উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক : দেব মুখার্জি by সোহরাব হাসান

দেব মুখার্জি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর সামনে রেখে প্রথম আলো মুখোমুখি হয় বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবিরের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো :  ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরকে কীভাবে দেখছেন?
দেব মুখার্জি : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন একসময়ে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন, যখন দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের যে উদ্বেগ ছিল, তা দূর করতে বাংলাদেশ কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বহু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্থলসীমান্ত চুক্তি যার সাম্প্রতিক ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নরেন্দ্র মোদির দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আশা করব, এই সফর বাংলাদেশ-ভারতের বর্তমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সহযোগিতা ও অংশীদারত্বের উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাবে।
প্রথম আলো : মোদির সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা সংযোগ (কানেকটিভিটি)। বহু বাংলাদেশি মনে করে এতে ভারতই বেশি লাভবান হবে।
দেব মুখার্জি : আমি মনে করি, সফরের উদ্দেশ্য বহুমাত্রিক। দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর ও জোরদার করাই এ সফরের উদ্দেশ্য। সংযোগ (কানেকটিভিটি) অবশ্যই ভারতের স্বার্থের একটি এলাকা। কাঠমান্ডুতে গত সার্ক শীর্ষ বৈঠকে দক্ষিণ এশিয়ার সব ভ্রাতৃপ্রতিম দেশই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। আপনার মনে হয়তো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে যাওয়ার বিষয়টি রয়েছে, সেটি অবশ্যই ভারতের স্বার্থ। এটি বাংলাদেশেরও স্বার্থরক্ষা করবে, তারা পণ্য পরিবহনের জন্য যেমন ফি পাবে, তেমনি তার অবকাঠামোরও উন্নয়ন হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ভারতের মধ্যে দিয়ে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সংযোগ (কানেকটিভিটি) সুবিধা লাভ করেছে। অংশীদারেরা ঐকমত্য পোষণ করলে পশ্চিমের দিকেও এটা সম্প্রসারিত হতে পারে। আমি মনে করি না, সহযোগিতার ক্ষেত্রে কেউ অধিক সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি চিন্তা করে। এটি দেখতে হবে সামগ্রিক সম্পর্কের ভিত্তিতে।
প্রথম আলো : দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা প্রায়ই নন-ট্যারিফ বাধার অভিযোগ এনে থাকেন।
দেব মুখার্জি : বাণিজ্যবৈষম্য ও নন-ট্যারিফ বাধা দুটো ভিন্ন বিষয়। আমি এটা বুঝতে অপারগ যে কোনো দেশ বাণিজ্যবৈষম্যের অভিযোগ আনতে পারে। আমরা এখন পণ্য বিনিময়ের যুগে নেই। কয়েক দশক আগ পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে যা ছিল, সেটাও এখন নেই। প্রতিটি দেশই পণ্য আমদানি করে তার প্রয়োজনের ভিত্তিতে, যেখান থেকে সে সুবিধা পাবে। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বিরাট বাণিজ্যবৈষম্য আছে, যেখান থেকে আমরা তেল আমদানি করে থাকি। আমি যদি ভুল না করে থাকি বাংলাদেশ ভারত থেকে অনেক পরিমাণে তুলা ও সুতা আমদানি করে থাকে। এটা তাদের রপ্তানির আয় বাড়ায়। বাজার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলে, বাংলাদেশ পাকিস্তান বা উজবেকিস্তান বা অন্য কোথাও থেকে এটি আমদানি করবে। বেলজিয়ামের সঙ্গেও ভারতের বিরাট বাণিজ্যবৈষম্য আছে। যেখান থেকে আমরা কাচা হীরক আমদানি করি এবং পরবর্তীকালে তা পরিশীলিত আকারে অন্যান্য
দেশে রপ্তানি করি। সেখান থেকে আমরা মুনাফাও করি অনেক। যদি সমসুযোগ থাকে তাহলে অভিযোগের অবকাশ থাকে না। তবে আমি এটাও মনে করি, বাণিজ্যবৈষম্য নিয়ে কোনো দেশই সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, সমসুযোগ ও বৈষম্যহীন পরিস্থিতি ধরে রাখা। রপ্তানিকারক দেশকে তার পণ্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে রপ্তানি করতে হবে।
আপনি যে নন-ট্যারিফ বাধার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ যদি মনে করে, তাদের উৎপাদিত পণ্য ভারতীয় বাজারে প্রবেশে অন্যায্যভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তাহলে সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তার প্রতিকার হওয়া উচিত। আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই, ভারত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পর ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
বাণিজ্য কখনো প্রতিশ্রুতি দেয় না, ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করে না। বাজারব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি ওঠানামা করে। বাণিজ্য দুই দেশের মধ্যে অংশীদারি ও আন্তনির্ভরতার বন্ধন তৈরি করে না। বাণিজ্য বৃদ্ধি অবশ্যই একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো, ভোক্তা ও ব্যবসায়ীর চাহিদা অনুসারে এটা ঘটে থাকে। আমার মত হলো, আমাদের বিনিয়োগের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। এটা দুই অংশীদারের উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করে তাদের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে। নানা কারণে বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি নয়। ভারত সরকারের উচিত ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করা। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ও শিল্পের উচিত হবে বড় আকারে ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো। বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ কেবল অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য পণ্য উৎপাদন করবে না বরং তা ভারতেও শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে রপ্তানি হবে।
প্রথম আলো : গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি যখন সই হয়, তখন আপনি বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। এরপর ১৯ বছর পর স্থলসীমান্ত চুক্তিটি ভারতীয় সংসদে অনুমোদন পেল। এত দীর্ঘ সময় লাগল কেন?
দেব মুখার্জি : অনুমোদনের জন্য সীমানা চিহ্নিতকরণের নানা জটিল ও কষ্টসহিষ্ণু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মাঠের পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির কিছু সংশোধনও করতে হয়েছে, যা ২০১১ সালের প্রটোকলে সংযুক্ত করা হয়েছে। সংসদে চুক্তির নবায়ন না হওয়া সব সময় খবর হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোনো দেশের সরকারের পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দুই দেশের সম্পর্কও সব সময় এমন অবস্থায় ছিল না, যাতে এটি আনা যায়। এ ছাড়া তিন বিঘাসহ কিছু এলাকা নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধিতাও ছিল। আমার ধারণা, ২০১০ সালেই প্রথম এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সামনে নিয়ে আসা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের নির্বোধ দায় ঘোচানোর জন্য দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনীতিক এবং মাঠপর্যায়ে যাঁরা কাজ করেছেন, আমি তাঁদের ধন্যবাদ দেব।
প্রথম আলো :দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন কী কী বিষয় অগ্রাধিকার পেতে পারে? পানিবণ্টন, জ্বালানি সহযোগিতা বা অন্য কিছু?
দেব মুখার্জি : দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমি আশা করব, দুই সরকারপ্রধান ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট অন কো-অপারেশন ফর ডেভেলপমেন্ট অনুসরণ করবেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে এটা স্বাক্ষরিত হয়। এতে পারস্পরিক সহযোগিতার সব ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অবকাঠামো ও যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। জ্বালানি ক্ষেত্রেও ইতিমধ্যে ভালো অগ্রগতি হয়েছে, এটিকে আরও বাড়ানো যেতে পারে।
নদীর পানিবণ্টনের ক্ষেত্রে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান পেতে কয়েক দশক লেগেছে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে। একইভাবে আমি আশা করব, তিস্তার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। কিন্তু আমরা ৫০টির বেশি নদীর পানিবণ্টনের সমাধান বের করতে শত বছর অপেক্ষা করতে পারি না। প্রকৃত ঘটনা হলো, বাংলাদেশ–ভারত উভয়েরই পানির সমস্যা আছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় এর কৃষি, নৌপরিবহন, মৎস্য, বাস্তুতন্ত্র, লবণাক্ততা রোধের ব্যাপারে নদীর ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে ভারতের ৩০ কোটি মানুষ গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার ওপর নির্ভরশীল। এই সংখ্যাটা বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। পানি ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। দুই দেশকেই খুঁজে বের করতে হবে, কীভাবে পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। এসব নদীর পানির একটা অংশ আসে নেপাল, চীন ও ভুটান থেকে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের ২০ শতাংশ আসে চীনের তিব্বত থেকে। পানিবণ্টনে এসব দেশের সক্রিয় অংশগ্রহণও থাকা দরকার। যেটা আমি আগেও বলেছি, সে ক্ষেত্রে ভারত এর পুরো মালিকানা দাবি করতে পারে না। যদিও প্রতিবেশী দেশগুলো এমনটিই মনে করে। আবার বাংলাদেশও বলতে পারে না, চিরদিন তারা একই রকম প্রবাহ পাবে। এখানে দেওয়া-নেওয়া থাকতে হবে, একে অপরের সমস্যা বুঝতে হবে।
প্রথম আলো : বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং বলেছেন, শিগগিরই তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান হবে। এই শিগগিরই কবে শেষ হবে?
দেব মুখার্জি : আমি আন্তরিকভাবে আশা করি খুব দ্রুত।
প্রথম আলো : সীমান্তে বেসামরিক নাগরিক হত্যা বন্ধ হচ্ছে না কেন?
দেব মুখার্জি : সীমান্তে হত্যা গভীর বেদনাদায়ক এবং এটি হওয়া উচিত নয়। আমরা কিশোরী ফেলানীর মৃত্যুর বিষয়টি অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে স্মরণ করি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলি ব্যবহার না করার নির্দেশ দেওয়ার পর আমার বিশ্বাস সীমান্তে হতাহতের ঘটনা অনেক কমেছে। সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ের নাগরিক মারা যাচ্ছে। সীমান্তের দুই পাশে মাফিয়া চক্রের চোরাচালান হচ্ছে সমস্যার মূল। গরুর পাশাপাশি মাদক ও ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র বাংলাদেশে চোরাচালান হয়ে যাচ্ছে। দুই সরকারের দায়িত্ব এই চোরাচালান বন্ধ করা। চোরাচালানিরা সব সময় সশস্ত্র থাকে এবং প্রায়ই সীমান্তরক্ষীদের ওপর হামলা চালায়। সমস্যার মূল কারণ দূর না করতে পারলে আমি মনে করি না সীমান্তের সহিংসতা বন্ধ হবে। তবে গুলি ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত। কিন্তু আমাদের আলোচনায় এটা মনে হওয়া উচিত নয় যে সীমান্তে যারা অপরাধ সংঘটিত করে, আমরা তাদের সমর্থন করছি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ
দেব মুখার্জি : ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.