তেল গ্যাস উত্তোলন-সাত বোনের না বদলানোর কেচ্ছা

সাত ভাই চম্পা জাগো রে জাগো রে’ কথাগুলো দিয়ে বেশ অনেক বছর ধরেই জনপ্রিয় গানটা অনেকেই নিশ্চয় শুনেছেন। শুনতে শুনতে গুনগুনানিও হয়তো হয়েছে। কিন্তু সাত বোন নিয়ে গান মনে পড়ছে না। সাত বোন একটা বইয়ের নাম, বছর পঁয়ত্রিশেক আগের।
দিনবদলের হাওয়ায় গত সাত-আট মাসে বিশেষ কিছু বদলিয়েছে বলে চোখে পড়ছে না। তাই সেই প্রসঙ্গ আপাতত থাক। তবে দিন বদলাচ্ছে আর গত কয়েক মাসে না হলেও নিকট-অতীতে হয়তো অনেক কিছু বদলে গেছে, যা আমার চোখে পড়েনি। এমনিতেই ইদানীং দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে, তাই হয়তো চোখে পড়েনি। দিন হয়তো বদলাচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি না।
যেমন বিজেএমইর কোনো নেতা বা বিরাট গার্মেন্টের কোনো মালিক হয়তো ঈদের আগে ঘোষণা দিয়েছেন যে এবার ঈদে তিনি দেড় কোটি টাকার গাড়ি না কিনে সেই টাকায় শ্রমিকদের জন্য দুটো বাস কিনে দেবেন। হাজার হলেও গত দু-তিন বছরে একটা ২০, আরেকটা ৩০ আর তৃতীয়টা ৭০ লাখ টাকায় তিনটি গাড়ি কেনা হয়েছে। বাসার সবাই ধরেছে—এবার একটা মার্সিডিজ বা বিএমডব্লিউ চাই। দরকার হলে দুই বছর আগে কেনা একটি গাড়ি বিক্রি করে দিতেও বাসায় কারও আপত্তি নেই। তা ছাড়া নিজেরই চারটি গাড়ি থাকলে বাসায় গাড়ি রাখার জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। আরেকটু বড় বাড়িও দরকার। সেটা পরে। আপাতত এই ঈদে দেড় কোটি টাকার একটা গাড়ি হলেই চলবে। দু-চারটা গাড়ির শোরুমে যাওয়া-আসাও হয়েছে।
এমন অবস্থায় গাড়ি কেনার প্ল্যান বাদ দিয়ে নিজের শ্রমিকদের জন্য বাস কেনার ঘোষণাটা চোখে পড়েনি কোনো পত্রিকার খবর হিসেবে।
দিন বদলায়নি। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চয়ই বদলিয়েছে। বিজেএমইর পক্ষ থেকে চান্স পেলেই জাহির করা হয় যে গার্মেন্টস খাত থেকে আমাদের রপ্তানি আয়ের শতকরা ৭৬ বা ৭৭ শতাংশ আসে প্রতিবছর। আমরাও তাই এটাই ভাবি—তাই তো। আমাদের পাউন্ড, ডলার, ইউরোর কমবেশি তিন-চতুর্থাংশই যখন এ খাত থেকে আসে, তখন এ খাতকে রক্ষা করা সবার জাতীয় দায়িত্ব। এই খাত থেকে আমাদের সব ডলার, পাউন্ড, ইউরোই যখন আসে, আর তা আসলে এই ঈদ মৌসুমে যে চিনি, আলু, ভোজ্যতেলসহ সবকিছুই বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করতে হয়, সে আমদানির বৈদেশিক মুদ্রা কোথায় পেতাম।
হক কথা। যদি সত্যি হতো। শতকরা ৭৫ ভাগের হিসাব ডাহা মিথ্যা। যেমন মিথ্যা ব্যবসায়ীদের ঈদের আগে চাল, ডাল, তেল, চিনির দাম না বাড়নোর পঞ্চাশ বারের প্রতিশ্রুতি। কিছু জিনিস বদলায় না। দিনবদলের কথা আমরা যতই জপি না কেন।
২.
সাত বোনের কেচ্ছা এই না-বদলানোর কেচ্ছা। বছর পঁয়ত্রিশেক আগে বইটি বাজারে এসেছিল। এন্থনি স্যামসনের বই, নাম দি সেভেন সিস্টারস। ওই বইয়ের সাত বোন ছিল সে সময়ের সাতটা সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি। ওই সাতটা তেল কোম্পানি সারা বিশ্বের বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল তার রোমাঞ্চকর কাহিনী। রোমাঞ্চকর এ জন্য যে বইটি না পড়লে সহজে বিশ্বাসই হবে না যে তখন ওই তেল কোম্পানিগুলো কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর তেল উত্তোলন আর রপ্তানির নামে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তেলসমৃদ্ধ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্বাধীন হয়ে পড়ায় বড় তেল কোম্পানিগুলো কিছুটা বিপাকে পড়েছিল। সেই বিপাকটা ছিল অল্পস্থায়ী। বইটির পুরো টাইটেল ছিল দি সেভেন সিস্টারস: দি গ্রেট ওয়েল কোম্পানিজ অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড দে শেইপড।
১৯৭৭ সালে প্রকাশিত এন্থনি স্যামসনের আরেকটি বই দি আর্মস বায়ার এ স্টাডি অব ইন্টারন্যাশনাল আর্মস ট্রেডার অর্থাত্ অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো তাদের উত্পাদিত অস্ত্র বিক্রির জন্য কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ বাধিয়ে দেয় তার বিশ্লেষণ।
স্যামসনের সাত বোন-এর ফিরিস্তির পুরোটাই এখন অত প্রয়োজনীয় নয়। তাও দু-চারটার নাম পরিবর্তিত, কারণ এখনো তারা বহাল তবিয়তে তেল ব্যবসা করছে। তখন ছিল এশো (Esso)। এখন হয়েছে অ্যাকশন মবিল রয়েল ডাচ শেল; স্টান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া, এখন হয়েছে শেভরন। ওই সময়ের সাত বোনের এক বোন— গালফ ওয়েল এখন শেভরনের অংশ অর্থাত্ ১৯৮৫ সালে শেভরন গালফ ওয়েলের বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছিল। আরেক বোন, টেক্সাকোকেও শেভরন হজম করে ফেলেছে।
আর আমরা বাংলাদেশে বসে সেই শেভরনের সঙ্গে দেন-দরবার করছি। নিজের জন্য কোটি টাকার গাড়ি কেনার বদলে শ্রমিকদের জন্য বাস কেনার মতো আমরাও ভাবছি, শেভরনের মতো তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। দিন বদলেছে!!
৩.
সাত বোন নিছক একটা বই যে না তার প্রমাণ—১১ মার্চ ২০০৭ সালের লন্ডনের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা দি ফাইনানশিয়াল টাইমস, ‘দি নিউ সেভেন সিস্টারস’ নামে একটি প্রতিবেদন ছাপে। মুখ্য প্রতিপাদ্য ছিল সেই পুরোনো সাত বোন আর নেই। তাদের জায়গায় নতুন সাতটা বড় তেল কোম্পানির উত্থান হয়েছে, যাদের মধ্যে এখন আছে সৌদি কোম্পানি আরামকো রাশিয়ার গ্যাজস্প্রম, নিওক (ইরান), পেট্রোনাস (মালয়েশিয়া) ইত্যাদি। অর্থাত্ তেল আছে এমন অনেক দেশ নিজের তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য দেশের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের কোম্পানি গড়ে তুলেছে। আর এসব কোম্পানি এখন তাদের স্ব-স্ব দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অন্যান্য দেশেও তেল-গ্যাস আবিষ্কার আর উত্তোলনের ব্যবসায় পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে।
আর আমরা আমাদের পেট্রোবাংলাকে প্রায় ৪০ বছরেও কেন আঁতুড় ঘরে রেখে দিয়েছি, সেটা কি খুলে বলতে হবে? এখন খোদ আমেরিকার কেচ্ছা। সারা পেলিনের নাম আমরা ইতিমধ্যে বোধ হয় ভুলতে বসেছি। ওবামা-জো বাইডেনের বিরুদ্ধে এই মাত্র গত বছরের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন জন ম্যাককেইনের সঙ্গে। সারা পেলিন তখন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আলাস্কার গভর্নর অর্থাত্ পাশের ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা আগের জ্যোতি বসুর মতো নির্বাচিত প্রধান নির্বাহী। খবরে দেখলাম, সপ্তাহ দুয়েক আগে সারা গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
আলাস্কা তেল-গ্যাসে ভরপুর স্থান। সেই আলাস্কার সারা পেলিন নিয়ে ২০০৭-এ বই বেরিয়ে ছিল, সারা টেকস অন বিগ ওয়েল বই। বইয়ের এই ইংরেজি নামটির বাংলা অনুবাদ করা আমার জন্য কষ্টসাধ্য। ভাবার্থ অনেকটা এ রকম—বড় তেল কোম্পানিকে সারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তেল-গ্যাস বিশারদ দুই সাংবাদিক বইটি লিখেছিলেন সারা পেলিনের কার্যাবলির ওপর ভিত্তি করে। খোদ আমেরিকায় বসে সারাকে দেখতে হয়েছিল যে তিনি কীভাবে বড় তেল কোম্পানিকে বাগে রাখতে হয়েছিল। স্বীকার করছি অকপটে যে বইটি পড়িনি, ইন্টারনেটে পুস্তক সমালোচনা পড়েছি। কিন্তু মর্ম আন্দাজ করেছি।
তাই ১৪ সেপ্টেম্বরের তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির হরতালের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন টক শোতে সরকারি দলের হর্তাকর্তা ব্যক্তিদের তেল কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ দেখতে বেশ মজাই লাগছিল।
একটা পুরোনো কথা আমার মনের মাধুরী মিশিয়ে বলি, সৃষ্টিকর্তা যখন কোনো জাতির ওপর থেকে তার অনুকম্পা হ্রাস করেন, তখন জাতি, বিশেষত জাতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা প্রথমে এবং ক্রমান্বয়ে জাতিটা বোকা হয়ে যায়।

৪.
গার্মেন্টসের মালিকেরা নিজেদের জন্য গাড়ি না কিনে শ্রমিকদের জন্য বাস ক্রয় করেছেন—খবরটা একটার পর একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থেকে যখন পেতে শুরু করব, তখন ভাবতে শুরু করব যে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি আর আমাদের কর্মকর্তারা আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে গেছেন। নিদেনপক্ষে তাঁরা যৌক্তিক চুক্তি করছেন।
বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আর পরে আবিষ্কৃত তেল-গ্যাস ভাগাভাগি, বিক্রি আর রপ্তানি-সংক্রান্ত চুক্তিগুলো যদি যৌক্তিক এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই থাকে, তাহলে চুক্তিগুলো এখনো কেন গোপনীয়।
লেখা শেষ হওয়ার আগে মাঝপথেই একটা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে রাখি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ ফারুক ইংল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয় তেল-গ্যাস চুক্তি এবং এ সংশ্লিষ্ট আইনের বিষয়ে তার পিএইচডি থিসিস লিখেছে। তেল-গ্যাস সংক্রান্ত আইন নিয়ে চর্চার জন্য ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ফারুক বলছিল যে তার থিসিসের গবেষণার জন্য সে প্রচুর খোঁজাখুঁজি করেছিল। আমাদের জাতির পক্ষে আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর সবটাই ‘অতি গোপনীয়’।
একটা চুক্তি নিয়ে দুই পক্ষ আলাপ-আলোচনা করে, দরদাম করে তখন সেটা গোপনীয় থাকতেই পারে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর সংবিধানকে মাঠে নামাই। সংবিধানের ১৪৩ অনুষদে বলা আছে ক) দেশের ভূমি এবং খ) সমুদ্র সীমানার অন্তর্গত সকল খনিজ ও মূল্যবান সামগ্রীর মালিক প্রজাতন্ত্র। আর সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। অর্থাত্ সকল খনিজ সম্পত্তির মালিক জনগণ।
আমাদের খনিজ সম্পদ কে, কোথায়, কীভাবে, কী শর্তে, কত দামে বিক্রি করছে, সেটা আমরা-জনগণ জানতে পারব না, এটা তো হতেই পারে না। আমাদের সম্পদ আমাদের কাছ থেকে ‘গোপন’ রাখবে—এ কেমন কথা, এটা কি মগের মুল্লুক।
মোদ্দাকথা, চুক্তি নিয়ে আলাপ-আলোচনা সরকারের দায়িত্ব। সে পর্যায়ে আমাদের না জানালেও চলবে। তবে ২০, ৩০, ৪০ বছর মেয়াদি চুক্তি, স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জানার আধিকার দেশের জনগণের আছে।
ড. ফারুক জানিয়েছে, বিভিন্ন দেশে এ গোছের চুক্তি এখন তথ্য জানার অধিকারের আওতাভুক্ত।
জানতে চাই। জানাতে হবে। অবিলম্বে!
ড. শাহদীন মালিক। অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, ডাইরেক্টর, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.