ক্যামোফ্লেজ by নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

টেনিদা কুলপির শালপাতাটা শেষবার খুব দরদ দিয়ে চেটে নিলে, তারপর সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ক্যাবলার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললে, ‘তবে শোন! আমি তখন যুদ্ধ করতে করতে আরাকানের এক দুর্গম পাহাড়ি জায়গায় চলে গেছি। জাপানিদের পেলেই এমন করে ঠেঙিয়ে দিচ্ছি যে ব্যাটারা “ফুজিয়ামা টুজিয়ামা” বলে ল্যাজ তুলে পালাতে পথ পাচ্ছে না। ১৩ নম্বর ডিভিশনের আমি তখন কম্যান্ডার—তিন-তিনটে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়ে গেছি। টিড্ডিমে তখন পেল্লায় যুদ্ধ হচ্ছে। জাপানি পেলেই পটাপট মেরে দিচ্ছি। জাপানিদের যখন প্রায় নিকেশ করে ছেড়েছি, তখন হঠাৎ একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে গেল। আর সেইটেই হলো আমাদের আসল গল্প।’

‘বলো, বলো!’ আমরা তিনজন সমস্বরে প্রার্থনা জানালাম।
টেনিদা আবার শুরু করল, ‘আমার একটা কুকুর ছিল। তোদের বাংলাদেশের ঘিয়ে ভাজা নেড়িকুত্তো নয়, একটা বিরাট গ্রে-হাউন্ড। যেমন গাঁক গাঁক ডাক, তেমনি তার বাঘা চেহারা। আর কী তালিম ছিল তার! ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে দু পায়ে খাড়া হয়ে হাঁটতে পারত। বেচারা অপঘাতে মারা গেল। দুঃখ হয় কুকুরটার জন্যে, তবে মানুষের জন্যে মরেছে, ব্যাটা নির্ঘাত স্বর্গে যাবে।’
‘কী করে মরল?’ হাবুল প্রশ্ন করল।
‘একদিন বিকেলবেলা, হাতে তখন কোনো কাজ নেই—আমি সেই কুকুরটাকে সঙ্গে করে বেড়াতে বেরিয়েছি। পাহাড়ি জঙ্গলে বেড়াচ্ছি হাওয়া খেতে। দু দিন আগেই জাপানি ব্যাটারা ওখান থেকে সরে পড়েছে। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। কুকুরটা আগে আগে যাচ্ছে আর আমি চলেছি পিছনে। কিন্তু ওই বেঁটে ব্যাটাদের পেটে পেটে শয়তানি। দিলে এই টেনি শর্মাকেই একটা লেঙ্গি কষিয়ে। যেতে যেতে দেখি পাহাড়ের এক নিরিবিলি জায়গায় এক দিব্যি আমগাছ। যত না পাতা, তার চাইতে ঢের বেশি পাকা আম তাতে। একেবারে কাশির ল্যাংড়া। দেখলে নোলা শকশক করে ওঠে।’
‘আরাকানের পাহাড়ে কাশির ল্যাংড়া!’ আমি আবার কৌতূহল প্রকাশ করে ফেললাম।
‘দেখ প্যালা, ফের বাধা দিয়েছিস—একটা চাঁটি হাঁকিয়ে—! হ্যাঁ, যা বলছিলাম। খাস কাশির ল্যাংড়া। কুকুরটা আমাকে একটা চোখের ইঙ্গিত করে বললে, গোটা কয়েক আম পাড়ো।’
ক্যাবলা বললে, ‘কুকুরটা আম খেতে চাইল?’
‘চাইলই তো। এ তো আর তোদের এঁটুলি-কাটা নেড়িকুত্তো নয়, সেরেফ বিলিতি গ্রে-হাউন্ড। আম তো আম, কলা, মুলো, গাজর, উচ্ছে, নালতে শাক, সজনেডাঁটা—সবই তরিবত করে খায়। আমি আম পাড়তে উঠলাম! আর যেই ওঠা—!’ টেনিদা থামল।
‘কী হলো?’
‘যা হলো তা ভয়ংকর। আমগাছটা হঠাৎ জাপানি ভাষায় ফুজিয়ামা-টুজিয়ামা বলে ডালপালা দিয়ে আমায় সাপটে ধরলে। তার পরেই বীরের মতো কুইক মার্চ। তিন-চারটে গাছও তার সঙ্গে সঙ্গে নিপ্পন বানজাই বলে হাঁটা আরম্ভ করলে!’
‘সেকি!’ আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, ‘গাছটা তোমাকে জাপটে ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলে!’
‘করলে তো। আরে, গাছ কোথায়? স্রেফ ক্যামোফ্লেজ।’
‘ক্যামোফ্লেজ! তার মানে?’
‘ক্যামোফ্লেজ মানে জানিসনে? কোথাকার গাড়ল সব!’ টেনিদা একটা বিকট মুখভঙ্গি করে বললে, ‘মানে ছদ্মবেশ। জাপানিরা ও-ব্যাপারে দারুণ এক্সপার্ট ছিল। জঙ্গলের মধ্যে কখনো গাছ সেজে, কখনো ঢিবি সেজে ব্যাটারা বসে থাকত। তারপর সুবিধে পেলেই—ব্যস্!’
‘সর্বনাশ! তারপর?’
‘তারপর?’ টেনিদা একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হাসল, ‘তারপর যা হওয়ার তাই হয়ে গেল। আমাকে ধরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেল। ক্যামোফ্লেজটা খুলে ফেললে, তারপর বত্রিশটা কোদালে কোদালে দাঁত বের করে পৈশাচিক হাসি হাসল। কোমর থেকে ঝকঝকে একটা তলোয়ার বের করে বললে, মিস্টার, উই উইল কাট ইউ!’
‘কী ভয়ানক!’ ক্যাবলা আর্তনাদ করে বললে, ‘তুমি বাঁচলে কী করে?’
‘আর কি বাঁচা যায়? বললে, নিপ্পন বানজাই—মানে জাপানের জয় হোক। তারপর তলোয়ারটা ওপরে তুলে—!’
হাবুল অস্ফুট স্বরে বললে, ‘তলোয়ারটা তুলে—?’
‘ঝাঁ করে এক কোপ! সঙ্গে সঙ্গে আমার মুণ্ডু নেমে গেল। তারপর রক্তে রক্তময়!’
‘ওরে বাবা!’ আমরা তিনজন একসঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম, ‘তবে তুমি কি তাহলে—।’
‘ভূত? দূর গাধা, ভূত হব কেন? ভূত হলে কারও কি ছায়া পড়ে? আমি জলজ্যান্ত বেঁচেই আছি—কেমন ছায়া পড়েছে, দেখতে পাচ্ছিস না?’
আমাদের তিনজনের মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল।
হাবুল অতিকষ্টে বলতে পারল, ‘মুণ্ডু কাটা গেল, তাহলে তুমি বেঁচে রইলে কী করে?’
‘হুঁ হুঁ, আন্দাজ কর দেখি।’ টেনিদা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
‘কিছু বুঝতে পারছি না।’ কোনোমতে বলতে পারলাম আমি। টেনিদা বলে ভুল করে তাহলে কি এতকাল একটা স্কন্ধ-কাটার সঙ্গে কারবার করছি?
‘দূর গাধা!’ টেনিদা বিজয়গর্বে বললে, ‘কুকুরটা পালিয়ে এল যে!’
‘তাতে কী হলো?’
‘তবু বুঝলি না? আরে এখানেও যে ক্যামোফ্লেজ!’
‘ক্যামোফ্লেজ!’
‘আরে ধ্যাৎ! তোদের মগজে বিলকুল সব ঘুঁটে, এক ছটাকও বুদ্ধি নেই। মানে আমি টেনি শর্মা—চালাকিতে অমন পাঁচ শ জাপানিকে কিনতে পারি। মানে আমি কুকুর সেজেছিলাম, আর কুকুরটা হয়েছিল আমি। বেঁটে ব্যাটাদের শয়তানি জানতাম তো! ওরা যখন আমার, মানে কুকুরটার মাথা কেটে ফেলেছে, সেই ফাঁকে লেজ তুলে আমি হাওয়া! আর তার পরেই পেলাম ৩ নম্বর ভিক্টোরিয়া ক্রসটা!’ (সংক্ষেপিত)
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। জন্ম অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুরে ১৯১৮ সালে। মৃত্যু ১৯৭০ সালে কলকাতায়।

No comments

Powered by Blogger.