রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির চতুর্থ বর্ষ: কান্না থামেনি আহত শ্রমিকদের by হাফিজ উদ্দিন



২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল ভয়াবহ রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। দেশের ইতিহাসে এ এক নির্মম ট্র্যাজেডি। রানা প্লাজা ধসের চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও কান্না থামেনি আহত শ্রমিকদের। কাটেনি দুঃখ-দুর্দশাও। সেই দিনের স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আহত শ্রমিকদের। সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার একশ’ ৩৭ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ২ হাজার চারশ’ ৩৮ জন। নিখোঁজ রয়েছে প্রায় তিন শ’ শ্রমিক। আহতদের মধ্যে একজন  হালিমা বেগম (৫২) গত শুক্রবার সাভার উপজেলার ছায়াবিথী এলাকায় দোকানে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তার ডান পা। সে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেন না। ক্র্যাচে ভর দিয়ে তাকে চলতে হয়। তবে তিনি বাঁচার তাগিদে সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন। ক্ষতিপূরণের যে সামান্য টাকা পেয়েছিলেন, তাই দিয়ে সাভার ছায়বিথী এলাকার জাহাঙ্গীরনগর হাউজিং সোসাইটির  গেটের সামনে একটি দোকান দিয়েছেন। ওই  দোকানের আয় দিয়েই চলে তাদের সংসার। হালিমা জানান, অনেক আগেই তার স্বামী হাবিবুর রহমান মারা যান। একমাত্র ছেলে রফিকুল ইসলামের কষ্টের কথা ভেবে তিনি বিয়েও করেননি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় তিনি পঙ্গু হয়ে গার্মেন্টের কর্মক্ষমতা হারান। হালিমার ৬ বছরের এক নাতনী রয়েছে।
ওই নাতনিই এখন তার এক মাত্র আনন্দের ও বাঁচার অবলম্বন। ছেলে বেকার, তাই সংসার তার একার উপার্জন দিয়ে কোনমতে চলছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথায় কষ্ট করলেও তিনি টাকার অভাবে সু-চিকিৎসা করাতে পারেন না। নিলুফা বেগম (৩৮) ভাড়া থাকেন সাভারের রাজাসন এলাকার পাহ্‌লোয়ান পাড়ায়। স্বামী আর এক সন্তান নিয়ে তার সংসার। তার স্বপ্ন ছিল একমাত্র সন্তান রিফাত পাটওয়ারীকে (১১) ভালো স্কুলে লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। কিন্তু রানা প্লাজা ধসে তার সে স্বপ্ন ধূলিসাত হয়ে গেছে। এখন ছেলের লেখাপড়া তো দূরের কথা দু’বেলা দু’মুঠ ঠিকমতো খেতেও পারে না তারা। নিলুফা বেগম বলেন, তিনি রানা প্লাজার পঞ্চম তলার ফ্যান্টম অ্যাপারেলস-এ কাজ করতেন। ভবন ধসে পড়ার সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর উদ্ধারকারীরা তাকে উদ্ধার করেন। পিলারের নিচে চাপা পড়ে তার ডান পা অকেজো হয়ে গেছে।
বিভিন্ন হাসপাতালে ৯ মাসের বেশি চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। চিকিৎসকরা তার ডান পা কেটে ফেলতে চাইলে তিনি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তা কাটতে দেননি। নিলুফা বলেন, সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা ও সাধারণ জনগণ এবং অন্যান্য জায়গা থেকে আরো এক লাখ ৪৫ হাজার টাকাসহ মোট ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। কিন্তু তার চিকিৎসায় খরচ করতে হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। পায়ের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারি না। তবে এখন মনে হচ্ছে পা কেটে ফেললেই ভালো হতো। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে নিলুফা কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিল একমাত্র ছেলেকে ভালো স্কুলে লেখা পড়া করাবো। কিন্তু তা আর হলো কোথায়। এখন বাড়ির পাশে ‘বর্ণমালা’ নামে একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। কিন্তু টাকার অভাবে  ছেলের স্কুলের বেতনও দিতে পারছি না। ছেলের বাবা তৌহিদুল ইসলাম রিকশা চালিয়ে যা রোজগার করেন তা দিয়ে ছেলের লেখাপড়ার খরচ, সংসার চালানো, আবার নিজের পায়ের চিকিৎসা করানো মোটেই সম্ভব হচ্ছে না বলেন, নিলুফা। আশরাফুল ইসলাম সুজন (৩৪) কাজ করতেন রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় ইথার টেক্স কারখানায়। ভবন ধসে পড়ার দিন সন্ধ্যা আনুমানিক ৭ টার দিকে উদ্ধারকারীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সাভার সিআরপিতে চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। আশরাফুল ইসলাম সুজন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকারিভাবে ও বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পেয়েছি। প্রথমে ফ্রি চিকিৎসা পেলেও হাসপাতাল থেকে রিলিজ করার পরে আবার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে টাকা দাবি করে। তবে টাকার অভাবে তিনি চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানান। ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আশরাফুল বলেন, প্রথমে মাথায় আঘাত পেয়ে পড়ে গিয়ে বাম হাতের ভিতরে রড ঢুকে বেরিয়ে যায়।
পরে ভবনের একটি ভিম ভেঙে বাম পায়ের উপর পরে। সে থেকেই বাম পা একে বারেই অচল। তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর আর কেউ খোঁজ নেয় নাই। স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। থাকেন ভাটপাড়া মহল্লায়।
মেয়ে আশামনি বাড়ির পাশে ভাটপাড়া স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। কিন্তু টাকার অভাবে মেয়ের  স্কুলের খরচও ঠিকমতো দিতে পারি না। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার বহুতল ভবন ধসে ১১শ’র বেশি লোক নিহত হয়। আহত হয় অশংখ্য শ্রমিক।

No comments

Powered by Blogger.