দুঃখের বীজও কি লুকিয়ে নেই এই আনন্দে?

মিলিয়ে নিন, কাহলিল জিবরানের উদ্ধৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি। দুঃখ সেই রাষ্ট্রের জন্য যেখানে প্রজ্ঞাবান নিশ্চুপ, প্রতিযোগিতায় বিজয়ী অন্ধ এবং আইনজ্ঞ শিশুর মতো। আবারও কাহলিল জিবরান। কেউ কথা শোনে কান দিয়ে, কেউ শোনে পেট দিয়ে, কেউ শোনে জামার পকেট দিয়ে আর কেউ কিছুই শোনে না। যারা কিছুই শোনে না, অথচ যেটা বলেন, সেটাই পরিণত হয় আইনে, সম্ভবত তারা অশেষ ক্ষমতাধর। এতদিন জেনে এসেছি পৃৃথিবীতে এমন ক্ষমতাধর একজনই আছেন। তিনি পোপ। ভুল। হেফাজতের আমীর আহমেদ শফী সাহেবই বা পোপের তুলনায় কম কীসে। সরকারপ্রধানের কাছে তিনি যে আবদার করেন তা-ই পূরণ হয়ে যায়। ভাস্কর্যের ভূমিকা যে মূর্তির নয় এবং ভাস্কর্যে যে ভাস্করের ইমপ্রোভাইজেশনের স্বাধীনতা আছে, এই জিনিস তাকে স্বয়ং মৃণাল হকও বোঝাতে পারবেন না। জাস্টিসিয়ার প্রধান অপরাধ সে নারী, অপরাধ সে শিল্প, অপরাধ সে ভাস্কর্য। এমনকি জাস্টিসিয়ার পরনে গ্রিক পোশাকের বদলে শাড়ি কেন এটাও অপরাধ। প্রশ্নটি যখন শফী সাহেব তুলেছেন তখন অপরাধ তো বটেই। শাড়ি পরিহিত জাস্টিসিয়া শফী সাহেবের অপছন্দ। পছন্দ নয়, অতএব জাস্টিসিয়া যত বড় ন্যায়ের প্রতীকই হোক না কেন, সে-ও পর্দার আড়ালে যেতে বাধ্য। নাকি ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে একজন নারীকে মানতে শফী সাহেবের আপত্তি?
যদিও সেই আপত্তি তাকে পেশ করতে হয়েছে আরেকজন নারীর কাছে! বাংলাদেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান কি আছে, প্রচলিত প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে যাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই? এতদিন ছিল না। এবার হবে। শফী সাহেবের জন্য এমন ব্যবস্থা হচ্ছে যে তার নিয়ন্ত্রণাধীন ৭০ হাজার মাদ্রাসার সিলেবাস প্রণয়ন থেকে শুরু করে যাবতীয় সবকিছুর জবাবদিহিতা থাকবে নিজেদেরই শাসিত বোর্ডের কাছে। যে বোর্ডের সভাপতি আবার স্বয়ং শফী সাহেব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা প্রশাসনের অন্য কোনো বিভাগের ওই ‘ভ্যাটিকান সিটিতে’ প্রবেশাধিকার নাই। ভ্যাটিকান সিটির পোপের চেয়ে শফী সাহেবের ক্ষমতা কম কীসে বলুন। এক হিসাবে বরং বেশিই। ভ্যাটিকান সিটি তো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। সেখানে ধর্মগুরু পোপের বিধানই আইন, সংবিধান, বাইবেল সব। কিন্তু বাংলাদেশ? ত্রিশ লাখ শহীদের হাড়-মজ্জা-রক্ত-মাংস দিয়ে তৈরি হয়েছে যে ভূখণ্ড, সেই ভূখণ্ডে, যা নাকি আবার স্বাধীন হয়েছে সবার সমান অধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার মতো উচ্চতর মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে, সেখানে কীভাবে হেফাজতের বড় হুজুর রীতিমতো চার্চপ্রধানের ক্ষমতা সমতুল্য পরামর্শ পেশ করছেন? না, আমরা সেই একচোখা প্রগতিশীল নই যারা ইসলামী রাষ্ট্রের ব্লাসফেমির সমালোচনা করব, আবার ইউরোপের দেশে দেশে যে ব্লাসফেমি আইন চালু আছে সেখানে মুখে কুলুপ এঁটে থাকব। তেমন পক্ষপাতপূর্ণ প্রগতিশীলও নই যারা ইউটিউব-ফেসবুকে কেবল ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে হেট ক্যাম্পেইন চালান। ইরানে আয়াতুল্লাহদের ক্ষমতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন অথচ ইসরাইল যখন বলে ইসরাইল হল ধর্মগ্রন্থ তউরতে বর্ণিত প্রমিজড ল্যান্ড, তখন নীরব থাকেন। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থে হত্যার বিধান নিয়ে সমালোচনা করেন না অথচ খুঁজে খুঁজে বের করেন কোরআনে কোথায় হত্যার বিধান দেয়া আছে। ইউটিউবে গিয়ে দেখুন কোরআনকে অবমাননা ও অসম্মান করার কী ভীষণ সব ন্যক্কারজনক ছবি আপলোড করা হয়েছে। আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধেও নই।
প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে কেবল মাজার জিয়ারত, মিলাদ পড়ানো আর ইমামতির কাজ করালে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকে। নাগরিক হিসেবে অবশ্যই তাদের সব ধরনের চাকরি পাওয়ার অধিকার আছে। ধর্মীয় মৌলবাদ বলতে একমাত্র ইসলামকে আক্রমণ করার যে প্রবণতা সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, জঙ্গিবাদকে তা অনেকখানি উসকে দেয় এটাও বিশ্বাস করি। কারণ বঞ্চিত মানুষ গুলি খাওয়া বাঘের মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শুধু ইহুদি ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে ইহুদিদের কোণঠাসা করে রাখার প্রবণতা আজকের জায়ানিজম উত্থানের প্রধান কারণ। আমাদের আপত্তি কেবল কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে দেশের আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে রাখার সীমাহীন ক্ষমতা প্রদান নিয়ে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ভ্রান্ত। আর দৃষ্টি ভ্রান্ত হলে সামান্য চুলও বিশাল পর্বতকে আড়াল করে ফেলতে পারে। এতদিন আমরা জেনে এসেছি, বিএনপি ক্যান্টনমেন্টের গর্ভে জন্ম নেয়া দল, রাজাকারের দল, সুবিধাবাদীর দল। সচেতনে-অবচেতনে বিএনপি সামরিকতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে ইত্যাদি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো তা নয়। আওয়ামী লীগকে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা আমাদের চিনিয়েছেন মাটি ও মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে জন্ম নেয়া দল হিসেবে। তাই আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যখন লেখা থাকে, তারা কোরআন ও হাদিসবিরোধী কোনো আইন পাস করবে না, তখন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা বলেন একুশ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় দেশ এত অধঃপাতে গেছে, জনগণের মূল্যবোধ এত নিচে নেমে গেছে, দশকের পর দশক ধরে রাজনীতিতে ধর্মের এত অন্যায় ব্যবহার হয়েছে যে আওয়ামী লীগকে এইটুকু ধর্ম ব্যবহার করতেই হয়। আমরা মেনে নিই।
দুর্মুখেরা যখন বলে ২০০৬ সালে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ চুক্তি করেছিল ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা পাওয়ার জন্য, আমরা সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা বলে মেনে নিই। যখন বলা হয়, আওয়ামী লীগ-ই একমাত্র অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, ধর্মনিরপেক্ষ দল, আমরা মেনে নিই। এমনকি যখন এ পর্যন্ত বলা হয় যে আওয়ামী লীগই পেরেছে, আওয়ামী লীগই পারছে, আওয়ামী লীগই পারবে, আমরা তো তাও মেনে নিই। আওয়ামী লীগ কি ধরে নিয়েছে এ ভালোবাসাই তাদের ভোটব্যাংক? টেকেন ফর গ্র্যান্টেড? চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত? জনগণের পেয়ালা আসলে ভরে গেছে বিষে। কোনো দল বিষ মিশিয়েছে ভালোবেসে, কোনো দল মিশিয়েছে ঘৃণায়। আহমদ ছফার সেই উক্তি তো বাণী চিরন্তনীর মর্যাদাই পেয়ে গেছে যে, আওয়ামী লীগ জিতলে একাই জেতে, হারলে হারে পুরো দেশ। তো আওয়ামী লীগ কি এই সেন্টিমেন্টাল অ্যাপ্লিকেশনকেই পুঁজি করে বারবার? তবে তো আওয়ামী লীগকে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, মানুষের ভেতর বাস করে সেই ঘাতক যে এখনও রক্তপাত করেনি, সেই চোর যে এখনও চুরি করেনি, সেই মিথ্যুক যে এখনও সত্যি কথা বলছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কি সেটাই প্রমাণ হয়ে যায়নি? ঠিক যে, আশির দশক থেকেই মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর টাকা এসেছে। মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরোধী নই; কিন্তু এই অর্থের সামান্য কয়েক শতাংশ যখন শিক্ষা, শিক্ষার্থী এবং অবকাঠামো খাতে ব্যয় হয় আর ৯০ শতাংশ-ই চলে যায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের জন্য, তখন সেটা আপত্তির কারণ হয় বৈকি।
জামায়াতের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে দেখুন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এমনও তো পাওয়া গেছে যে, বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে পরিকল্পনা করে সুপার মার্কেটের সঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করা হয় আর সেসব মার্কেট থেকে ভাড়া বাবদ যে অর্থ আদায় হয়, তার বিপুল অংশ চলে যায় জামায়াতের রাজনীতিতে। খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে মাদ্রাসাগুলো যে পরিমাণ সরকারি অনুদান পেয়েছে তা মাধ্যমিক স্কুলের অনুদানের চেয়ে অনেক বেশি। সমাজে মাদ্রাসা এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে যে ইউনিয়ন পরিষদের কোনো প্রার্থীও সংশ্লিষ্ট এলাকার মাদ্রাসার সমর্থন ছাড়া বিজয়ী হতে পারবেন না। সেকারণেই কি নির্বাচনের আগে শফী সাহেবদের কদর এত বেড়ে যায়? আওয়ামী লীগ জনপ্রিয় দল। এই দলের ভক্ত-অনুরাগী-গুণগ্রাহীর সংখ্যা বিপুল। টানা দুই মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার কারণে সুবিধা গ্রহীতার সংখ্যাও বেড়েছে, ওবায়দুল কাদের যাদের হাইব্রিড, কাউয়া এবং পোলট্রি মুরগির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যদিও এই তুলনা মোটেও ব্যাকরণসিদ্ধ নয়। কাকের মতো পরোপকারী, পরিবেশ-উপকারী, স্বজাতিবান্ধব প্রাণীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের এই সুবিধাবাদী কমিশনভোগী, চাঁদাবাজ, প্রতারকের তুলনাই চলে না। শেষ করছি কাহলিল জিবরানেরই আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে। যখন খুব আনন্দবোধ হয় তখন নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করো, কেন আনন্দ হচ্ছে? অন্তরের দিকে তাকাও এবং জানো, যা তোমাকে এখন আনন্দ দিচ্ছে, তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে দুঃখ।
জয়া ফারহানা : গল্পকার, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.