যুবলীগ নেতা খুন রংপুরে তাণ্ডব

রংপুর মহানগরীর সাতমাথা এলাকার এক যুবলীগ নেতা সোমবার মধ্য রাতে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন। একে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার নগরীতে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে তার সমর্থকরা। সড়ক অবরোধ করে ব্যাপক ভাংচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে তারা। হামলা চালায় শ্রমিক ইউনিয়ন ও ভ্যান মালিক সমিতির কার্যালয় এবং প্যানেল মেয়র ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতার বাড়িতে। খবর সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিক এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে পুলিশ সদস্যরাও তাদের হামলার শিকার হন।
হত্যার শিকার যুবলীগ নেতার নাম ইমরান হোসেন (২৮)। সিটি কর্পোরেশনের পরিবহন টোল আদায়কারী ইজারাদার ছিলেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ইমরানের সহযোগীরা জানান, রাত দেড়টার দিকে ইমরান হোসেন কয়েক সহযোগীসহ মাহিগঞ্জ সাতমাথা এলাকায় একটি হোটেলে খাবার খেয়ে বের হন। গোলচত্বরের কাছাকাছি পৌঁছলে অজ্ঞাত পরিচয় ১০-১২ সশস্ত্র সন্ত্রাসী ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে জখম করে। তিনি লুটিয়ে পড়লে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায় সন্ত্রাসীরা। খবর পেয়ে টহল পুলিশ গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে রাত সাড়ে ৩টায় তার মৃত্যু হয়।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ইমরানের সহযোগী ও রাজনৈতিক বন্ধু-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা সকাল ৭টায় সাতমাথা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে ঢাকা-রংপুর ও লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম-গাইবান্ধা জেলার সঙ্গে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় তারা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ও পিকআপ ভ্যান মালিক সমিতির সাতমাথা অফিসে হামলা চালায়। এখানে দুটি মোটরসাইকেল ও তিনটি মিনিবাসে আগুন দেয় তারা।
৮টায় সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তাজহাটে রংপুর জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ এবং রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ফরিদা কালামের বাসায় সশস্ত্র হামলা চালায় ইমরানের সমর্থক ও রাজনৈতিক বন্ধুরা। বাড়ির আসবাবপত্র, দরজা-জানালা ব্যাপক ভাংচুর ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তারা নারী ও শিশুদেরও লাঞ্ছিত করে। তবে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান ফরিদা কালাম ও আবদুল মজিদ। পরিবারের সদস্যরা জানান, রাতে থাকার ও খাবার মতো কোনো জিনিসপত্র বাসায় অক্ষত রাখা হয়নি।
ঘণ্টাব্যাপী ওই হামলার খবর সংগ্রহ করতে গেলে চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরাপারসন এহসানুল হক সুমন হামলার শিকার হন। তাকে মারধর করে মারাত্মক জখম করে তারা। ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। তাকে একটি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। একই সময় পুলিশের মাহিগঞ্জ ফাঁড়ির ইনচার্জ শাহীনুর রহমান ও কনস্টেবল হাফিজও আহত হন। প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর পুলিশ মাহিগঞ্জ সাতমাথা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।
এ হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে এবং হামলাকারীদের গ্রেফতার দাবিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের বিভাগীয় কমিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য রংপুর বিভাগে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয় সকালে। এতে বিভাগের ৬৫টি সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিকাল ৫টায় ধর্মঘট প্রত্যাহার করে হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়।
কে এই ইমরান? : ইমরান হোসেন রংপুর মহানগরীর মাহিগঞ্জ বীরভদ্র বালাটারী গ্রামের পরিবহন শ্রমিক দুলাল মিয়ার ছেলে। মা নুরজাহান বেগম। ইমরান বর্তমানে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সিটি কর্পোরেশনের পরিবহন টোল আদায়কারী ইজারাদার হিসেবে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় টোল আদায় করে আসছেন। এ ছাড়াও এলাকার জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসা করে উপকারভোগীদের কাছ থেকে কমিশন নিতেন তিনি। কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানায়, ইমরানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১২টি মামলা রয়েছে।
খুনের কারণ কী? : পুলিশ ও কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাছে নির্দিষ্ট তথ্য নেই। পরিবারের লোকজনও স্পষ্ট করে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। ছয় বন্ধু মিলে ইমরান গত বছর সিটি কর্পোরেশনের টোল আদায়ের ইজারা নেন। এবার এদের মধ্যে দুই বন্ধুকে বাদ দিয়ে ৪ জন মিলে ৪৪ লাখ টাকায় ইজারা নেন তিনি। এ নিয়ে তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে। এ ছাড়াও চাঁদাবাজি, জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ, একটি সমবায় সমিতির জমি দখল-পাল্টাদখল, পরিবহন থেকে নিয়মবহির্ভূত টোল আদায় নিয়ে তার সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রতিপক্ষ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ নিয়ে বেশ কয়েক দফা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও রয়েছে বিভিন্নজনের সঙ্গে।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব ঘটনাকে সামনে রেখে তদন্ত করলেই খুনের রহস্য বেরিয়ে আসবে। তাদের মতে, খুনের দেড় ঘণ্টা আগে কোতোয়ালি থানার ওসির কাছে জমিজমা বিষয়ে কয়েকজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দেন ইমরান। খুনের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে কিনা সেটিও দেখা উচিত।
কোতোয়ালি থানার ওসি আবদুল কাদের জিলানী জানান, মামলা পাওয়ার পর অভিযোগের সূত্র ধরে এবং তাদের কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলার তদন্ত শুরু করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.