সাক্ষী রেজিস্টার নেই ২৬ আদালতে

আইনের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও সাক্ষী উপস্থিতির রেজিস্টার রাখে না ঢাকা মহানগরের ২৬ আদালত। অন্য ৩৫টি আদালতে এটি থাকলেও হালনাগাদ হয় না নিয়মিত। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাক্ষীদের একরকম জিম্মি করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর বা সরকারি আইন কর্মকর্তা) ও পেশকার। যার কারণে সাক্ষ্য দিতে এসে নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে সাক্ষীদের। এতে মামলা নিষ্পত্তিতেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। যথাসময়ে বিচারের রায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।
ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার (সিআরও) অনুযায়ী, প্রত্যেকটি নিম্ন আদালতে সাক্ষী উপস্থিতির রেজিস্টার বুক থাকা বাধ্যতামূলক। রেজিস্টারে সাক্ষীর নাম ও মামলার নম্বরসহ সতেরটি বিষয় লিপিবদ্ধ থাকার কথা। আর যেসব সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হল না, তাদের নামও লিপিবদ্ধ করতে হবে, যা লিখবেন সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার। আর সত্যায়িত করবেন বিচারক।এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যেক সাক্ষীকে যাতায়াত ও খাওয়া বাবদ ২০০ টাকা দেয়ার বিধান রয়েছে সিআরওতে, যা রেজিস্টার বুকে উল্লেখ থাকবে। সাক্ষীকে টাকা দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও আদালতের তহবিলে পাঠানো হয় না কোনো টাকা। এই রেজিস্টার বুক সংরক্ষণ করে সাক্ষীদের প্রাপ্য অর্থ দেয়া হলে, সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতেন সাক্ষীরা। পাশাপাশি হয়রানি থেকেও মুক্তি পেতেন তারা। কিন্তু উল্টো পেশকার ও পিপিদের বিরুদ্ধে সাক্ষীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গত এক বছরে ঢাকা মহানগরের ২৬টি আদালত থেকে ১১০৫ জন সাক্ষী ফেরত দিয়েছেন পিপি ও পেশকাররা। আদালতের সমন পেয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন তারা। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের পেশকার কাজী নূরে আলম যুগান্তরকে বলেন, আমাদের আদালতে সাক্ষী উপস্থিতির কোনো রেজিস্টার নেই। আমার জানা মতে, অধিকাংশ আদালতের এটি নেই। তবে এখন থেকে সাক্ষী রেজিস্টার তৈরি করব। তিনি অভিযোগ করেন, সাক্ষী রেজিস্টার ফরম বিজি প্রেসের সরবরাহ করার কথা থাকলেও সেটি তারা করে না।অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টি আদালত, ঢাকার ১০টি বিশেষ জজ আদালত এবং ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতে সাক্ষী উপস্থিতির কোনো রেজিস্টার নেই। তবে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৫ আদালতের সাক্ষীর রেজিস্টার রয়েছে, যা নিয়মিতভাবে হালনাগাদ হয় না। ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন ও তথ্য বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, ১১০৫ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে এলেও তাদের ফেরত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার ও পিপি। এদের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর সদস্য রয়েছেন ৯৩৯ জন আর সাধারণ সাক্ষী ১৬৬ জন। যাদের নাম সাক্ষী রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এসএম কুদ্দুস জামান সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ক্রিমিনাল রুলস অ্যান্ড অর্ডার অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আদালতগুলোর সাক্ষী রেজিস্টার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতসহ ২৫টি আদালত সাক্ষী রেজিস্টার ব্যবহার না করে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে অবশ্যই আনব। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।সাক্ষীকে ভাতা দেয়া বাবদ আদালতের তহবিল না থাকা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, যদি প্রস্তাবনা আকারে আদালত আমার মন্ত্রণালয়ে পাঠায় তাহলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। সাক্ষী রেজিস্টার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক রোববার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, সিআরও অনুযায়ী, প্রত্যেকটি আদালতে অবশ্যই সাক্ষী রেজিস্টার থাকতে হবে। কিন্তু আদালতগুলো তা বাস্তবায়ন না করে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা কখনোই কাম্য নয়।অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন আনসার সদস্য মো. আব্বাস। তিনি ওই আদালতের দায়রা নম্বর ১১/২০০৯ মামলার সাক্ষী। কিন্তু আদালতের পেশকার ও সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর তাকে ফিরিয়ে দেন। জানতে চাইলে মো. আব্বাস যুগান্তরকে বলেন, সারাদিন ছিলাম সাক্ষ্য দেয়ার জন্য। কিন্তু বিকাল বেলায় এপিপি সাহেব আমাকে ফিরিয়ে দেন। একইভাবে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের দায়রা মামলা নম্বর ৫৮০১/২০০৮ মামলায় বংশাল থানার এসআই মতিউর রহমানকে ৩০ সেপ্টেম্বর এবং একই আদালতের দায়রা নম্বর ১৯২০/২০০১ মামলায় পুলিশ পরিদর্শক নাজমুল হায়দারকে ২১ সেপ্টেম্বর ফেরত দিয়েছেন পিপি ও পেশকার।আরও জানা গেছে, ঢাকার বিশেষ জজ-৪ আদালতের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলা নম্বর ৫২/১২ মামলায় ২৭ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দিতে আসেন কনস্টেবল সাইফুল ইসলাম। কিন্তু তাকে ফেরত দেন পেশকার ও পিপি। আর বিশেষ জজ-২ আদালতের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ৮/১১ মামলায় কনস্টেবল আবদুস সাত্তারকে ফেরত দেয়া হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর। ঢাকার চার নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতে ৯ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দিতে আসেন কনস্টেবল মফিজ উদ্দিন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ৬৪/১৩ নম্বর মামলার সাক্ষী তিনি। ফেরত দেয়া প্রসঙ্গে এই মামলার সাক্ষী মফিজ যুগান্তরকে বলেন, পিপি সাহেব আমাকে বলেছেন, তার সময় নেই। তাই আমাকে ফেরত দিয়েছেন।জানতে চাইলে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, আমাদের পিপিরা তো কোনো সাক্ষী ফেরত দেন না। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট আদালতের পিপিদের বরখাস্ত করা হবে। আদালতগুলোতে সাক্ষী উপস্থিতির কোনো রেজিস্টার ব্যবহৃত হয় না।

No comments

Powered by Blogger.