারা শেয়ার কিনেছে, তা ধরে রাখলে তাদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে, ফলে তারাও বিক্রি করেছে।
নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিশেষ করে, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ছিল দ্বিধান্বিত বা বিপরীতমুখী। যখন শেয়ারবাজারের সূচক বাড়ছিল, তখন এসইসি কিছু রক্ষণাত্মক সিদ্ধান্ত নিল। যেমন—মার্জিন কমাল, ইনডিভিজুয়্যাল (ব্যক্তিগত) ক্রেডিট লিমিট কমাল বা মার্চেন্ট ব্যাংকারদের ক্রেডিট লিমিট কমিয়ে দেওয়া হলো। আবার যখন বাজারের দরপতন হলো, তখন এসব সিদ্ধান্ত শিথিল করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংক একপর্যায়ে বলল, ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার বেশি হয়ে গেছে স্টক মার্কেটে এবং শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। সুতরাং ১০ শতাংশ যে সীমা আছে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে, ব্যাংকগুলো ক্যাপিটাল মার্কেটে তাদের দায়ের মোট ১০ শতাংশের বেশি এক্সপোজ করতে পারবে না। সেটির ব্যাপারে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলোকে রিপোর্ট করতে বলল বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বাজারে খবর গেল যে ব্যাংকগুলোকে তাদের ব্যালেন্স সমন্বয় করতে বলা হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। কিন্তু পরবর্তী সময় বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, তারা শুধু রিপোর্ট করতে বলেছে। কিন্তু রিপোর্ট করার পর একটা সময় অবশ্যই হিসাবের সমন্বয় করতে হবে, তা না হলে তো রিপোর্ট করার কোনো উদ্দেশ্য হয় না। এ কারণে শেয়ারবাজারে একটি শঙ্কা সৃষ্টি হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো খুব একটা বড় রকম বিপরীত নীতি অনুসরণ করবে। আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক ক্যাশ রিজার্ভ রিকয়ারমেন্ট (বিধিবদ্ধ জমার নগদ অংশ-সিআরআর) ৫ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ৬ করেছে। এর ফলে একটি সতর্কবার্তা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে। সেটি গাণিতিক দিক থেকে দেখলে এর কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয় শেয়ারবাজারে। কারণ এই ৫ দশমিক ৫ থেকে ৬ করার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো মপ-আপ করেছে, আবার এক দিন পর সাত হাজার কোটি টাকা রেপো করে তারা মার্কেটে ইনজেক্ট করেছে। সুতরাং অঙ্কের দিক থেকে কোনো প্রভাব না থাকলেও সতর্কবার্তা হিসেবে প্রভাব পড়ছে শেয়ারবাজারে।
শেয়ারবাজারে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য একটি খারাপ সংকেত হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো বাজার ধরে রাখার দায়িত্ব নিচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মূল দায়িত্ব নয়। তাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে, বাজার যেন সুচারুভাবে পরিচালিত হয়, সেটা দেখা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা বা নীতিমালা প্রণয়ন করা। ব্রোকারদের মার্জিন পেমেন্ট, যেটির সীমা ছিল পাঁচ কোটি টাকা। এটা বাড়িয়ে ১৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। এসব করার ফলে বাজারে একটি বার্তা যাচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো সূচক ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এর ফলে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা জাগে যে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ, কাল আবার কী হবে, তা তাঁরা তো জানেন না। দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু বিনিয়োগকারীকে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের দিকে উৎসাহিত করে। কারণ, তাঁদের মধ্যে যদি এ ধারণাটি জন্মে যে যদি সূচক কমেও, তবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো তা ঠেকানোর জন্য পদক্ষেপ নেবে। ফলে অর্থনীতির ভাষায় এ ধরনের পরিস্থিতিকে ‘মোরাল হেজার্ড’ বলা হয়। সে ধরনের পরিস্থিতি আমাদের শেয়ারবাজারে প্রচণ্ডভাবে আস্থার সংকট তৈরি করেছে।
আমি মনে করি, এসইসির মূল দায়িত্ব হচ্ছে, বাজার সুচারুভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা দেখা। আর বাজারে কোনো ম্যানিপুলেশন আছে কি না, অবশ্যই তা দেখার ক্ষমতা আছে এসইসির। এর জন্য ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক কিংবা মিউচুয়াল ফান্ড—সবারই ট্রেডিং বিহেভিয়ার পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রয়েছে এসইসির। নিয়মভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারে এসইসি।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় একটি প্রতিষ্ঠানকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছিল এবং তা আদায়ও করা হয়েছিল। কাজেই তাদের সেই ক্ষমতাগুলো ব্যবহার না করে সূচক নিয়ে দৈনন্দিন যে পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করছে, কোনো সময় বাড়ানো বা কমানোর জন্য। আমি মনে করি, এটি সঠিক নয়। বাজারকে কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল করা যায়, সে জন্য সবার সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বল্প মেয়াদে অনেক শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন ঘটে। যেমন—মুম্বাই শেয়ারবাজারে সূচক প্রায় ১৯ হাজারে চলে গিয়ে আবার কমতে কমতে সাড়ে নয় হাজারে নেমে এসেছিল। এখন আবার সেটি ১৮-১৯ হাজারের কাছাকাছি চলে গেছে। কাজেই মধ্য মেয়াদে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রথম কথা হচ্ছে, শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। কারণ চাহিদা বাড়লেও নতুন নতুন ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়েনি। গত দুই বছরে গ্রামীণফোন ছাড়া বড় তেমন কোনো কোম্পানির শেয়ার বাজারে আসেনি। এর ফলে এ ধরনের একটি অসামঞ্জস্য দেখা যাচ্ছে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে। বাজারে সরকারি শেয়ার আনার বিষয় বেশ আলোচিত হচ্ছে। আমি মনে করি, যত দ্রুত সম্ভব সরকারি শেয়ারগুলো বাজারে আনা দরকার। আশার কথা হচ্ছে, বেশ কয়েকটি ভালো প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার পাইপলাইনে আছে। এসইসির তাদের মূল দায়িত্বের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে সচেতন করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ডিএসই ও এসইসি মিলিতভাবে প্রতিদিন যদি গুরুত্বপূর্ণ দু-একটি সূচকের তথ্য গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে প্রচার করে, তবে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি সচেতন হতে পারেন। এটিও তাদের বলা যায়, আপনার কাছে যদি ভালো কোনো শেয়ার থাকে, তা এই মুহূর্তে বিক্রি করার দরকার নেই, মার্কেটে দরপতন হলেও কিছুদিন পর এটির দাম বাড়ার সম্ভাবনা আছে—এ ধরনের প্রচেষ্টা নেওয়া যেতে পারে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আরও বেশি আলোচনা করা দরকার, যাতে বাজারে স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। আগামী তিন-পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে শেয়ারবাজারকে ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন (মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পৃথক করা) করতে উদ্যোগী হওয়া উচিত। এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও সরকারকে অনেকটা দৃঢ় অবস্থান নিতে হতে হবে। সিডিবিএল যখন প্রথম চালু করা হয়, তখন প্রচণ্ড বাধা এসেছিল। কিন্তু তখন আমি বলেছিলাম, যদি এর ফলে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, তার দায়িত্ব আমরা নেব। কিন্তু এটি এখন ভালোভাবেই কাজ করছে।
প্রাইস আর্নিং অনুপাতের ক্ষেত্রে আরও বেশি সংশোধন করা দরকার। যখন একটি রিজনেবল লেভেলে পিই রেশিও আসবে, তখন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে শুরু কিংবা বিক্রি কম করবে। নতুন শেয়ার এলে সূচক আবারও বাড়বে। কারণ সূচক বাড়ার দুটি সূত্র—একটি নতুন শেয়ার এলে, অপরটি বিদ্যমান শেয়ারের দাম বাড়া। সেটিও বিনিয়োগকারীদের জন্য আশামূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে নতুন শেয়ার বাজারে আসার ফলে। শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি। কারণ যেগুলোকে সাবসক্রিপশনের আমন্ত্রণ করা হয়েছে, সেগুলোর তারিখ পার হয়ে গেছে, এখনো বাজারে আসেনি। সেগুলোর সবই তো তিন-চার গুণ ওভার সাবসক্রাইবড হতে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং আমি মনে করি, বেসরকারি ও সরকারি খাত যদি এগিয়ে আসে, মূলধন জোগান দেওয়ার চিন্তা তারা করে, স্টক মার্কেটে সেটিকে কাজে লাগানো সম্ভব।

মতিউর রহমান
নতুন নতুন কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসে টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। যাদের দুই-তিন বছর আগেও তেমন কোনো সুনাম ছিল না। আর্থিক সচ্ছলতা-সংগতি তাদের ছিল না। ডিফল্টার হিসেবে তারা নানা কিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিল। দেখা যাচ্ছে, তারাই নতুন নতুন কোম্পানি এনে, আরও একের পর এক কোম্পানি কিনে, আবার শেয়ারবাজারে এসে বাজারের সূচক বৃদ্ধি করছে। এদের মধ্যে অনেকে ’৯৬-এ শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিনটি সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা কেউই এদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অনেকে বলছেন, এরাই এখনো শেয়ারবাজারকে এই পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো আমাদের সবার কাছে পরিষ্কার। আলোচনার এ পর্যায়ে বিশিষ্ট শিল্পপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
আমরা যাঁরা ব্যবসায়ী, স্টক মার্কেটে আইপিও করতে আসি, এর পেছনে দুটি উদ্দেশ্য থাকে। একটি হলো, বিদ্যমান মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, উত্তোলিত মূলধনের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করে কোম্পানির ব্যয় কমিয়ে আনা। আমি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারি, কিন্তু তার ফলে আমার দেনার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই আমরা কোম্পানি সম্প্রসারণের জন্য শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে আইপিও করি। ফাটকাবাজি বিনিয়োগকারী বলতে বোঝায়, আমি বাজারে এসে বাজারকে চড়িয়ে দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে কেটে পড়লাম। কিন্তু বর্তমানে শেয়ার মার্কেট এত সম্প্রসারিত হয়েছে যে আমার মনে হয় না একটা কোম্পানি এসে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ’৯৬ সালে শেয়ারবাজারের পরিধি অনেক ছোট ছিল। কিন্তু বর্তমানের সঙ্গে তাকে তুলনা করলে হবে না। ফলে কোনো কোম্পানির একার পক্ষে বাজারকে অস্থিতিশীল করা সম্ভব নয়। আর যদি কোনো কোম্পানি করেও থাকে, সেখানে এসইসি একটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। শেয়ারগুলো প্রকৃত মূল্যায়িত না হয়ে অতিমূল্যায়িত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, আমার দেখা একটি লেদার কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ৩০ টাকা, যেটি অতিমূল্যায়িত হয়ে ৬০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু এটি সহজে বের করা সম্ভব। এই শেয়ারগুলো কোন ব্রোকার হাউসগুলো বা কারা কিনেছেন, তা কিন্তু এসইসি চিহ্নিত করে প্রকৃত কারণ বের করতে পারে। আমাদের দেশে প্রায় ২৯টির মতো প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে সাত-আটটি ব্যাংক আলাদা কোম্পানি করেছে, যেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ ছিল যে আলাদা একটা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি করতে হবে। তার পেইডআপ ক্যাপিটাল ১০০ বা ২০০ কোটি টাকা হলেও তার ব্যালান্সশিট আলাদা করতে হবে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো প্রধান ব্যালান্সশিট থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি করতে পারছে না। আমার জানা মতে, আটটি ব্যাংক আলাদা সাবসিডিয়ারি করে গড়ে ১৫০-২০০ কোটি টাকা করে, প্রায় এক-দেড় হাজার কোটি টাকা শেয়ার মার্কেটে এনেছে। কিন্তু আজকে সূচকের যে ওঠা-নামা হচ্ছে, তার পেছনে মূল হোতা হচ্ছে কালো টাকা। কারণ, কালো টাকাটি তারা ব্যাংকে রাখতে পারছে না, কর দিতে হবে বলে। টাকাটা বাসায় রাখতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কারণে। তখন সে এই কালো টাকাটা শেয়ারবাজারে খাটাচ্ছে। এই টাকাটা যখন বাজারে আসে, সেটা যদি গঠনমূলক খাতে যায়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সেই কালো টাকা বারবার শেয়ারবাজারে তারা নিয়ে আসছে, ফলে এই টাকা বারবার ব্যবহারের ফলে মার্কেট চড়া হচ্ছে। যদি আমাদের বাজারের নতুন ভালো কোম্পানির শেয়ার সরবরাহ বেশি থাকত, তবে বাজার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকত। মুম্বাইয়ের শেয়ারবাজারে শেয়ারের মূল্য আয়ের অনুপাত (পিই রেশিও) প্রায় ২৮। আমাদের পিই রেশিও ২১ থেকে ২৫। আমাদের পিই রেশিওর পার্থক্য কিন্তু মুম্বাই শেয়ারবাজারের তুলনায় খুব বেশি নয়। সমস্যা হচ্ছে, তাদের ওই টাকাগুলো ভারতে শিল্প খাত ও উৎপাদনমূলক খাতে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের টাকা বারবার শেয়ারবাজারে ফিরে আসছে। আমাদের অর্থনীতি ভারতের মতো অত শক্তিশালী নয়। আমাদের এসইসিকে তদারকির ব্যবস্থা আরও বাড়াতে হবে—এই টাকাগুলো কোথা থেকে আসছে, কোথায় বিনিয়োগ হচ্ছে, এ বিষয়ে। জেড ক্যাটাগরির শেয়ারগুলো তদারকির ব্যবস্থা আরও বাড়াতে হবে। যেসব কোম্পানি ম্যানিপুলেট করছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে এসইসিকে। এ কাজগুলো কারা করছে, সবাই তা জানে। যেখানে অর্থমন্ত্রী নিজে বলেছেন, আমি জানি, এগুলো কারা করছে। তিনি জানার পরও যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কী আর করার থাকে।
দেশ আমাদের সবার। সুতরাং এ ধরনের কয়েকটি কোম্পানিকে যদি উদাহরণ সৃষ্টির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, তবে অন্যরা সতর্ক হয়ে যাবে। একটি কোম্পানিকে যদি ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়, সেখানে ১০ কোটি টাকা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে, সেই কোম্পানির নামটি গণমাধ্যমে প্রচার হলে তার কোম্পানির সুনাম নষ্ট হবে। একটি প্রাইভেট কোম্পানির সুনাম যদি খর্ব হয়, তবে ভবিষ্যতে তার পক্ষে শেয়ার মার্কেট থেকে টাকা তোলা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যবসা পরিচালনার মূলকাঠি হচ্ছে সুনাম। আমি একদিকে বলছি মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা, আবার অন্যদিকে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। এটা কিন্তু ঠিক নয়। সূচক বাড়ল না কমল, এটা কিন্তু এসইসির দেখা কাজ নয়। শেয়ারবাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। কিন্তু যারা ম্যানিপুলেটরস, তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করাই হচ্ছে এসইসির প্রধান কাজ। ১৯৯৬ সালে যারা শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদনও তৈরি হয়েছিল এবং নামের তালিকাও করা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। মামলাগুলো আইনি জটিলতার কারণে হাইকোর্টে এখনো চলছে। কিন্তু কিছু কিছু অপরাধ আছে, যেগুলো প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে সাহস নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন—নিজের কোম্পানির শেয়ার ৩০ টাকাকে ৬০০ টাকা যারা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে যৌথভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে এসব প্রতিরোধের জন্য।

আব্দুল কাইয়ুম
বাজারে শেয়ারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় করার দায়িত্ব মূলত কার? গ্রাম ও মফস্বল থেকে বিনিয়োগকারীরা রাতারাতি লাভের আশায় বাজারে এসেছেন। এসব ক্ষেত্রে এসইসি কী ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়গুলো সম্পর্কে এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীকে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী
৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সূচক সর্বোচ্চ উঠে দাঁড়িয়েছিল আট হাজার ৯১৮ এবং লেনদেন হয়েছিল তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা। লেনদেনের করা শেয়ারের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৯০ হাজার। কেন এই পর্যায়ে বাজারকে আসতে দেওয়া হয়েছিল? কেন বাজারকে এই পরিস্থিতিতে আসার আগে নিয়ন্ত্রণ করা হলো না? গতকাল সূচক ছিল সাত হাজার ১৪০ পয়েন্ট। ইতিমধ্যে প্রায় এক হাজার ৭৮০ পয়েন্টের মতো সংশোধিত হয়েছে। অর্থাৎ যা ২০ শতাংশের মতো প্রায় সংশোধিত হয়েছে, যার ফলে বাজারের ঝুঁকি কিছুটা কমেছে। তার পরও এখন যদি বাজার স্বাভাবিক গতিতে ফিরে আসে, স্বাভাবিকভাবে দাম যদি কিছুটা বাড়ে, বাজার সংশোধিত হয়, তাতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এখনো বাজার হঠাৎ হঠাৎ ওঠা-নামা করছে। বাজার তার স্বাভাবিক আচরণ করছে না। যেমন—গতকালই আবার বাজার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আজকে বেলা একটা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সংকটটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।
যাঁরা বিশ্লেষক আছেন, তাঁরা অনেকে মূলধনের সংকটকে দায়ী করে কথা বলছেন। প্রথমে যখন বাজার নেমে যায়, তখন হয়তো অর্থসংকট একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু মূলত এটা প্রধান কারণ নয়। কারণ, যখন এসইসি তাদের মার্জিন পয়েন্ট ৫ করেছে, এনইভির তখন প্র্যাকটিক্যাল রেট ছিল দশমিক ২৫। ক্রেডিট কিন্তু খুবই কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখনো বাজারের ঊর্ধ্বগতি থামেনি। বাজারে অর্থের সমস্যা হলেই যে বাজার নামবে বা বাড়বে, তা কিন্তু নয়। অর্থ একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু মূলত বাজার এমন একটি পর্যায়ে গিয়েছিল যে অনিবার্যভাবে একটা সংশোধন দরকার ছিল। সে সংশোধনটা যদি ধীরে ধীরে হতো, তাহলে ভালো হতো। কিন্তু বিরাট ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে এই সংশোধনটা হচ্ছে, যা অনেক বিনিয়োগকারীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এ সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে, আস্থার সংকট। শেয়ারবাজারে একটি আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যদি আমি এখন বিনিয়োগ করি, তবে বাজারে আবারও দরপতন ঘটতে পারে। সুতরাং তাঁরা বিনিয়োগে যাচ্ছেন না।
এই বাজারে আস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসাই হবে আমাদের প্রধান কাজ। ঋণ অনুপাত বাড়িয়ে ১:২ করা হয়েছে, তবুও কোনো লাভ হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক আইসিবিকে ২০০ কোটি টাকা দিয়েছিল, গতকাল আবারও ২০০ কোটি টাকা দিয়েছে। আমার মনে হয়, এগুলো খুব পরিণত সিদ্ধান্ত নয়। কারণ, ২০০ বা ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে এই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রথমে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, যা খুবই কঠিন ও দুরূহ কাজ। তবে সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অবশ্যই এই আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট যাঁরা আছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই তাঁদের মন্তব্য সম্পর্কে একটু সচেতন হওয়া উচিত। আমরা এমন কিছু যেন না বলি, যাতে আস্থার সংকটটা আরও বাড়ে। বাজারকে তার নিজস্ব ধারায় চলতে দেওয়া উচিত, যাতে বাজারে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে আসে। এখন বাজার খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। সামান্য নেতিবাচক মন্তব্যের কারণেও কিন্তু বাজার পড়ে যেতে পারে। সুতরাং, আমরা কী বলছি সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। যারা বাজার উঠিয়ে একটি পর্যায়ে নিয়ে শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে যারা দেরিতে বাজারে এসেছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এই শেয়ারগুলো কিনেছে। যখন শেয়ারের দাম কমে গেল, তখন সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর উদ্যোগে আবার বাজারকে চাঙা করা হলো। তখন সেই বড় বিনিয়োগকারীরা সুযোগ পেয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে গেছেন। শেয়ারগুলো বড় বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হাতে চলে গেল। সুতরাং, এখানে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর সতর্ক থাকা উচিত। তারা যেসব পদক্ষেপ নিয়ে বাজার চাঙা করার চেষ্টা করছে, এর ফলে শেয়ারগুলো কারা কিনছে। শেয়ারগুলো কারও না কারও হাতে আছে। আমার ধারণা, ইতিমধ্যে বড় বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বেরিয়ে গেছে এই সুযোগ দেওয়ার ফলে। বাজারকে আরও কিছু দিন যে ধরে রাখার চেষ্টা করা হলো, এর ফলে বড় বিনিয়োগকারীরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ওপর শেয়ারগুলো চাপিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেছে। বাজার স্থিতিশীল করার জন্য আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিনিয়োগকারী, ব্রোকার হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে। এ জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে এসইসি। সবার সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার আস্থার সংকট নিরসনের জন্য। ব্রোকার হাউসে যদি গুজব রটে যায় দাম আরও কমবে, তাহলে বাজার কিন্তু অটোমেটিক্যালি দরপতন ঘটবে। যারা বাজারকে বাড়িয়েছে, তারা একটা পর্যায়ে গিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে চাইবে বাজারে দাম কমানোর জন্য, যাতে তারা আবার কিনতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। যদি আরও বেশি বাজার সংশোধিত হতে হয় হোক, তবুও বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া দরকার। কোনো প্রণোদনা অথবা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে বাজারকে যেন নামিয়ে না দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে আরও সতর্ক হতে হবে। এসইসির এখনই ব্রোকার হাউসগুলো, মার্চেন্ট ব্যাংকস, অ্যাসেট কোম্পানিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যদি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ১৯৯৬ সালের পর থেকে গত ১৫ বছরে সবার চেষ্টার পর আজকে একটি অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম। আবার যেন কোনো আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়ে পাঁচ বছরের জন্য বাজার ধ্বংস হয়ে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যারা বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তারা সবাই যদি সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা করে, তবে এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। বর্তমানে অনেক শেয়ারই ফান্ডামেন্টাল মূল্যের কাছাকাছি চলে এসেছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা নির্ভয়ে বিনিয়োগ করতে পারেন এসব খাতে।
গত এক বছরে যেভাবে শেয়ারের চাহিদা বৃদ্ধি করা হয়েছিল, সরবরাহ নিশ্চিত না করে এটি ঠিক ছিল না। আমার মনে আছে, ২০০৮ সালে শেয়ারের বাজার এভাবে বেড়ে যাচ্ছিল। তখন সিলেটে ভ্রমণ করতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে একটি উপজেলায় ব্যানার ঝুলছে। তাতে লেখা আছে, ওই উপজেলায় একটি ব্রোকার হাউসের শাখা খুলছে। আমি ঢাকায় ফিরে আসি এবং যেখানে শেয়ারের দাম বাড়ছে, সেখানে কেন এত ব্রোকার হাউসের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেই। এসইসি থেকে নির্দেশ দিল যে এসইসির অনুমোদন ছাড়া নতুন কোনো ব্রোকার হাউস খোলা যাবে না। তখন এই সিদ্ধান্ত খুবই ভালোভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছিল। কিন্তু বর্তমানে শেয়ার সরবরাহের দিকে খেয়াল না করে যে হারে চাহিদা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে এসইসি ও ডিএসইকে খেয়াল রাখতে হবে, আমার সরবরাহ কী রকম, তার ভিত্তিতে চাহিদা বাড়াতে হবে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য। শেয়ার সরবরাহ যদি বেড়ে যায়, তবে সে অনুপাতে চাহিদা অর্থাৎ ব্রোকার হাউসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সমন্বয় অবশ্যই করতে হবে। বাজারে এসইসি একেবারে হস্তক্ষেপ করবে না—এ ব্যাপারে আমি একমত হতে পারছি না। তবে আদর্শ অবস্থা হচ্ছে, এসইসি কেন বাজারে হস্তক্ষেপ করবে। আমাদের ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী আছেন, তাঁরা কতজন বাজার সম্পর্কে বোঝেন, সেখানে একেবারে বাজারকে ছেড়ে দেওয়া কতটুকু সমীচীন হবে, তা আমার বোধগম্য নয়। এসইসি প্রধানত বাজারে তারল্য ব্যবস্থাপনা বা মার্জিন ব্যবস্থাপনার কাজটি করে থাকে। তবে তারল্য ব্যবস্থাপনা ঘন ঘন করা উচিত নয়। কারণ, এটি বাজারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। মাঝেমধ্যে তারল্য ব্যবস্থাপনা করা দরকার, তবে যত কম করা হবে, তত ভালো। সুতরাং ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা ঠিক নয়। কারণ, এসইসির একটি সিদ্ধান্তে অনেক লোকের লাভ হয়, অপর দিকে অনেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হন। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এসইসিকে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা দেখলাম, তারল্য ব্যবস্থাপনা করে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, এমনকি বাজারে প্রভাব ফেলাও সম্ভব হয়নি। মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার আলাদা হলেও একটি অন্যটিকে প্রভাবিত করে। আমি যদি ক্যাপিটাল মার্কেটে তারল্য কমাতে চাই, শুধু মার্চেন্ট ব্যাংকের আইন প্রয়োগ করে এটা করব, তা সম্ভব নয়। প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় আসা। এটা সম্মিলিতভাবে করতে হবে। কারণ টাকার মূল উৎস তো বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অন্যান্য মার্চেন্ট ব্যাংকে বা বিভিন্ন জায়গায় যায়। তারল্য নিয়ন্ত্রণে এসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়হীনতা বাজারে ভুল বার্তা দিচ্ছে। আমি স্বীকার করছি, এসইসিতে হয়তো অবশ্যই অনেক অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতা আছে, তবুও তারা চেষ্টা করছে সাধ্যমতো। এসইসিকে তার মতো করে চলতে দেওয়া উচিত। এসইসি যখন কোনো কথা বলছে, তখন আবার ক্ষমতার বিভিন্ন জায়গা থেকে ভিন্ন কথা বলা হচ্ছে। এমনকি ডিএসই ও সিএসইর সঙ্গে এসইসির সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মতামত আসতেই পারে। সরকার তার নির্দেশনা দিতেই পারে। তবে যেসব বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্তই হয়নি, সে বিষয়ে কথা বলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করা উচিত। সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করে জনগণকে আগে না বলে এসইসির মাধ্যমেই তা আসা উচিত।
বুক বিল্ডিং তৈরির সময় স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছিল। এর একটি সুফল হলো এই বুক বিল্ডিং করার ফলেই অনেক বেসরকারি কোম্পানি বাজারে এসেছে। কারণ যে ব্যক্তি ১০-১৫ বছর আগে একটি প্রতিষ্ঠান করেছে, ১০০ টাকা তার ফেসভ্যালু, ওটার দাম তো অনেক বেড়ে গেছে এখন। সুতরাং আইপিওতে যদি তাঁর শেয়ারে সঠিক দাম না পান, তাহলে আসতে চাইবেন না। এটিই একটি প্রধান কারণ, কেন প্রাইভেট সেক্টরগুলো বাজারে আসছে না। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তারা বাজারে একটি সঠিক মূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতগুলো উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসছে। কিন্তু বুক বিল্ডিংয়ের মধ্যে যে ইন্ডিকেটিং প্রাইসটি দেখানো হচ্ছে, এটি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এই ইন্ডিকেটিং প্রাইসটি হতে হবে বাজারে ফান্ডামেন্টাল প্রাইসের ওপর নির্ভর করে, কখনোই বাজারের বর্তমান দামের ওপর নয়। এটি প্রকৃতভাবে সমন্বয় হচ্ছে না বলে আমার সন্দেহ। এই ইন্ডিকেটিং প্রাইস এসইসিকে না দেওয়া পর্যন্ত কোম্পানিগুলো আইপিওতে যেতে পারে না। কিসের ভিত্তিতে এটি করা হয়েছে, সেটিও কিন্তু এসইসিকে রিপোর্ট করতে হয়। যেখানে এসইসির মনে হবে যে ইন্ডিকেটিং প্রাইসটি অতিমূল্যায়িত হয়েছে, সেখানে ব্যবস্থা নিতে হবে। সে জন্য একটি সুনির্দিষ্ট মূল্যে রাখতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীদের লাভ হয়, বাজার স্থিতিশীল থাকে এবং সেই কোম্পানিও লাভবান হয়। সব দিক বিবেচনা করে দেখতে হবে। এসইসি যদি মনে করে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির অপব্যবহার হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু সংশোধন আনা যেতে পারে। তবে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিটি বাজারে যে সুফল নিয়ে এসেছে, এটাকে অপব্যবহার করে যাতে বন্ধ করে দেওয়া না হয় সে ব্যাপারে এসইসিকে সতর্ক হতে হবে। সুতরাং ইন্ডিকেটিং প্রাইস কিসের ভিত্তিতে ১০০ টাকার শেয়ার দুই হাজার টাকা হলো, সে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে এসইসিকে।
কোয়ালিটি অব ফাইন্যান্সিয়াল ডিসপোজার অর্থাৎ ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে দৃঢ় করতে। যার জন্য আইসিএবির অডিট রিপোর্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমরা যদি ক্রেডিবল অডিট রিপোর্ট সঠিকভাবে দিতে না পারি, তবে একজন বিনিয়োগকারী কোন অবস্থায় একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবে। ১৯৯৬ সালে এমন অনেক অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে ভুয়া কোম্পানি বাজারে এসেছিল, তাদের কিছুই ছিল না, অর্থাৎ পুরো অডিট রিপোর্টটি ভুয়া ছিল। অনেক কোম্পানি বন্ধও হয়ে গেছে। আমাদের সমগ্র অর্থনীতির অডিট রিপোর্টের মান উন্নয়ন করা দরকার। আইসিএবি সত্যিকার অর্থে অডিটগুলো তদারক করছে কি না, সে ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ক্রেডিবল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং হতে হবে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ক্রেডিট রেটিং কোম্পানিগুলো আছে, ক্রেডিট রিপোর্টিং করছে। ব্যাংক লোন দিচ্ছে। সুতরাং এটি একটি মূল জায়গা। এটি সঠিকভাবে করলে এনবিআর লাভবান হবে। রেভিনিউও বৃদ্ধি পাবে। এই একটি জায়গায় সঠিকভাবে কাজ করলে সব ক্ষেত্রেই লাভবান হবে। এসব সত্ত্বেও আমাদের নীতিনির্ধারকেরা সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
আমাদের রাজস্বনীতির দিকে নজর দিলে দেখা যায়, গতবার ব্যাংক, স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার, ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন এদের ১০ শতাংশ করের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু এগুলো আরও রিভিউ করা দরকার। যদি ব্যাংক দেখে কোর বিজনেস করলে ৪২ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে আর ক্যাপিটাল মার্কেটে এলে ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। তাহলে তারা অধিক মুনাফা লাভের জন্য ক্যাপিটাল মার্কেটেই যাবে। এ ক্ষেত্রে সামনের বাজেটে এনবিআর কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে।
আমি আজকে শেয়ার কিনব, কালকে বিক্রি করে দেব লাভের আশায়, এটা ঠিক নয়। শেয়ারগুলো আমাদের ধরে রাখতে হবে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ফলে অনেকেই এই পুঁজিবাজারে চলে আসছেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আরও প্রশিক্ষিত করতে হবে। আমাদের বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করার পরও অধিক মুনাফার আশায় ঝুঁকি নিচ্ছে। বাজার যেভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে, সেখানে প্রচুর পেশাগত লোক দরকার, পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের সচেতন করার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
কে কোথায় মার্কেট ম্যানিপুলেট করছে, তা চিহ্নিত করার জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহায়তায় আরও উন্নত ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করার কথা, সেটি এখনো হয়নি। এসইসি ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে বাজার তদারকের ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা দরকার। আমাদের দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পৃথক করা) করা দরকার। এসইসিকে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও বেশি দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য উদ্যোগী হতে হবে।

আব্দুল কাইয়ুম
শেয়ারবাজার খুব স্পর্শকাতর। কোপেনহেগেন বিজনেস স্কুলের একজন গবেষক নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জসহ মোট চারটি স্টক এক্সচেঞ্জের গতিধারার ওপর সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯২৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়কালের তথ্য নিয়ে গবেষণা করে তিনি দেখেন, সূর্যগ্রহণের সময় সূচক কমে যায় শেয়ারবাজারে। আমাদের দেশেও কিন্তু এসব কুসংস্কার প্রভাব ফেলে। চীন ও ভারতে এবং কিছুটা আমাদের দেশেও যে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল ২০০৯ সালের ২২ জুলাই, তার আগে ১৯ জুলাই সূচক ছিল ২৮৭০, ২০ জুলাই ২৮৩৪, ২১ জুলাই আরও কমে ২৮২৮, আর ২২ জুলাই সূর্যগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই আবার সূচক বেড়ে ২৮৭০ হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন গুজব বা ঘটনা কতটা প্রভাব বিস্তার করে, তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে অনেককে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে সুফল পাওয়া যাবে। আলোচনার এ পর্যায়ে ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আহমেদ খানকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

সালাহউদ্দিন আহমেদ খান
আমরা দেখেছি, আমাদের বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা যে হারে বিনিয়োগকারী বৃদ্ধি করেছি, সে হারে বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়াতে পারিনি। এর জন্য অনেক কারণই দায়ী। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত নয়। গত কয়েক বছর ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগে সমস্যার কারণে আমাদের দেশে বিনিয়োগ অনেকটা কমে গেছে। সত্যিকার অর্থে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানই আর খুব বেশি ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারছে না। ২০১০ সালের প্রথম দিকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রক্ষণাত্মক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এরপর বাজারে অনেকে আইপিওতে আগ্রহী ছিল—তারা পিছিয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি ছিল অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত। তারপর এই রক্ষণাত্মক সিদ্ধান্ত ওঠানোর ফলে পুঁজিবাজারে আসার জন্য ইতিমধ্যে ৪৮টি কোম্পানি পাইপলাইনে আছে।
যদি এই অবস্থান গত বছরটি পুরোটা সময় থাকত, তবে হয়তো এই দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। পুঁজিবাজারে যখন বিনিয়োগকারীরা এসেছে, তখন তারা ঋণের সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা পেয়েছিল। গত কয়েক বছরে যদি বিনিয়োগ কমে যায় তবে মানুষের আয় বৃদ্ধির হারও কমে যায়। প্রকৃত আয় কিন্তু আমাদের কমেছে। ডিসপোজিবল ইনকাম কমার ফলে সঞ্চয়ের ধারাও কমেছে। পুঁজিবাজারে যখন যাচ্ছি, যদি অধিক লাভ পাই—তবে এ ধরনের অ্যাডিকশন দেখা যাচ্ছে। আমি বেশি ঋণ নিতে চাইব এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে চাইব অধিক মুনাফার আশায়। এ অবস্থায় বাজার মূল্যায়ন অনেক উচ্চতায় চলে গেছে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতার কথাও বলতে চাই। প্রতিটি ব্যাংকিং কোম্পানি প্রতি মাসেই তার ফান্ড ডিপলয়মেন্ট রিপোর্ট পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকে। সেখানে কোথায় টাকাটা যাচ্ছে তা উল্লেখ থাকে। যদিও ২৬ শতাংশ ক্রেডিট বেড়েছে বলা হচ্ছে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও আগে দেখার কথা। মূলধন বাড়লে আমরা তো মেশিনারি বা র ম্যাটেরিয়াল আনব, কিন্তু এলসি খোলার হার দেখলেই তো বোঝার কথা টাকাটা কোথায় যাচ্ছে। তাহলে সেটি আরও আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারক করা দরকার ছিল, যা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অনেক ব্যাংক বা মার্চেন্ট ব্যাংকের ওভার এক্সপোজার হয়ে গেছে। ওভার এক্সপোজার যে ভিত্তিতে ক্যালকুলেশন করা হয়, তা আমার দৃষ্টিতে ভুল। বাংলাদেশ ব্যাংক ওভার এক্সপোজার হিসাব করছে কারেন্ট মার্কেট প্রাইসের ভিত্তিতে। একটি ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ এক্সপোজার হওয়া উচিত সে মোট কত টাকা বিনিয়োগ করেছে, তার ভিত্তিতে। যদি ধরি, একটি ব্যাংক জুলাই মাসে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু বাজারে দাম বৃদ্ধির ফলে এটি দাঁড়িয়েছে ৭০-৮০ কোটি টাকা। এখন আমি যদি বলি, ওই ব্যাংকে এক্সপোজার ৮০ কোটি টাকা, তবে সেটি প্রকৃত এক্সপোজার নয়।
এ ধরনের একটি ভুল চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। যে ব্যাংকগুলো লোন দিচ্ছে, ব্রোকার হাউস অথবা মার্চেন্ট ব্যাংকের সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে, সেই গ্রাহকদের লোন এক্সপোজার ক্যালকুলেশনও একই প্রক্রিয়ায় করা হচ্ছে। অর্থাৎ গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে, সেখানে বিনিয়োগের যে বাজারমূল্য এখন রয়েছে সেটিকে হিসাবে ধরা হচ্ছে। তার ফলে আজ একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, কোনো কোনো ব্যাংকের ১০০ শতাংশ ওভার এক্সপোজার বা তারও বেশি।
এর ফলে এই ব্যাংকগুলো আর নতুন করে এক্সপোজার নিতে পারছে না। কন্ডাকশনারি মনিটরি পলিসি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে শুধু শেয়ারবাজার নয়, প্রতিটি ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউটে তাদের ‘ওভার অল লিকুয়ডিটি’ সমস্যা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাত-আট বা ১০ হাজার কোটি টাকা রেপো করছে, কিন্তু রেপোর ক্ষেত্রে যে নতুন একটি মাত্রা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটি বলা হচ্ছে না। আগে রেপো করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ৮০ শতাংশের বেশি ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত রেপো দিত। অর্থাৎ ১০০ টাকার বন্ড দিলে ৯৫ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিত বাংলাদেশ ব্যাংক। সেটি গত সপ্তাহে যখন সংকট অবস্থার সৃষ্টি হয়, তারও আগে ১১ শতাংশে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার একটি বন্ড দিলে, একটি ব্যাংক মাত্র ১১ টাকা ঋণ পাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে সংকট সৃষ্টি হলো, তখন এটি বাড়িয়ে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তারা রেপো দিচ্ছে কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যাংককে ফান্ড দিচ্ছে না। আগে যদি কোনো ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনা দেখা দিত, তখন এই রেপো দিয়ে তাদের ফান্ডের একটি ব্যালেন্স আনা হতো। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংকে এই অব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। কিন্তু অর্থনীতির একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সম্প্রতি এলসি খোলার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। আমাদের অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন অর্থনীতির প্রকৃতভাবে অগ্রগতি হচ্ছে, তখন যদি কন্ডাকশনারি মনিটরি পলিসি করা হয়, তবে তা অগ্রগতিকে বাধা দেবে।
যেহেতু মানুষ অন্য কোথাও না যেতে পেরে স্বল্প সময়ে পুঁজিবাজারে এসে লাভবান হচ্ছে, এর ফলে তাদের মধ্যে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আগের চেয়ে আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এখন যখনই মার্চেন্ট ব্যাংক আর ঋণ দিতে পারছে না, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে আমাদের প্রকৃত আয়ের পরিমাণ কমেছে। কিন্তু জীবনযাপনের খরচ অনেক বেড়েছে। ফলে তাদের হাতে নগদ অর্থ খুব কম থাকছে। দুই বছর আগে ঢাকার বাইরে থেকে নতুন বিনিয়োগকারীরা আসত নগদ অর্থ নিয়ে, সেটি কিন্তু এখন আর নেই। অপর দিকে আমাদের বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স মানি আসত, তা-ও কিন্তু কমে এসেছে। একদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে যেমন মূলধনের প্রবাহ কমছে, অপর দিকে ব্যক্তিগত মূলধন প্রবাহের পরিমাণও কমছে। এর ফলে ক্যাপিটাল মার্কেট একটি সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা ও যাঁরা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাঁদের বেশির ভাগেরই মতামত হচ্ছে শেয়ার না কেনার প্রতি। ফলে এ ধরনের ব্যক্তিরা যাঁরা পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যেই একটি ভীতির সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু আমি বলতে চাই, এখনো বাজারে সুযোগ আছে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করে লাভ করে বেরিয়ে আসার। আবার অপর দিকে ঝুঁকিও থেকে যায়। কারণ, প্রচুর শেয়ার এত বেশি মূল্যায়িত হয়ে রয়েছে যে বিনিয়োগকারীদের হাতে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ার রয়েছে, তাঁদের বেরিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। তাঁদের উচিত, ভালো শেয়ারের প্রতি আকর্ষিত হওয়া ও ধরে রাখা। কিন্তু এই শেয়ারগুলো কারা চিনিয়ে দেবে? এই যে ব্রোকার হাউস বা মার্চেন্ট ব্যাংকার্স, যারা গ্রাহকদের হ্যান্ডেল করে, তাদের আমরা প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারি। কারণ, আমাদের পক্ষে ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ১৪ হাজার কোটি টাকা এক্সেস আছে, কিন্তু ব্যাংকগুলো বলছে, তাদের কাছে টাকার সংকট রয়েছে। বাজারে যে ৩৩ লাখ লোক আছে, তাদের সিস্টেমেটিকভাবে বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু বর্তমানে মন্দা বাজারে যারা বিক্রি করছে, বরং তাদের চেয়ে এ মুহূর্তে যারা কিনছে তারা আরও বেশি লাভবান হবে ভবিষ্যতে। বাজারের সূচক সংশোধনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ৩৩ লাখ লোক (যদিও আমার হিসাবে ৬৫-৭০ লাখ লোক) যদি বাজারবিমুখ না হয়, তবে অনেকটা স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব। ব্যাংকিং সেক্টরের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে। যদি অর্থনীতির উন্নয়ন বাড়াতে চাই, তবে অবশ্যই শেয়ারবাজারে আরও বিনিয়োগকারী আনতে, তাদের আগ্রহী করতে এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই লোকগুলো যদি ফিরে যায়, তাদের আবার ফিরিয়ে আনা খুবই দুরূহ কাজ হবে।

আবু আহমেদ
আমি সব সময় নিজের জন্য যা ভালো মনে করেছি, তা অন্যের জন্যও ভালো মনে করি। যখন একজন বিনিয়োগকারী আমাকে প্রশ্ন করে, আমি শেয়ার কিনব কি না? আমি উত্তরে বলেছি, না, এই শেয়ার কিনবে না। কারণ আমার অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে সব ধরনের সতর্কসংকেত দিচ্ছে যে বাজার তার এ অবস্থায় থাকবে না। আমি কীভাবে একজন বিনিয়োগকারীকে বলি, তুমি আট হাজার সূচকে শেয়ার ক্রয় করো।
ব্যাংকগুলো তাদের সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতিতে সাধারণভাবেই যখন সুদের হার বাড়ে, তখন পুঁজিবাজার থেকে মূলধন বেরিয়ে আসবেই। আমরা বারবার বাংলাদেশ ব্যাংককে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি কন্ডাক্টরি মনিটরি পলিসি অর্থনীতিকে সহায়তা করবে না বরং আইএমএফের জন্য সহায়ক হবে। মনিটরি পলিসি দ্বারা দ্রব্যমূল্য কখনো কমানো বা বাড়ানো যাবে না। দ্রব্যমূল্য মূলত নির্ভর করে বিশ্ববাজারের ওপর। আমি বুক বিল্ডিং পদ্ধতির পক্ষেই বলতে চাই, এটি মার্কেটভিত্তিক মেথড হলে ভালো হবে। ইন্ডিকেটিভ প্রাইস, এটি সাধারণভাবে ম্যানিপুলেটেড হচ্ছে। কারণ ফান্ডামেন্টাল দেখে এই প্রাইসটি নির্ধারিত হওয়ার কথা থাকলেও সঠিকভাবে তা মূল্যায়িত হচ্ছে না। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, কিছু আইপিও আছে, যেগুলো শুধু বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য আসছে। প্রকৃতভাবে ফান্ডামেন্টালের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে আরও একটি কথা আছে, ইন্ডিকেটিভ প্রাইসের, সেখানে -২৫ শতাংশ বা +২৫ শতাংশ হবে। সব কটিতে দেখা গেছে +২৫ শতাংশের দিকে গেছে, কোনোটিই ঋণাত্মক হয়নি।
আমি মনে করি, এ বিষয়গুলো আবার রিভিউ করার দরকার আছে। আবার তিন-চারটি কোম্পানি একত্র হয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো বিনিয়োগকারী প্রশ্ন করেন, আপনার যেটির বেশি স্টেক ছিল, সেটিতে দাম বেশি নিয়েছেন। এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? কোনো ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কি সঠিকভাবে হচ্ছে? কয়েকটি কাগজে দেখলাম, দুটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু এই শেয়ারগুলোর এত দাম নয়। পরে খবর নিয়ে জানলাম, এই কোম্পানিগুলো একত্র হয়ে প্রাইভেট কোম্পানি হবে। যদিও দুটি কোম্পানির মালিক একজনই। ফলে প্রাইভেট লিমিটেড যেহেতু তার শেয়ার স্টেক বেশি, তাই ১০ টাকা মূল্যের শেয়ার ৩০ টাকায় দেন, তবে তাঁর লাভ হবে। এতে সাধারণ লোকেরা ঠকবে। এগুলো দেখার কথা এসইসির। ২০১০ সালে যদি শেয়ারের সরবরাহ বাড়ত, তবে আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এখন শুধু আলোচনা করে শেয়ারবাজার তোলা যাবে, সেটি আমি বিশ্বাস করি না। বাজার দীর্ঘসময়ের জন্য ক্ষতি হয়ে গেছে। তবে স্থায়ী কোনো ক্ষতি হয়েছে, সেটি আমি বলছি না। যদি অধিকাংশ বিনিয়োগকারী বিশ্বাস করে যে শেয়ারবাজার পড়বে, তবে তা স্বাভাবিকভাবেই পড়ে যাবে। অ্যাসেট রিভ্যালুয়েশন দেখলাম, একটা হাউজিং কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ছে। সে কোম্পানি কখনো ১০ শতাংশ বেশি ডিভিডেন্ড দেয় না। এই যে অ্যাসেট রিভ্যালুয়েশন করছে সন্দেহভাজন এই অডিট কোম্পানিগুলো। ১০ বছর ধরে তো ডিভিডেন্ড দেয়নি, কিন্তু হঠাৎ ১০০ শতাংশ স্টক বোনাস দেওয়া হচ্ছে।
এই যে প্রাইভেট কোম্পানিকে পাবলিকে আনার চেষ্টা করছে ওই একই কোম্পানি। শেয়ারবাজারে কালো টাকার পক্ষে কখনো আমি ছিলাম না। আমি কর ধার্য করার পক্ষে ছিলাম। মনে করতাম, আগে বাজারটাকে বাড়তে দিই। বাজার বড় হোক, বিনিয়োগকারীরা আসুক। অনেক কোম্পানি আসছে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ার জন্য। একটি কোম্পানি আসছে বাজারের আইপিও নিয়ে, সেটি কোন সময় নিবন্ধিত হয়েছে, সেটি কারও জানা নেই। কোম্পানিগুলোর টার্গেট হচ্ছে এই ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী। মিউচুয়াল ফান্ড যেমন নেগেটিভ ভ্যালুতে গেছে, আমার ধারণা, দু-একটি আইপিও ভবিষ্যতে যে দামে বিক্রি করছে, বাজারে সে দাম না-ও থাকতে পারে। একটি হোটেলের আইপিওর দাম যখন ১০ টাকারটা ১৯০ টাকা হয়, তখন আমার সন্দেহ হয়। এই যে ব্রোকার হাউস বাড়ানো হচ্ছে, এমনকি উপজেলা পর্যায়ে চলে গেছে, যার ফলে অস্বাভাবিকভাবে চাহিদা বাড়ানো হয়েছে। এখন একজন মুদি দোকানদারও পুঁজিবাজারে আসছেন। আমি বলতে চাই, এসব ব্রোকার হাউসের সম্প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রায় ১০০টি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে চলে গেছে। অথচ ব্যাংক হলে তাদের অ্যাসেট ধরে অন্তত কিছু টাকা পাওয়া যেত। আমি মনে করি, এ মুহূর্তে ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা পৃথক করা) দিকে নজর দিতে হবে। এর ফলে বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হবে। সারা বিশ্ব এই প্রক্রিয়াটি গ্রহণ করেছে। আমরা বদলের দিকে যেতে চাই। বর্তমানে যাঁরা বিনিয়োগকারী আছেন, তাঁরা যদি একবার চলে যান, তবে আগামী পাঁচ বছরে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। ১৯৯৬ সালের পর যখন বিনিয়োগকারীরা চলে গিয়েছিলেন, তখন ১৯৯৮ সালে যে কোম্পানির শেয়ারই কিনতাম, তারই দাম কমত। ২০০১ সালের দিকে আস্তে আস্তে বিনিয়োগকারীরা আসতে শুরু করেন। আজকে যদি একটি পর্যায়ের মধ্যে শেয়ারবাজারকে ধরে রাখতে না পারি, তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই অধিকাংশ বিনিয়োগকারী চলে যাবেন।
আপনি যদি গত ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ করেন, কারা শেয়ার বিক্রি করেছে। বড় বড় বিনিয়োগকারীরা এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করেছে এ সময়ে। ফলে এসব শেয়ার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হাতে এসেছে। তাদের ক্ষমতা নেই এই শেয়ারগুলো ধরে রাখার। তাদের মধ্যে কনফিডেন্সের একটা সংকট দেখা গেছে। আমাদের আইসিবি, এসইসি, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সংস্থা, অর্থ মন্ত্রণালয়—সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে শেয়ারবাজারকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। যখন বাজারে দরপতন ঘটে, তখন ঋণের চাহিদা কমে আসে। শেয়ারবাজারকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে সবার স্বার্থে। শেয়ারবাজার টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে একে টিকিয়ে রাখার জন্য। আমি আশাবাদী, শেয়ারের দাম হয়তো কমবে, কিন্তু বাজার সম্প্রসারিত হবে।

শওকত হোসেন
সরবরাহ না বাড়িয়ে যে হারে চাহিদা বাড়ানো হয়েছে, সে প্রসঙ্গে অভিযোগ রয়েছে। শুধু এসইসি তো একা তদারক করে না, এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকও তদারক করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে তদারকি ব্যবস্থার সমন্বয় আছে কি না, সে বিষয় সম্পর্কে বলবেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি শাকিল রিজভী।

শাকিল রিজভী
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কথা স্বীকার করছি। আমি ডিএসইর সভাপতি হওয়ার প্রায় এক বছর পার হওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কোনো বৈঠক করতে পারিনি। কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি এই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে এসইসি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছি, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কোনো বৈঠক করা সম্ভব হয়নি।
আগে একসময় ছিল, যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ারবাজার নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। তখন বাজারের পরিধি ছোট ছিল। এত কম লেনদেন হতো ১০-২০ কোটি টাকা, যা জাতীয় অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলত না। কিন্তু বর্তমানে মার্কেট বড় হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি দরকার আছে। যদিও আমি বিশ্বাস করি, তদারকির ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো সিদ্ধান্তের কারণে যদি তা শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলে, তবে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা চাই, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিম্নস্তরের সঙ্গে বসেও আলোচনা করতে।
এখনো এসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনীতিবিদসহ—সবাই মিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করতে পারব বলে আমরা বিশ্বাস করি। আলোচনার মাধ্যমে একে অন্যের প্রতি যেসব ভ্রান্ত ধারণা আছে, তা দূর করা সম্ভব। আমরা অনেক অস্পষ্ট ধারণার মধ্যে রয়ে যাচ্ছি। যখন কোনো বিষয়ে অস্পষ্ট ধারণা থাকে, তখন কিন্তু নানা ধরনের গুজব ও অপপ্রচার ছড়ায়। তবে আমাদের সঙ্গে এসইসির নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আমাদের পাশে পাচ্ছি। আশা করছি, বাংলাদেশ ব্যাংককেও পাশে পাব। হঠাৎ করে বাজার বড় হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো ভাবতে পারে, এটি তাদের দায়িত্ব নয়, এটি এসইসির ব্যাপার।
এসইসি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখছে, তা আমাদের জানা নেই। আমরা চাহিদা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় শাখা অফিস করেছি, এটি সত্য কথা। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমে, তবে শেয়ারবাজারে সূচক বাড়ে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দশমিক ২৫ শতাংশ যদি বাড়ে, তবে পুঁজিবাজারেও সূচক বাড়ে। ২০০৭ সালে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ ছিল, এটি কিন্তু কমতে কমতে ৮ থেকে ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে এখান থেকে কিছু টাকা শেয়ারবাজারে এসেছে। মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে শেয়ারবাজারের প্রতি। ১০ টাকার শেয়ারকে ১০০ টাকা বানিয়ে মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। আমাদের রেমিট্যান্স সম্প্রতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে রেমিট্যান্স অনেকটা বেড়েছিল। অনেকে ভাবছেন, হয়তো যাঁরা বিদেশে আছেন, তাঁরা বেশি মজুরি পাচ্ছেন। আসলে প্রকৃত কারণ কিন্তু তা নয়। কারণ হচ্ছে, বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে প্রবাসী বাঙালিরা মনে করেছেন, নিজের দেশে কিছু করা উচিত। সে জন্য তাঁরা দেশে পুঁজি পাঠিয়েছেন। ওই টাকার বেশির ভাগ অংশ দিয়ে জমি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন তাঁরা। কিছু টাকা শেয়ারবাজারে এসেছে। এখন কিন্তু সে রকম আর মূলধন আসছে না। দেশে যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা ও শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে এনে তা প্রচার করা সম্ভব হয়, তবেই কেবল নতুন বিনিয়োগ আনা সম্ভব। বুক বিল্ডিং প্রথায় যদি সত্যিকার অর্থে কোম্পানিগুলোকে ফেয়ার প্রাইস দেওয়া না যায়, তবে তারা এগিয়ে আসবে না। বুক বিল্ডিং প্রথায় একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোম্পানির ফেয়ার প্রাইস করতে হবে, যেখানে বিনিয়োগকারীরাও ঠকবে না, স্পন্সরও ঠকবে না। কিছু কিছু বুক বিল্ডিংয়ের জায়গায় সিমিলার স্টকের প্রাইস প্রভাবিত করে ইন্ডিকেটিভ প্রাইস নির্ধারণ করা হচ্ছে। তারা যা করছে, বাজারে আসার আগে সিমিলার স্টকের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে ম্যানুপুলেশন হচ্ছে। যেহেতু বুক বিল্ডিং আইনে সিমিলার স্টক রেখেছে, সেহেতু সে সুযোগ নিচ্ছে। যেহেতু সিমিলার স্টকের প্রাইস বাড়লে ইন্ডিকেটিভ প্রাইজ বাড়ে, সেহেতু সর্বশেষ ছয় মাসের প্রাইসটি দেখবে এসইসি, এটি একটি অন্যতম কারণ।
বর্তমানে বাজারে ৬০ শতাংশ শেয়ার আছে, যেগুলোর মূল্য আয়ের অনুপাত (পিই রেশিও) ২০-এর নিচে আছে। এমন অনেক কোম্পানি আছে, যাদের পিই রেশিও ১০-এর কম। যাঁরা বুঝেশুনে বিনিয়োগ করেন, তাঁরা যদি দেখেন যে ৪৮টি কোম্পানি আসছে, তারা যদি ১০-২০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা পরিকল্পনা করেছে, তখন তাঁরা কিন্তু বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবেন না।
আমি যদি বিনিয়োগকারী হই, তবে আমি বাজারে আসব না। কারণ, এই বুক বিল্ডিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছে। কারণ, বাজারে ফেয়ার প্রাইস বলে সত্যিকার অর্থে কিছু নেই। আমি বুক বিল্ডিং চাই, কিন্তু ফেয়ার প্রাইস নিশ্চিত করতে হবে। বুক বিল্ডিং আর প্লেসমেন্ট যা-ই হোক, যদি আমরা বিনিয়োগকারীদের ঠকাই, তবে তাদের ধরে রাখা সম্ভব হবে না। যদি সত্যিকার অর্থে শেয়ারবাজারের মধ্যে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে, মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তবেই আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশের শেয়ারবাজার প্রকৃত স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। এসইসিকে তার তদারকি ব্যবস্থার জন্য যে আইনগুলো আছে, তা আবার নতুন করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, সেখানে কোনো ফাঁকফোকর আছে কি না, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। অডিট রিপোর্ট যদি ঠিক না হয়, তবে গোড়ায়ই গলদ রয়ে যাবে। শেয়ারের বেশি দাম নেওয়ার জন্য অনেক কোম্পানি তার আর্থিক প্রতিবেদনে শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। এটি করতে গিয়ে কোম্পানিগুলো আগের বছরের চেয়ে আয় বাড়িয়ে দেখাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর বিপরীতে খরচ কম দেখাচ্ছে। বাস্তবে আয় বাড়লে খরচও বাড়বে। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই। অডিট রিপোর্ট যদি ঠিক না হয়, তবে শেয়ারবাজার ঠিক করা সম্ভব নয়। বর্তমানে শেয়ারবাজার অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজার নিয়ে যেকোনো বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সবাইকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। গণমাধ্যমগুলো অতিরঞ্জিত সংবাদ বা টক শো প্রচার করছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। বিনিয়োগকারীদের সচেতন করার জন্য পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে একটি নতুন ইনস্টিটিউট হয়েছে। যারা সত্যিকার অর্থে শেয়ারবাজার বোঝে না, গণমাধ্যমের মাধ্যমে তাদের নিয়ে গণসচেতনতা গড়ে তোলা সম্ভব। সিডিবিএল অনেক বাধা সত্ত্বেও এখন খুব ভালোভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে চাই, ডিমিউচুয়ালাইজেশন হোক। তবে কখন, কী পর্যায়ে এটি করা হবে, তা আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। যেমন—ডিমিউচুয়ালাইজেশন করে নেপাল স্টক এক্সচেঞ্জ প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়েছে। করাচি স্টক এক্সচেঞ্জ কিন্তু সাত বছর ধরে ডিমিউচুয়ালাইজেশন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নিতে শিগগিরই আমরা মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে যাব, তাদের সঙ্গে কথা বলব। তবে তার আগে আমাদের শেয়ারবাজারকে আরও স্থিতিশীল করতে সময় নিতে হবে। এমন একটি বাজারের ধারণা দিলে হবে না যে ডিমিউচুয়ালাইজেশন হলে শেয়ারে দাম কখনো কমবে না, শুধু বাড়বে। কারণ শেয়ারের দামের সঙ্গে ডিমিউচুয়ালাইজেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জকে আদর্শ ধরে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। পেশাগত দক্ষ লোক দ্বারা আমাদের শেয়ারবাজার ভালোভাবে চলুক, সেটি আমরা নিজেরাও চাই। আমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, অবশ্যই একটা সময় পর আমাদের বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। ১৯৯৬ সালে ১০০টির মতো কোম্পানি, যাদের ডিলিস্টেট করেছি। কেন টাকা নিয়ে গিয়েছিল, কারা বাজারে এনেছিল—এগুলো কিন্তু একটি বড় ইস্যু। কারণ যেসব মার্চেন্ট ব্যাংক এ ধরনের কোম্পানি এনেছিল, তাদের কিন্তু এত দিন দেখা যায়নি। তাদের কয়েকজনকে ইদানীং আবার দেখা যাচ্ছে। সুতরাং তারা আবার নতুন নতুন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে আসছে। তাদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে। আমাদের এক্সপোর্ট বাড়ছে, সর্বশেষ ছয় মাসে ৩৮ থেকে ৪১ শতাংশ বেড়েছে। আমি আশাবাদী, অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এক্সপোর্ট বাড়া একটি ইতিবাচক দিক।

শেখ মর্তুজা আহমেদ
আমি ব্যবহারিকভাবে শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সুতরাং দু-একটি পয়েন্ট বলতে চাই। গত বছর যখন বাজার ঊর্ধ্বগতির দিকে গিয়েছিল, তখন প্রথম তিন মাসে প্রায় এক হাজার সূচক বাড়ে। দ্বিতীয় তিন মাসে প্রায় ৫০০ সূচক বাড়ে। তৃতীয় তিন মাসে আবার প্রায় এক হাজার সূচক বেড়েছিল। সর্বশেষ তিন মাসে প্রায় দুই হাজার সূচক বেড়েছিল। কিন্তু যেভাবে মার্কেট বেড়েছিল, তখন কেউ কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। যদি বর্তমান পরিস্থিতি উত্তরণ করতে চাই, তবে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে ফান্ড সরবরাহের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে কনফিডেনস। কারণ, ফান্ড থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছে না। আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে। গণমাধ্যমকে অনুরোধ করব, একদিকে আমরা কনফিডেনস লেভেল বাড়ানোর চেষ্টা করছি, ঠিক তার পরদিন এমন একটি খবর প্রকাশ করা হলো, যা আবার ভীতি সঞ্চার করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে একটু সতর্ক হই, যেকোনো মন্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে। আমরা যেন ইতিবাচক কথাবার্তা বলি বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের শিক্ষা হয়েছে, যারা ব্রোকার হাউস, মিউচুয়াল ব্যাংক আছে, তাদের নিজস্ব একটা ফান্ড করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার না হতে হয়। আমি মনে করি, স্টক মার্কেট কখনো ধ্বংস হবে না (স্টক মার্কেট নেভার ডাই)।
বিনিয়োগকারীদের বলতে চাই, ভালো শেয়ারগুলো ধরে রাখুন। ভবিষ্যতে ভালো শেয়ারগুলোর দাম বাড়বে। বর্তমান বাজারে ৮০ শতাংশ হচ্ছে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী। গত বছর ১৪ লাখ নতুন বিনিয়োগকারী এসেছেন, যাঁরা এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাঁরা মনে করেন, আজকে কিনবেন, কালকে বিক্রি করবেন। তাঁরা দ্রুত লাভবান হতে চান। যখন বাজার পড়তে থাকে, তখন তাঁরা শেয়ার বিক্রি করেন, আবার যখন বাজার বাড়ে, তখন তাঁরা বেচেন না। এই অশিক্ষিত বিনিয়োগকারীদের জন্য এ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি সচেতন করতে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

শওকত হোসেন
ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের দুই সভাপতি কিছু দিন আগে বললেন, বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে। এর কয়েক দিন পর একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বললেন, বাজার মোটেই অতিমূল্যায়িত হয়নি। তার পরদিনই সূচক আড়াই হাজার পয়েন্ট বেড়ে গেল। আমরা গণমাধ্যম বললে হয়তো বাজার কিছুটা পড়তে পারে। কিন্তু আমরা বাজার তুলতে পারি না। সুতরাং যাদের কথায় মানুষ লাফ দিয়ে পড়ে, তাদের নিজেদের আরেকটু সচেতন হওয়া দরকার। এতক্ষণ আলোচনার পর যদি কারও কোনো পরামর্শ বা কথা থাকে, তা বলার জন্য অনুরোধ করছি।

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
আজকের আলোচনায় বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলো থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, সেসব বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা হয়েছে।
আমাদের বিনিয়োগকারীদের পরিষ্কারভাবে বোঝাতে হবে যে এটি প্রত্যাশা করা উচিত নয়, শেয়ারবাজার ক্রমাগত শুধু উঠতেই থাকবে। কোনো না কোনো সময় বাজার নামবে। আপনি যদি ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, তবে দীর্ঘ মেয়াদে অবশ্যই আপনি লাভবান হবেন। আপনাকে শেয়ার ধরে রাখার ক্ষমতা নিয়েই বাজারে আসা উচিত। উত্থান-পতন যা-ই হোক না কেন, আমাদের বাজার এখনো বিনিয়োগযোগ্য। বিনিয়োগকারীদের একটু সতর্ক হতে হবে, তারা যেন সব শেয়ার না কেনে, আবার সব শেয়ার বিক্রিও না করে। যেহেতু বাজারে নতুন কিছু আইপিও আসছে, যেগুলো বাজারে সূচক বাড়াতে সহায়তা করবে। নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে সমন্বয়, বাজারবান্ধব নীতি গ্রহণ করা, ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করা—এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক হতে হবে।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী
নতুন ব্যবসা শুরু করতে হলে শিল্প ব্যাংকে যেতে হয় দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য। সেখানে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সুতরাং আমাকে কমার্শিয়াল ব্যাংকে যেতে হয় দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য। কিন্তু সেখান থেকেও ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন। সুতরাং মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যদি নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান চান, শিল্পায়ন চান, তাহলে শেয়ারবাজারের বিকল্প কিছু নেই। শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানিও আছে, খারাপ কোম্পানিও আছে। খারাপ কোম্পানির জন্য ভালো কোম্পানিগুলো বঞ্চিত হবে, তা কিন্তু ঠিক নয়। শিল্পায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশ অনেক ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। আমাদের প্রায় তিন কোটি লোক বেকার রয়েছে। শিল্পায়ন করার জন্য শেয়ারবাজারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আমাদের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে সবার সামনে।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী
বাজারে সূচক একপর্যায়ে প্রায় নয় হাজারের কাছে চলে গেছে। তখন সত্যিকার অর্থে বাজারটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তবে ইতিমধ্যে বাজার প্রায় ২০ শতাংশের মতো সংশোধিত হয়ে গেছে। সুতরাং বাজারের অবস্থা এমন নয় যে আতঙ্কিত হতে হবে। বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে হবে, আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। শেয়ারবাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। যে শেয়ারগুলো যুক্তিসংগত মূল্যে তাঁরা কিনেছেন, তাঁরা যদি আতঙ্কিত হয়ে বিক্রি করে দেন, তবে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

আব্দুল কাইয়ুম
আজকে আলোচনার মাধ্যমে শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সমস্যাগুলো কী এবং তা সমাধানে কী করণীয়, তার নির্দেশনা পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকার ব্যাপারে যে আহ্বান করা হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা সজাগ থাকব। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.