ইউনেস্কোর ৭০ বছর : ঢাকা ঘোষণা by কাজী ফারুক আহমেদ

নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও বিপরীতমুখী প্রতিকূল বিশ্বরাজনীতির মোকাবেলা করে ইউনেস্কো আজ ৭০ বছরে পদার্পণ করছে। ১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের এ বিশেষায়িত সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা-সংকৃতির বিকাশ, শান্তির পক্ষে অবস্থান নির্মাণ, বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা, পরিবেশ সুরক্ষায় অব্যাহতভাবে কাজ করে চলেছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রক্তাক্ত সংগ্রামের স্মারক মহান একুশে ফেব্র“য়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানকারী এবং বিশ্বের ৬ হাজার ভাষাকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষাকারী ইউনেস্কো অব্যাহতভাবে তার কর্মকাণ্ডের দিগন্ত সম্প্রসারিত করে চলেছে। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কোর ৫ম সাধারণ অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করা হয় : ষাটের দশক থেকে বিশ্বে সূচিত বিশাল পরিবর্তনের ধারায় এ সত্য আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, শিক্ষকের মর্যাদা নির্ভর করে শিক্ষার অবস্থানের ওপর, শিক্ষার অবস্থান নির্ভর করে শিক্ষকের মর্যাদার ওপর। প্রতিষ্ঠালগ্নে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে জাতিগুলোর মধ্যে অবদান রাখা এবং সেজন্য পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধন, ন্যায়বিচারের প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধাবোধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জাতিসংঘ সনদে স্বীকৃত মৌলিক মানবাধিকারগুলোর সংরক্ষণ ও বিকাশ নিশ্চিত করাকে ইউনেস্কো তার লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে। বলা হয়, যেহেতু মানুষের মনেই যুদ্ধ-ভাবনার সূত্রপাত, তাই সেখানেই শান্তির পক্ষে অবস্থান নির্মাণ করতে হবে।
১৯৪৬ সালে ইউনেস্কোর অধিবেশনেই শিক্ষকদের নৈতিক, বৈষয়িক ও পেশাগত স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে একটি বিশ্ব শিক্ষক সনদ রচনার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। দীর্ঘ আলোচনা ও বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে সদস্য দেশগুলোর আন্তঃসরকার সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত সুপারিশমালা গৃহীত হয়। আবার ইউনেস্কোর সাধারণ সভার ২৬তম অধিবেশনে এ মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, ১৯৬৬ সালে প্যারিসে গৃহীত শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত সুপারিশমালার স্মরণে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হবে। সে সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে আসছে।
ইউনেস্কোর সদর দফতর প্যারিসে। সদস্য রাষ্ট্র, সহযোগী সদস্য ও পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণে দুবছর পরপর অনুষ্ঠিত সাধারণ অধিবেশন এবং ৫৮ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী বোর্ডের সিদ্ধান্তক্রমে মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সচিবালয়ের মাধ্যমে ইউনেস্কো তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে মহাপরিচালক প্রতি ৪ বছর পরপর নির্বাচিত হয়ে থাকেন। তবে প্রথম মহাপরিচালক জুলিয়ান হাক্সলি ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ দুবছরের জন্য দায়িত্ব পালন করেন। ইরিনা বোকোভা ইউনেস্কোর দশম মহাপরিচালক হলেও এ শীর্ষপদে তিনিই বিশ্বের প্রথম নারী। বাংলাদেশে মহাপরিচালকদের মধ্যে বেশ পরিচিত ফেডেরিকো মেয়র জারাকোজা (১৯৮৭-১৯৯৯) এবং কাইচিরো মাতসুরা (১৯৯৯-২০০৯)। বিভিন্ন দেশের ২ হাজার ১০০ জন বর্তমানে এ বিশ্ব সংস্থায় কর্মরত। এর দুই-তৃতীয়াংশ প্যারিসে সদর দফতরে এবং অন্যরা বিভিন্ন দেশে ফিল্ড অফিসে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ইউনেস্কো তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও বাস্তবায়ন করে থাকে। ইউনেস্কোর বিভিন্ন ইন্সটিটিউট ও কেন্দ্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : প্যারিসে আন্তর্জাতিক শিক্ষা পরিকল্পনা ইন্সটিটিউট, জেনেভায় আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যুরো, হামবুর্গে জীবন শিক্ষা ইন্সটিটিউট, মেলবোর্নে ওশানিয়া উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র, মস্কোতে তথ্যপ্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ভেনিজুয়েলায় উচ্চশিক্ষা ইন্সটিটিউট, বনে আন্তর্জাতিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বুখারেস্টে ইউরোপীয় উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র, নেদারল্যান্ডসে পানিসংক্রান্ত শিক্ষা ইন্সটিটিউট, ইতালিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র, মন্ট্রিয়ালে ইউনেস্কো পরিসংখ্যান ইন্সটিটিউট। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি ও পরিবেশ সংরক্ষণে ইউনেস্কোর বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। তবে আমার মতে, ইউনেস্কোর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি হল বিজ্ঞান চর্চা, গবেষণা, নারী-পুরুষ সমতা অর্জন ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। বর্তমান মহাপরিচালক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের তথা সায়েন্স ডিপ্লোমেসির যে ধারণা বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরেছেন তা যথার্থই প্রণিধানযোগ্য।
জাপানে শিক্ষা সম্মেলন : ১০ নভেম্বর থেকে জাপানের এইচি নগোয়ায় শুরু হয়েছে বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলন। ইউনেস্কো ও জাপান সরকার এর যৌথ উদ্যোক্তা। আজ ১৬ নভেম্বর এ সম্মেলন শেষ হবে। এর উদ্বোধনী অধিবেশনে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ গঠন শিরোনামে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে বর্তমান দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন, ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার চিত্র তুলে ধরে ২০১৫ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে মতামত ও সুপারিশ চাওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে ১০টি প্রধান ক্ষেত্র চিহ্নিত করে শিক্ষাকে উন্নয়নের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে দেখানো হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, উন্নয়নের নীতি ও লক্ষ্য নির্ধারকদের টেকসই শিক্ষা উন্নয়নের সমর্থনে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা বাস্তবায়নে নিশ্চিত করতে হবে সুপ্রসারিত প্রত্যক্ষ ও ফলপ্রসূ পরিবেশ। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমর্থন অপরিহার্য। বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীসহ বিভিন্ন দেশের ৭৫ জন মন্ত্রী, মন্ত্রীর মর্যাদায় ২৮ জন, ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো ও এনজিও প্রতিনিধি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বেসরকারি উদ্যোক্তা, তরুণ সমাজের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞসহ এক হাজারের বেশি প্রতিনিধি এখন এ সম্মেলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বিশ্বের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাই জাপানের এ সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ ঘোষণার অপেক্ষায় আছেন।
৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা ঘোষণা : ইউনেস্কোর উদ্যোগ ও সহযোগিতায় মাস্কাট ও ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি শিক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো এ বছর ঢাকায় আয়োজন করে দিনব্যাপী কর্মসূচি। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এবং বিভিন্ন দেশের বেশ কজন মন্ত্রী, শিক্ষা কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এতে অংশগ্রহণ করেন। ইরিনা বোকোভার এটি বাংলাদেশে দ্বিতীয় সফর। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মেয়েশিশুদের অভিগম্যতা বৃদ্ধি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও অর্জনের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইউনেস্কো এ বছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উদযাপনের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেয়। আমার সৌভাগ্য, ব্যাংককে তিনটি শিক্ষা সম্মেলন ও ঢাকায় ইউনেস্কো আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছি। ইরিনা বোকোভার সঙ্গে মতবিনিময় করতে পেরেছি। দিনভর বিভিন্ন আলোচনা-মতবিনিময় শেষে ৮ সেপ্টেম্বর যে ঢাকা ঘোষণা প্রকাশিত হয়, তা ছিল তথ্যপূর্ণ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ঘোষণার প্রায় পাঁচ দশক পর বিশ্বে সাক্ষরতার হার ৬০ শতাংশ (১৯৬০) থেকে ৮৪ শতাংশে (২০১২) উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এখনও ৭৮ কোটি ১০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক, যার তিন ভাগের দুই ভাগ নারী, বিশ্বের উন্নয়ন অভিযাত্রায় অংশ নিতে পারছে না শুধু নিরক্ষরতার শৃংখলে আবদ্ধ থাকার কারণে। ১২ কোটি ১০ লাখ শিশু এখনও মৌলিক শিক্ষা শেষ করতে পারছে না। স্কুলে গেলেও ১৩ কোটি শিশু পড়তে, লিখতে ও অংক করতে জানে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা ঘোষণায় বলা হয় : আমরা বিশ্বাস করি অপচয় করার মতো সময় আমাদের কারও নেই। আসুন, সবাই একসঙ্গে কাজ করি। বর্তমান অবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসি। জ্ঞান অর্জন সাক্ষরতা ও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করি। শিক্ষা তথা জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন এবং বৈষয়িক ও নৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে ইউনেস্কোর কার্যক্রমে বর্ণ, অঞ্চল, বিশ্বাস নির্বিশেষে সব দেশের সব মানুষের সহযোগিতা কাক্সিক্ষত হলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিবদমান বিভিন্ন শক্তির প্রতিযোগিতার কারণে তা কোনো কোনো সময় প্রত্যাশার সীমা স্পর্শ করতে পারে না। তারপরও ইউনেস্কোর অব্যাহত উদ্যোগ মানব প্রগতির ধারায় যে নিত্যনতুন অবদান রেখে চলেছে, তার মূল্য অপরিসীম।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : শিক্ষাবিদ; ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.