গণমাধ্যমকে একজোট হতে হবে

গত বছরের জুলাই মাসটা এফবিআইর পরিচালক জেমস কোমির খুব ব্যস্ত কেটেছে। ওই সময় তিনি হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘ তদন্ত শেষ করেন। তিনি অভিযোগ না করলেও হিলারির সমালোচনা করেন এই বলে যে তিনি ‘অত্যন্ত অসতর্ক’ ছিলেন। তা সত্ত্বেও কোমির এই কথাটা হিলারির প্রচারণাপর্বে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। এভাবে প্রকাশ্য সমালোচনা করে তিনি একটি রীতিও ভাঙেন। ব্যাপারটা হচ্ছে, যেসব অভিযোগের বিচার হয় না, সেসব ক্ষেত্রে সাধারণত নিশ্চুপ থাকাটাই রেওয়াজ। ফলে কোমি মানুষের বাহবা পাওয়ার জন্য যে সংবাদ সম্মেলন করলেন, সেটার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বলেই মনে হয়। এর মধ্যে তিনি কংগ্রেসের এক শুনানিতে ২০ মার্চ নিশ্চিত করেন, গত বছরের জুলাই মাসে এফবিআই নির্বাচনে রুশ প্রভাব নিয়েও এক তদন্ত শুরু করে।
রুশদের লক্ষ্য ছিল, হিলারির প্রচারণায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ট্রাম্পকে সহায়তা করা। আর একটি তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই তা হচ্ছে বলে ঘোষণা করাটা অস্বাভাবিক ও সম্ভবত রাজনৈতিক। প্রচারণার সময় কোমি এই গুরুতর তদন্ত নিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ ছিলেন, যদিও এটা বার্নি স্যান্ডার্স কথিত ‘ড্যাম ই-মেইলের’ চেয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগ। ট্রাম্পের প্রচারণা কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুশদের যোগাযোগ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে যদি প্রকাশ্যে এই তদন্তের ঘোষণা দেওয়া হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে তাঁর প্রার্থিতা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কারণ, রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে এখন যা জানা যাচ্ছে, তাতে ট্রাম্পের রেটিং নতুন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০ তারিখের শুনানিতে যে অস্বস্তিকর প্রশ্নটি আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হচ্ছিল, তা হচ্ছে এফবিআই পরিচালকের এ দুটি ব্যাপার ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার কারণে কি নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত হয়েছে? অর্থাৎ রুশ প্রচেষ্টা নির্বাচনকে যতটা প্রভাবিত করেছে, ততটা? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কখনোই জানতে পারব না। এই তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এফবিআই এ নিয়ে সম্ভবত আর কিছু বলবে না। সম্ভবত, তদন্তটি শেষ হতে আরও অনেক সময় লাগবে। তবে কোমি কিছু বিষয় স্পষ্ট করেছেন। আমরা এখন নিশ্চিতভাবেই জানি, বারাক ওবামা ট্রাম্পের ফোনে আড়ি পাতেননি। একজন ডানপন্থী রাজনৈতিক ভাষ্যকার এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে ট্রাম্পের চিত্তবিক্ষেপ হয়, টুইট বার্তায় তিনি যার প্রকাশ ঘটান। কিন্তু ট্রাম্পের ওই সহযোগীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তদন্ত হয়েছিল কি না, তা নিয়ে কোমি কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। ওদিকে বর্তমান মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস রাশিয়াবিষয়ক তদন্ত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি নীতিবহির্ভূতভাবে রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ব্যাপারটা আড়াল করেছিলেন। আইনপ্রণেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম ট্রাম্পকে অনুমোদন করেন, যিনি রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সময় এবং এমনকি জুলাই মাসেও একবার দেখা করেন। তিনি যে শুনানির সময় ব্যাপারটা একেবারেই চেপে গেলেন, তাতে বিচার বিভাগের তদন্ত কলঙ্কিত হয়েছে। আর এফবিআই তো এই বিভাগের একটি অংশ।
কংগ্রেসের তদন্ত কমিটি রুশ হ্যাকিং ও ট্রাম্পের প্রচারণার সময় তাদের মধ্যকার যোগাযোগ নিয়ে তদন্ত করছে। কিন্তু ওয়াশিংটনের দলগত রাজনীতিতে যে তিক্ততা রয়েছে, তাতে ধরে নেওয়া যায়, এই দ্বিদলীয় প্যানেল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে না। এ কারণেই রাশিয়ার হস্তক্ষেপ–সংক্রান্ত খবর জানার জন্য গণমাধ্যমই মানুষের সবচেয়ে বড় আশার জায়গা। হ্যাঁ, প্রতিবেদকদের হয়তো সমন জারি করার ক্ষমতা নেই, কিন্তু এ নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, প্রো পাবলিকা যত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছে, তাতে আমি আশার আলো দেখছি। প্রচারণার সময় কী হয়েছে তার অনেক উত্তর রাশিয়াতেই আছে, যে দেশটি সাংবাদিকদের জন্য কুখ্যাত ও কঠিন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক সংবাদমাধ্যমই বিজ্ঞাপন কমে যাওয়ায় গত এক দশকে মস্কো ব্যুরো বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের সবাইকে বার্তাকক্ষের জনবল কমাতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী গণমাধ্যমকে ঠিক এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণীত হয়েছে। কেন্দ্রীভূত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ ও সরকারের জবাবদিহির জন্য এটা করা হয়েছে। বিদেশি শক্তি কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমের সম্মিলিত তদন্তের চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে। পরিস্থিতির গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমের আচরণে পরিবর্তন আনাটা জরুরি। যেসব খ্যাতিমান সংবাদমাধ্যমের রাশিয়াবিষয়ক মৌলিক প্রতিবেদন করার সক্ষমতা আছে, তাদের পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা উচিত নয়, বরং সহযোগিতার ভিত্তিতে তাদের সংবাদ সংগ্রহ করা উচিত।
আমার উদ্বেগ হচ্ছে, এ-বিষয়ক সামান্য অগ্রগতি নিয়ে প্রচুর সংবাদ হলে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। বিভিন্ন জায়গায় নানা ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে মনে হতে পারে, গণমাধ্যম ট্রাম্পের ওপর চড়াও হয়েছে। যদিও ব্যাপারটা আসলে সে রকম নয়। যৌথভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা যেতে পারে। অপরাধ বা জটিল ঘটনার অনুসন্ধান করার জন্য গণমাধ্যম যে এর আগে একজোট হয়নি, তা নয়। অ্যারিজোনা রিপাবলিক–এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ডন বোলেস ১৯৭৬ সালে গাড়িবোমা বিস্ফোরণে নিহত হলে সংবাদমাধ্যম একজোট হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা মাফিয়াদের সঙ্গে জড়িত ছিল। এরপর ২০০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে গণমাধ্যম একজোট হয়ে ফ্লোরিডার ভোট ও বিদেশি ব্যালট পুনর্গণনার চেষ্টা করে। মানুষকে জানানোর জন্য গণমাধ্যম উইকিলিকসের তারবার্তা, স্নোডেনের নথি ও পানামা পেপার্স তদন্ত করতে একজোট হয়েছে। নিশ্চিতভাবে ট্রাম্প এটাকে ভুয়া খবর বলবেন। কিন্তু মহান সংবাদমাধ্যমগুলো একজোট হয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে যদি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন দেয়, তাহলে সেটাই হবে সেরা প্রতিষেধক। আমরা যদি ট্রাম্প-রাশিয়া ধাঁধার সমাধান দিতে পারি, তাহলে গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা আবারও ফিরে আসবে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর নতুন মূলমন্ত্রে বলা হয়েছে, অন্ধকারে গণতন্ত্রের মৃত্যু হয়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর নতুন বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সত্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখন সেটা প্রমাণ করার সময় এসেছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
জিল অ্যাব্রামসন: রাজনৈতিক কলামিস্ট।

No comments

Powered by Blogger.