দুই খেলার দুই দিন ইজ্জতে আলপিন

বিশ্বকাপের হিসাব-নিকাশে ওলট-পালট। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ, যা কিছু আছে তার সবকিছুই আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে। দুনিয়াজোড়া কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীর মন ভেঙে খান খান। পছন্দনীয় দলপ্রীতি আকাশ থেকে আছড়ে মাটিতে শুধু পড়েইনি, একেবারে মাটির তলদেশে পোঁতা হয়ে গেছে। যে দুটি দলকে নিয়ে এত কিছু, এত পতাকা কেনা-কিনি, খরচ-খরচা, এত রেষারেষি, তর্কবিতর্ক, রঙ্গ-রসিকতা; তারা নিজেদের তো বটেই, সমর্থকদেরও সমস্ত গর্ব খর্ব করে দিয়ে মাঠ ছেড়ে এখন শুধুই দর্শকের ভূমিকায় চলে গেছে (যদি আদৌ দেখার মুড থেকে থাকে)।
দল দুটি এমন গো-হারা হারবে পচা খেলা খেলে, তা তাদের একগুঁয়ে সমর্থকেরা জীবনেও ভাবেনি। হারেরও তো কিছু রকমফের থাকে নামীদামি দলগুলোর ক্ষেত্রে। হয় আচমকা না-ভাবা একটি গোল খেয়ে ফেলে কোনোভাবেই আর শোধ না করতে পারা, নচেৎ টাইব্রেকারে গিয়ে দুর্ভাগ্যের কাছে ধরা খেয়ে যাওয়ার মতো হারের তবু কিছু সান্ত্বনা থাকে। মনকে প্রবোধ দেওয়ার উপায় থাকে। ভাবা যায় যে ‘খেলায় এমন ঘটতেই পারে।’ যেমন ঘটল ঘানার ব্যাপারে। কী দারুণ খেলাটাই খেলল। শেষে টাইব্রেকারে গিয়ে জেতা গেইম হেরে গেল। এ ক্ষেত্রে প্রবোধ এই যে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়া একমাত্র আফ্রিকার দল হিসেবে প্রচণ্ড চাপে নার্ভাস তো হতেই পারে। কিন্তু পুরো খেলায় একটুও ছেড়ে কথা কয়নি। প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে।
এই খেলার দিন আমি ঘানার সমর্থক ছিলাম। তো, আমার মনে হয়েছে, হারের পেছনে রেফারির ভুল সিদ্ধান্ত যথেষ্ট কাজ করেছে। বিশেষ করে শেষ মিনিটের গোলটি না দিয়ে পেনাল্টি দেওয়ার ব্যাপারে। গোলপোস্টে ঢোকার সময় উরুগুয়ের এক খেলোয়াড় হাত দিয়ে বল বের করে দেওয়ার পর গোল ঘোষণা দেওয়াই সমীচীন ছিল। কিন্তু রেফারি পেনাল্টি দিয়েছিলেন। সেটাকে ফলপ্রসূ করতে পারেনি ঘানা। আমি অবশ্য ঘানাকেই জয়ী মনে করি। যদিও শেষমেশ হারতে বাধ্য হয়েছে। আর টাইব্রেকার ব্যাপারটি আমার খুব পছন্দনীয় নয়। নিয়মটি যেন—এই রকমের করে ভাবা যে নব্বই মিনিটের পর আরও আধঘণ্টা দেওয়ার পরও যখন কেউ কোনো হার-জিত করতে পারিসনি, তো নে, এবার বুক ধুঁকধুঁকি করা খেলা খেল। হারতে একজনকে হবেই। যাবি কোথায়? মন খারাপ করা ভুল করতেই হবে।
হেরে যাওয়ার পর ব্রাজিলের সমর্থকদের শোকে মন ধসে পড়া ব্যাপারটিতে কিছুটা হলেও খুঁটির ঠেকা দিতে পেরেছে আর্জেন্টিনার হার। দুয়ো খাওয়া ব্রাজিল সমর্থকেরা বিশ্বজুড়েই জার্মানির পক্ষে দুয়ো ধরে জবাব দিয়েছে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার এত বড় সুযোগ তো আসলে সহজে আসবে না। তো একজন বললেন, ‘ব্রাজিলের হারা দেইখা মনটা কইল “হায়” ব্রাজিল কী করলি। আর আর্জেন্টিনার অমন ব্যাক্কল-হারা দেইখা কইতে হইতাছে হায়-হায়, নিজে তো ডুবলি-ডুবলি, আমাগো ইজ্জতে এক্কেরে গজাল-পেরেক মাইরা গেলি!’
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার খেলার দুই দিনই কাকতালীয়ভাবে দাওয়াতে ছিলাম। ব্রাজিলের দিন দাওয়াতে উপস্থিত শিল্পীদের সবাইকে দেখলাম হল্যান্ডবিরোধী। সবাই বেশ নিশ্চিন্ত হয়েই খাওয়ার প্লেটে মনোযোগী ছিলেন যে ব্রাজিল জিতবেই। ব্যাপারটা সলিড হলো আরও, যখন ব্রাজিলই প্রথম গোলটা দিল। কিন্তু সবার খাওয়া শেষ না হতেই ব্রাজিল পরপর গোল খাওয়া-দাওয়া সেরে, হেরে ভূত। তা দেখে এতক্ষণ ব্রাজিলের সমর্থনে কেমোফ্লাজ করে থাকা আমাদের এক শিল্পী আরও কয়েক টুকরো মাংস প্লেটে তুলে নিয়ে ঘোষণা দিল যে সে আসলে হল্যান্ডের সমর্থক। সবার হইচইয়ে চুপ করে ছিল। বললাম, ‘হল্যান্ডের সাপোর্টার কবে থেকে?’ বলল, ‘স্যার, ওরা আসলে যেমনই খেলুক, লোক ভালো। সেবার কত সহজে যে ভিসা দিয়ে দিল, তুলনা হয় না। এক ডাচ কাপল তো ছবিও কিনেছে!’
আর্জেন্টিনার খেলার দিন লেডিস ক্লাবে বিয়ের দাওয়াত। বড় স্ক্রিনে খেলা দেখার ব্যবস্থা করা ছিল। তাতে চোখ রাখি, না কাচ্চিতে চোখ রাখি অবস্থা। কিন্তু দেখা গেল, একসময় কাচ্চি বিরিয়ানিতেই মনোযোগ দিল সবাই। স্ক্রিনের দিকে আর তাকালই না। মেহমানরা বেশির ভাগই পুরান ঢাকার। তাঁদের একজন বললেন, ‘ব্যাটারা একদিনে পইচা গেল কেমনে? ট্যাকা খাইছে থার্ড ওয়ার্ল্ডের তো!’ আরেকজন বললেন, ‘নিজেগো সেরা ভাবলে যা হয়!’
যাই হোক, হট ফেবারিটরা নেই। খেলার উত্তাপের পারদ বাংলাদেশে এখন থার্মোমিটারের একেবারে নিচের দাগে। এখন জার্মানি, হল্যান্ড আর স্পেন—এই তিন ইউরোপীয়র মধ্যে টিকে আছে একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকান উরুগুয়ে। তাদেরও বিশ্বকাপ জেতা আছে। অতএব, এবার অন্তত ফাইনাল খেলুক তেমন প্রত্যাশায় আমাদের সমর্থন থাকবে। তবে বেশির ভাগ সম্ভাব্য সমর্থক যে জার্মানির তা বলাই বাহুল্য। থাকতেই পারে। কারণ যে খেলা দেখাল রোবটের মতো করে, মেশিন মেশিন ভাব দিয়ে তা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তো রোখা মুশকিল। অবশ্য আমার ধারণা, হল্যান্ডের খেলা সুন্দর বলে তারা তাই দেখাতে গিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কাতারে পড়ে যেতে পারে। স্পেনও তাই। তবে বহুবার হল্যান্ড বুড়ি-ছোঁয়ার কাছাকাছিতে গিয়ে বাদ হয়েছে। এবার নিশ্চয়ই আর হাতছাড়া করতে চাইবে না। দেখা যাক কেমন করে।

No comments

Powered by Blogger.