খাদ্য সংকট, গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে কৃষক

এবার কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের ৭ হাওরের মাথা হিসেবে পরিচিত কলমা বেড়িবাঁধও ভেঙে গেছে। এতে তলিয়ে গেছে কলমা, হালালপুর, কাঁকড়িয়া, সাপান্ত, বাজুড়ি, চণ্ডিপুর ও শান্তিপুর হাওরের শত শত একর পাকা বোরো ফসল। উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢল আর অবিরাম বর্ষণে শুক্রবার রাতে বেড়িবাঁধটি ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বহু কৃষকের স্বপ্ন। সুনামগঞ্জে দেখা দিয়েছে গবাদি পশুর তীব্র খাদ্য সংকট। এ কারণে পানির দামে কৃষক নিজেদের গবাদি পশু বিক্রি করে দিচ্ছেন। এদিকে বিষাক্ত গ্যাসে জলজ প্রাণী মারা যাওয়ায় নেত্রকোনায় মাছ ধরা, বিক্রি ও খাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কিশোরগঞ্জ : অষ্টগ্রাম উপজেলার কলমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাধাকৃষ্ণ দাস যুগান্তরকে বলেন, ‘চৈত্র মাস থাইক্যা এলাকার শত শত কৃষক মাটি, বালুর বস্তা, বাঁশ-চাটি, খড়-বিচালি ফেলে কলমা বেড়িবাঁধটি রক্ষা করে আনছিল। রাইত জাইগ্যা পাহারা দিচ্ছিল। কিন্তু আর শেষরক্ষা অইল না। প্রায় দেড় হাজার একর পাকা বোরো ফসল অহন পানির নিচে। গ্রামে-গ্রামে, ঘরে-ঘরে অহন শুধু কৃষকের আহাজারি আর কান্নার রোল।’” হালালপুর গ্রামের কৃষক বিষ্ণুদাস বলেন, ‘আমরার ধান পাইক্কা পুরাপুরি কাটার বাত অইছিল। বিভিন্ন এলাকা থাইক্যা দাওয়ালিরাও আইছিল ধান কাটতে। আমরার হারা বছরের স্বপ্নের ফসল শেষ।’ তিনি জানান, ১৮ একর জমিতে বোরো করেছিলেন। এ থেকে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ মন ধান পাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু ৭০-৮০ মন ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন। একই কথা জানান হালালপুরের ক্ষিরেন্দ্র দাস ও সুমন দাস। তাদের দাবি, সরকার ভর্তুকি ও নতুন করে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি আগামী মৌসুম পর্যন্ত অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান না করলে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে। এ ব্যাপারে অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মোহাম্মদ সাঈদ জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এবং কৃষকের সংখ্যা নিরূপণের কাজ চলছে।
সিলেট : মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া অকাল বন্যায় ডুবে গেছে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার ফসল ও গোচারণ ভূমি। ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর এলাকার বাসিন্দা হারাধন দেব বলেন, শানবাড়ি বাজারে এখন মানুষ দাঁড়ানোর জায়গা নেই। পুরো বাজার দখল করে নিয়েছে গরু-ছাগল। নিজেদের রাখার জায়গা না থাকা ও খাবার সংকটের কারণে এগুলো বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসেন কৃষক। জয়শ্রী ইউনিয়নের বাসিন্দা তৌফিক মজুমদার বলেন, আমার ১৬টি গরুর মধ্যে ১৩টি প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিয়েছি। জগন্নাথপুর উপজেলার কৃষক লিংকন মিয়া বলেন, হাওর তলিয়ে যাওয়ায় এলাকায় চরম গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেয়ায় লোকজন গরু-ছাগল পানির দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরপারের কৃষক বদরুল মিয়া দুই দিন আগে নিজের ৩টি গরু বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, ‘কিছু দিন আগেও যেগুলোর দাম ৮০ হাজার টাকা ছিল, বাধ্য হয়ে সেগুলো ৪৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। ঋণের টাকা শোধ, পরিবারের খরচ চালাতে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’ ধর্মপাশা উপজেলার নতুন পাড়ার বাসিন্দা হাজী আবদুল হান্নান বলেন, বৃহস্পতিবার বাজারে মানুষজন যেভাবে গরু নিয়ে আসে তাতে বাজারে হাঁটাই ছিল কষ্টকর। কোরবানি ঈদের বাজারকেও ছাড়িয়ে যায় এটি। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুর রহিম মিয়া বলেন, গো-খাদ্যের সংকটের বিষয়টি এবং গবাদি পশু রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
নেত্রকোনা ও কেন্দুয়া : মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলার ৯৫টি হাওরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সব ধরনের মাছ ধরা, বিক্রি ও খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা জারি করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাহ আলম মুকুল যুগান্তরকে বলেন, ধান পচে পানি দূষিত হয়ে গেছে। পানিতে অ্যামোনিয়া ও হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস সৃষ্টি হয়ে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে। পানি দূষণমুক্ত করার জন্য ওষুধ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এদিকে কেন্দুয়া উপজেলার অন্তত ৩০টি হাওর ও বিলের বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বছরের একমাত্র বড় ফসল বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান ইমাম জানান, শনিবার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, প্রতিদিনই উপজেলার নতুন নতুন হাওর-বিল তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) : ধর্মপাশায় দূষিত পানি ও মরা মাছ খেয়ে কলেরা ও বদহজমজনিতে রোগে এক সপ্তাহে ৬ শতাধিক হাঁসের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পাদ দফতর এ তথ্য জানিয়েছে।
কুলাউড়া : কৃষকের ক্ষতিপূরণের দাবিতে আজ কৃষক বাঁচাও-হাওর বাঁচাও কমিটির আয়োজনে মানববন্ধন হবে। এ ছাড়া মঙ্গলবার স্থানীয় কৃষক ভুকশিমইলে মানববন্ধন করবেন।
মৌলভীবাজার : হাওরে অকাল বন্যার কারণে কুলাউড়া উপজেলায় ৭ টন, জুড়ী উপজেলায় ৮ টন এবং বড়লেখা উপজেলায় ১০ টন মিলে ২৫ টন মাছ মারা গেছে। শনিবার বিকালে মৎস্য অধিদফতরের এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। এতে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আ ক ম শফিক উজ-জামান।
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) : শনিবার দুপুরে জগন্নাথপুরের মইয়ার হাওরের পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে মৎস্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দল।

No comments

Powered by Blogger.