বীমা কোম্পানির এমডিরা বিপাকে

গ্রাহকদের সঙ্গে সীমাহীন হয়রানি, প্রতারণা করতে গিয়ে সম্প্রতি বেকায়দায় পড়েছেন বীমা মালিকরা। ক্ষতিপূরণ না পেয়ে গ্রাহকদের অব্যাহত মামলার কারণে এখন তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের ৯টি মামলায় বেশ কয়েকজন বীমা কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। এ অবস্থায় বিলম্বে হলেও বীমা মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নেতাদের টনক নড়েছে। রীতিমতো তারা বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর কাছে চিঠি দিয়ে এবং বৈঠক করে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বিষয়টি অনেকটা ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ ডাকার মতো মনে হলেও এখন তারা গ্রাহকের টাকা আদায়ে আইডিআরএকে উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ করেছেন। এক্ষেত্রে আইডিআরের সাফ কথা- কোনো গ্রাহক হয়রানির শিকার হলে তারা মামলায় যেতেই পারে। কিন্তু সময়মতো টাকা পরিশোধ করলে কারও মামলায় যাওয়ার কথা নয়। সূত্র জানায়, আইডিআরএর পক্ষ থেকে বীমা মালিকদের আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আগে কী হয়েছে সেটি তারা আর দেখবেন না। তাদের কাছে বর্তমানে যেসব অভিযোগ পেন্ডিং আছে সবগুলো তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। গ্রাহকের টাকা না দিলে তারাও কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। জানতে চাইলে বিআইএর সভাপতি শেখ কবির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু মামলার খবর এসেছে। সামগ্রিকভাবে এ শিল্পের জন্য এটি উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, টাকা না পেলেই গ্রাহকের মামলা করা উচিত নয়। কারণ বীমা খাতের কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ।
সবার আগের আইডিআরের কাছে অভিযোগ করতে হবে। এখানে বিষয়টির সমাধান না হলেই কেবল মামলা করা যায়। এমনকি বিআইএর কাছে অভিযোগ করলে আমরাও টাকা আদায়ের উদ্যোগ নিতে পারি। জানতে চাইলে আইডিআরএর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গকুল চন্দ্র দাস যুগান্তরকে বলেন, মামলা বন্ধে উদ্যোগ নিতে বীমা মালিকরা অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা দেখা করেছেন এবং চিঠিও দিয়েছেন। কিন্তু মামলা বন্ধ করা আইডিআরের কাজ নয়। তিনি বলেন, মামলা করা যে কোনো নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। ফলে এক্ষেত্রে আইডিআরের কিছু করার নেই। তবে দাবি আদায়ে আইডিআরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। তিনি জানান, আইডিআরের একটি বীমা বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটি রয়েছে। বীমা দাবির টাকা আদায়ে কাজ করছে এ কমিটি। জানা গেছে, গ্রাহকের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানির হয়রানি ও প্রতারণা নিয়মিত ঘটনা। ক্ষতিপূরণের প্রাপ্য টাকা পরিশোধ না করে নানারকম টালবাহানা করছে কোম্পানিগুলো। অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) পক্ষ থেকে সময়মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এ কারণে ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়েই এক রকম আদালতে যাচ্ছেন। এতে করে অনেকে দীর্ঘসূত্রতার ফাঁদে পড়ে যান। আবার কোনো কোনো মামলায় অভিযুক্ত বীমা কোম্পানির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতারসহ দ্রুত টাকা আদায়ের নজিরও সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মামলা বাড়লে সার্বিকভাবে বীমা শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। টাকা আদায়ে বিরোধ নিষ্পত্তিসহ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইডিআরএকে আইনগতভাবে যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া আছে। প্রতিষ্ঠানটি চাইলে গ্রাহকের স্বার্থে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু এভাবে মামলা বাড়লে ধরে নিতে হবে আইডিআরএ ঠিকমতো কাজ করছে না। এছাড়া অনেক সময় গ্রাহকের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে কৌশলে বিপক্ষে ভূমিকা নিতেও দেখা গেছে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এমনিতেই দেশের বীমা খাতের ভাবমূর্তি নেতিবাচক। এরপর মামলা বাড়লে তা আরও খারাপ হবে। সামগ্রিকভাবে এতে বীমা শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, বিষয়টি উপলব্ধি করে বীমা কোম্পানি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। জানা গেছে, বিদ্যমান আইনে কোনো গ্রাহকের বীমা দাবি উত্থাপনের ৯০ দিনের মধ্যে (প্রস্তাবিত ১২০ দিন) ওই দাবি পরিশোধ করা বীমা কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু নানা অজুহাতে গ্রাহকের পাওনা টাকা না দিয়ে বেশির ভাগ কোম্পানি হয়রানি ও প্রতারণা করে। এ ব্যাপারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। শক্ত তদবির না করলে মাসের পর মাস পড়ে থাকে অভিযোগের ফাইল। সূত্র জানায়, বীমা আইন ২০১০-এর নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিলকরণ সংক্রান্ত ধারা ১০-এর উপধারা (১) ও ১-এর (ঞ)-তে বলা আছে, ‘কর্তৃপক্ষ নিন্মবর্ণিত এক বা একাধিক কারণে বীমাকারীর নিবন্ধন সম্পূর্ণরূপে বা বিশেষ কোনো শ্রেণীর বা উপ-শ্রেণীর বীমা ব্যবসা স্থগিত বা বাতিল করিতে পারিবে, যদি বীমাকারী, (ঞ) ‘তাহার উপর কোন বীমা পলিসির, বাংলাদেশে উদ্ভূত, কোনো দাবি কোনো আদালতের চূড়ান্ত রায়ের বা এই আইনের অধীন কর্তৃপক্ষের আদেশের পর তিন মাস পর্যন্ত অপরিশোধিত থাকে।’ অর্থাৎ কোনো বীমা গ্রহীতার প্রাপ্য টাকা সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানি পরিশোধ না করলে প্রয়োজনে ওই কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে আইডিআরএ। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর বীমা গ্রহীতার প্রাপ্য টাকা পরিশোধ না করলে ভুক্তভোগীদের অনেকে বাধ্য হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হন। এ রকম কয়েকটি মামলায় সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা দ্রুত ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। যদিও বেশ কিছুসংখ্যক মামলা বিচারাধীন।
কেস স্টাডি : পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও গ্রাহকের টাকা পরিশোধ নিয়ে টালবাহানা শুরু করে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এরপর ৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করে ৫১ জন গ্রাহক। দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪১৮ ধারায় এ মামলা হয়। এরপর গ্রেফতার এড়াতে ওই বছরই পাওনা পরিশোধ করতে বাধ্য হয় কোম্পানিটি। একই কোম্পানির বিরুদ্ধে সম্প্রতি নোয়াখালীতে আরেকটি মামলা হয়েছে। অন্যদিকে গত বছর রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান নির্বাহীসহ ঊর্ধ্বতন ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন ছানোয়ার পাঠান নামে একজন গ্রাহক। কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা করা হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্তরা গ্রাহকের জমা করা প্রিমিয়াম কোম্পানির ডাটাবেজে এন্ট্রি না করে আত্মসাৎ করেন। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর আদালতে হাজির হলে ৫ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। এরপর বাদীর দাবি পরিশোধ করায় মামলাটি আপস করে নেয় রূপালী লাইফ। তবে মামলা করার আগে ভুক্তভোগীরা আইডিআরএ আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। ১৪ মার্চ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন রাজবাড়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
রাজবাড়ী পৌরসভার মো. রফিকুল ইসলাম বাবু বীমা দাবি বাবদ ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা পাওনা আদায়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ও ব্রাঞ্চ কো-অর্ডিনেটর মো. মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪১৮/৪২০ ধারায় মামলা করেন। মামলা করার আগে বাদী রফিকুল ইসলাম বাবু গত বছরের ২৫ জুলাই আইডিআরএ বরাবর আবেদন করেন। ডায়েরি নম্বর ৬৮২৬। অথচ আইডিআরএ এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয়ায় বাদী রফিকুল আদালতের শরণাপন্ন হন। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে মামলা করেন সাত্তার শেখ নামে এক ব্যক্তি। তিনি তার ছেলে জাহিদ শেখের মৃত্যুর পর বীমার টাকা আদায়ে এ মামলা করেন। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কয়েকশ’ গ্রাহক আইডিআরএর কাছে আবেদন করেও প্রতিকার পায়নি। পরে তারাও মামলা করেন।

No comments

Powered by Blogger.