আইলা-দুর্গতদের পুনর্বাসন: প্রধানমন্ত্রীর সফর জরুরি by শরিফুজ্জামান শরিফ, এ এস এম আতীকুর রহমান, সরদার আমিন, বদরুল মান্নান, মিহির বিশ্বাস, ওমর ফারুক ও রোবায়েত ফেরদৌস

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হেনেছিল ২০০৯ সালের ২৫ মে। এতে প্রায় ১৭০ জন প্রাণ হারায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কয়েক লাখ মানুষ। তারপর পেরিয়ে গেছে ১১টি মাস। কিন্তু আইলা-দুর্গত খুলনা ও সাতক্ষীরার হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্দশা শেষ হয়নি। কয়েক মাস ধরে আইলা-পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রম নিয়ে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, জনগণের সম্পদের পুকুরচুরি, সরকারের বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও মানুষের বিপন্নতার চিত্র গণমাধ্যম দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছে। ওই সব প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে ওই অঞ্চলের সর্বশেষ অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমরা ৮ ও ৯ এপ্রিল ২০১০ আইলা-দুর্গত দক্ষিণাঞ্চল সফর করি। সে সময় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়ন; বিশেষ করে গাবুরা দ্বীপ, নীলডুমুর ইউনিয়ন, আশাশুনির প্রতাপনগর, খুলনার কয়রায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল পরিদর্শন করি। নানা শ্রেণী ও বয়সের মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি।
আমরা দেখেছি, মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে রাস্তার ওপরে, কোথাও বা পাকা দালানের ছাদে আশ্রয় নিয়ে মানবেতরভাবে বেঁচে আছে। তাদের হাতে কাজ নেই, আশ্রয় নেই, ঘরে খাবার নেই। চারদিকে অথই পানি অথচ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। এলাকায় যেসব পুকুর ছিল তা লবণ-পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে এক কলস পানির জন্য মানুষকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। কোথাও কোথাও এই পানি কলসপ্রতি ১৫-২০ টাকা দিয়ে কিনে আনতে হয়। ওই অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ির চাষ মানুষকে দুর্ভোগের প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিয়েছে। কৃষিজমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে চিংড়ি চাষের উপযোগী করে চিংড়িচাষিরা লাভবান হলেও দরিদ্র কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বাড়ছে, জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। কৃষিজমিতে লোনাপানি প্রবেশ করানো যাবে না—উচ্চ আদালতের এ রায় উপেক্ষিত হচ্ছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ কেটে পানি তোলার ক্ষেত্রে চিংড়িচাষিদের সহায়তা করছে বলে স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছে।
আমরা স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের ক্ষোভ, শঙ্কা আর বিরক্তি লক্ষ করেছি। আইলার এক বছর হতে চলল, অথচ তারা এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। কবে ফিরবে তাও জানে না। সরকারের একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ, ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা ওই অঞ্চলে গেছেন; খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী গেছেন ছয়বার। তিনি মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। প্রতিবারই তিনি বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করার তারিখ নির্ধারণ করেছেন। এলাকাবাসী জানিয়েছে, সর্বশেষ তিনি সেখানে বলে এসেছেন, ১৫ এপ্রিলের মধ্যে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন না হলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবেন। আমরা আমাদের সফরকালে বাঁধ নির্মাণে তাঁর এই ঘোষণার কোনো বাস্তবায়ন দেখিনি। আমরা এখন কর্মকর্তাদের গাফিলতির জন্য শাস্তি প্রদানের খবর শোনার অপেক্ষায় আছি।
আমরা দেখেছি, গত শতকের ষাটের দশকে যে বাঁধ নির্মিত হয়েছিল, তার কোনো সংস্কার হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ এখনো মেরামত করা যায়, তার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। প্রায় ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে যে কাজ করা হয়েছে তা দেখলে মনে হয় বিপুল অর্থের প্রকল্প তৈরিই ছিল এর লক্ষ্য, মানুষ বাঁচানো নয়। বর্ষা আসার আগে আইলা-দুর্গত এলাকার বেড়িবাঁধের সংস্কার করতে না পারলে, যাঁরা মানবেতরভাবে ওই এলাকায় অবস্থান করছেন, তাঁদেরও এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে।
দুর্গত ব্যক্তিরা এখন ত্রাণ চায় না, কাজ চায়। নিজের বাড়িতে ফিরতে চায়। তারা আসন্ন কালবৈশাখী মৌসুমকে সামনে দেখে আতঙ্কিত। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, চলতি এপ্রিল মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। বারবার সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বেড়িবাঁধ সংস্কারের আশ্বাস বাস্তবায়িত না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা নিজ বাড়িতে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছে না। রাস্তার পাশে সরকারি জমিতে আশ্রয় নেওয়া এ মানুষগুলো ত্রাণ সহায়তায় বেঁচে থাকলেও তাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। অবশ্য দেশি-বিদেশি সংস্থার সহায়তায় কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত সহায়তা আসেনি। আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছি। আইলার এক বছর পরে মানুষগুলো কেমন আছে তা দেখার জন্য ওই অঞ্চল সফর করার অনুরোধ করছি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও ওই অঞ্চল পরিদর্শনে যাওয়া উচিত। আমাদের সমগ্র দেশবাসীর অভিভাবক প্রধানমন্ত্রীকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও মানুষের দুর্ভোগ দেখতে ওই অঞ্চল সফর করা উচিত। আমরা দেখেছি, আইলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় একের পর এক এলাকা লোনাপানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি শিবসা নদীর জোয়ারের চাপে নতুন করে বাঁধ ভেঙে দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নের ১৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
দাকোপের সুতারখালী ইউনিয়নের মধ্যবিল গ্রামের দীপংকর গাইন জানান, এলাকায় দিনমজুরি করারও কোনো সুযোগ নেই। ফলে সরকারের দেওয়া প্রতি মাসে ২০ কেজি চাল ও অন্যান্য কিছু সহযোগিতা নিয়েই দিন কাটাতে হচ্ছে। সমপ্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন—এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা তাঁর এই নির্দেশের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। যেহেতু আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে পুনর্বাসনকাজ করতে হচ্ছে, তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি ঠেকাতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সরেজমিনে সফর শেষে আমরা দাবি করছি:
১. ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত সুপেয় পানি সরবরাহ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। ২. কৃষিজমিতে লোনাপানি ঢোকানো বন্ধ করতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। ৩. বর্ষা শুরুর আগে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করতে হবে। ৪. অবৈধ ও অপরিকল্পিত চিংড়ির চাষ বন্ধ করতে হবে। ৫. বাঁধ নির্মাণ ও তদারকির জন্য স্থানীয় মানুষদের নিয়ে তদারকি কমিটি গঠন করতে হবে। ৬. পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
লেখকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও পানি প্রকৌশলী।

No comments

Powered by Blogger.