বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৩৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল হাকিম, বীর প্রতীক সাহসী গেরিলাযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর সদর থেকে গেরিলাযোদ্ধা (স্বল্প প্রশিক্ষিত) যাঁদের বাড়ি যে এলাকায়, তাঁদের সে এলাকায় পাঠানো হতো।


তাঁরা নিজ এলাকায় গোপনে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর নানা ধরনের প্রচলিত-অপ্রচলিত আক্রমণ পরিচালনা করতেন। এসব দলের সঙ্গে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরও সংযুক্ত করা হতো।
এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নম্বর থেকে আবদুল হাকিমসহ একদল মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হয় নরসিংদী ও গাজীপুর জেলায়। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি দলে বিভক্ত। তাঁরা নরসিংদী-গাজীপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে দুঃসাহসিক কিছু অপারেশন করেন। একের পর এক অপারেশনের মাধ্যমে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চলাচল ব্যাহত ও অনিশ্চিত করে দেন।
১৯৭১ সালে কালিয়াকৈরের বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান। গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কালিয়াকৈর উপজেলা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের অবস্থান ছিল পুরাতন থানা কমপ্লেক্সে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এর অবস্থান। তাদের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিল একদল রাজাকার। ২২ অক্টোবর সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা এক অপারেশন পরিচালনা করেন।
সেদিন রাত আনুমানিক ১০টায় আবদুল হাকিমসহ মুক্তিযোদ্ধারা চাপাইর ব্যাপারিপাড়া হাইস্কুল থেকে তুরাগ নদ অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনা দলের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালান। এতে পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত হয়ে পড়ে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই হকচকিত অবস্থা কাটিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
এরপর দুই পক্ষে ব্যাপক গুলিবিনিময় হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে সেখানে যুদ্ধ চলে। আবদুল হাকিম ও তাঁর সহযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা ব্যর্থ হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে ও বিপুল রসদে সজ্জিত ছিল। তুলনায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের রসদ ছিল কম।
রাত সাড়ে তিনটার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি প্রায় শেষ হয়ে যায়। তখন পাকিস্তানিরা বেশ আধিপত্য বিস্তার করে। যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানিদের পক্ষে চলে যায়। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাৎপসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। অবশেষে রাত চারটার দিকে তাঁরা পিছে হটে যান। তবে তাঁদের আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এবং রাজাকার দলের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা পরে খবর নিয়ে জানতে পারেন, তাঁদের আক্রমণে পাঁচজন রাজাকার ও ছয়জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। আক্রমণের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সঠিক নিশানায় পড়ে। বিস্ফোরণে দুটি বাংকার সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মাত্র দু-তিনজন আহত হন।
আবদুল হাকিম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশ ইউনিটে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। পরে তাঁকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গাজীপুর জেলায় পাঠানো হয়। কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর এবং নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল হাকিমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫৫ ।
আবদুল হাকিম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে। বাবার নাম ফয়েজউল্লাহ মোল্লা, মা অজুফা খাতুন। স্ত্রী জোবেদা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে, পাঁচ ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক, আবদুল হান্নান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.