সদা জাগ্রত এক বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ by ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

এই তো মাত্র সেদিনের কথা। ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা এক টেবিলে বসেছি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং তার স্ত্রী ও বিচারপতি হাবিবুর রহমান। আর রয়েছি আমি এবং আমার স্ত্রী। উপলক্ষ একটি বিয়ের অনুষ্ঠান। প্রায় এক ঘণ্টা আমরা কাটালাম সেখানে। এ ধরনের পরিবেশে আগেও দেখেছি, বিচারপতি হাবিবুর রহমান মুহূর্তেই পরিণত হয়ে যান মধ্যমণিতে। তার নিজের বয়স যে কোনো বাধা হয় না। চারপাশে যারা থাকেন, তাদের বয়স কিংবা পেশাও তিনি বিবেচনায় নেন না। প্রাণবন্ত বরাবরের মতো, কৌতুক ও হাস্যরসাত্মক শব্দ ও বাক্য কীভাবে যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয়ে আসতে থাকে। ৮৫ বছরের ঋজুদেহ মানুষটিকে একবারের জন্যও মনে হয়নি অসুস্থ। বয়সের ছাপ অবশ্যই ছিল, কিন্তু মুখাবয়বে বোঝার উপায় নেই। জানালেন, শরীর ভালোই যাচ্ছে। পায়ের ব্যথা কমেছে। সহজেই হাঁটতে পারছেন। বর-কনেকে আশীর্বাদ জানাতে মঞ্চে উঠে গেলেন। একটু ধরেই তুলতে হলো তাকে। কিন্তু হেসে বললেন, পরের বার এমনটি করতে হবে না, নিজেই হেঁটে উঠতে পারব।
আমাদের বারবার মনে হচ্ছিল, এমন মানুষ আছেন বলেই আমাদের ভাষা এত সুন্দর, প্রাঞ্জল, এত প্রিয়। আমাদের সামাজিক সৌজন্য ও সুশীলতা মুগ্ধতায় ভরা।
তার সঙ্গে আরেকবার গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে, ফোবানার সম্মেলনে। সেখানেও আমাদের চেনা মানুষটি। হাসি-আনন্দে সঙ্গ দিচ্ছেন সবাইকে। কিন্তু মর্মাহত হয়েছেন সেখানে গিয়ে। ফোবানার আয়োজন হয় ভিন্ন ভিন্নভাবে। সেখানেও পক্ষ-বিপক্ষ। এ ভেদাভেদ তার পছন্দ নয়। তিনি অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের মধ্যে ভাগ, এখানেও ভাগ। উদ্যোক্তারা এমন কথা আদৌ পছন্দ করবেন না, সেটা জানা ছিল। কিন্তু বিচারপতি হাবিবুর রহমান এমন ভাগের রাজনীতি কখনও পছন্দ করেননি এবং তা সবার সামনে বলতেও তার দ্বিধা নেই। তিনি বলেন, এমন ভাগ ভালো লাগে না। এতে দেশ পিছিয়ে পড়ে।
বাঙালি রেনেসাঁ আমাদের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করেছে, চিৎমুক্তি ও সমুন্নতির আদর্শে সমৃদ্ধ করেছে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব এ আদর্শ ধারণ করেছেন, অনেক অনেক ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান এ ধারারই আলোকিত প্রতিনিধি। তিনি যুক্তিবাদী। জ্ঞানের পেছনে ছুটেছেন সর্বদা এবং তা আয়ত্তেও এনেছেন। কিন্তু যা কিছু এভাবে তার অর্জন, সেটা কখনও আস্তিনে ভরে রাখেননি। প্রকৃত জ্ঞানী তিনি এবং তা অপরের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সদা সক্রিয় থেকেছেন। কোরআনসূত্র এবং যথাশব্দের মতো গ্রন্থের প্রণেতা বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে মেধা-মননে ঋদ্ধ অন্য এক উচ্চতার মানুষকে আমাদের অনুভবে নিয়ে আসে। তিনি যে কোনো বিষয় পরিপূর্ণভাবে আয়ত্ত করায় সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন এবং এ জন্য যতটা গভীরতায় যাওয়া যায়, ততটাই নেমে পরিমাপ করার চেষ্টা করতেন। তিনি যুক্তিতর্ক পছন্দ করতেন। সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ বুঝতে পারতেন দ্রুততার সঙ্গে। এ কারণে হতাশও হতেন কখনও কখনও। যখন দেখতেন যে সামনে রয়েছে জাজ্বল্যমান সত্য, কিন্তু কেউ কেউ সেটা বুঝতে চাইছে না কিংবা তা উপেক্ষা করে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে_ তিনি হতাশা ব্যক্ত করতেন এবং ক্ষোভ আড়াল করতে পারতেন না। তার লেখালেখিতে আবেগ ও যুক্তির স্পষ্ট প্রতিফলন থাকত। কবিতায় দেখা যেত আবেগ। আর সমাজ বিশ্লেষণে অনুসরণ করতেন যুক্তির পথ। এখানে প্রকাশ পেত তার বিচারিক সত্তা। এমন ভারসাম্য কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।
তিনি নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা ও রসিকতা করতে পারতেন। জ্ঞানের কথা শুনলে শিশুর মতো বসে পড়তেন। নওয়াজেশ আহমদ একবার বনফুল নিয়ে কথা বলছিলেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান শুনছেন তো শুনছেন। আমি বলি, স্যার এভাবে তো বনফুল নিয়ে অনেক কিছু জেনে গেলেন। তিনি বলেন, নওয়াজেশ এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। আমি কিছুটা জেনেছি, ওর এবং প্রয়োজনে অন্য কারও কাছ থেকে আরও জানতে হবে। এ জন্য বসতে হবে। আমাদের চারদিকে এত বনফুল ছড়িয়ে আছে, এটা জানা ছিল না।
তিনি মানুষকে মূল্য দিতেন। অনেক সময় ইংরেজি প্রতিশব্দ জানতে চাইতেন। হয়তো বিষয়টি তিনি জানেন, কিন্তু তার প্রকাশ না ঘটিয়ে অন্যদের কাছ থেকে জানার জন্য গভীর মনোযোগ নিবদ্ধ করতেন। জ্ঞানীদের সম্মান দিতেন। তার মধ্যে সদা জাগ্রত এক বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ। সেন্স অফ হিউমার বলতে যা বোঝায়, তার পরিপূর্ণভাবে ছিল তার মধ্যে। সুন্দর করে কথা বলতেন। পরিহাসপ্রিয়তা কখনও তাকে ছেড়ে যায়নি। বনেদিয়ানা বলতে যা বোঝায় সেটা ছিল তার মধ্যে, তবে এমনভাব তার মধ্যে কখনও দেখিনি। বরং এর প্রকাশ হতো একেবারে ভেতর থেকে, বুনিয়াদি থেকে। তিনি এর প্রকৃত উত্তরাধিকার।
পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলন থেকে তার রাজনীতির জগতে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা। জেল খেটেছেন এ জন্য। স্বাধীনতার পথপ্রদর্শকদের একজন তিনি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে ক্ষমতাকে সর্বোত্তম ব্যবহারে অনন্য সফলতা দেখালেন। সে সময়ে এক সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মুখে তিনি বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দিয়ে দ্রুত পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করায় ভূমিকা রাখেন। তার সাহস ও দৃঢ়সংকল্প দেশকে কঠিন সময়ে নির্বাচনের পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। বিএনপি ১২ জুনের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। তারা কারচুপির অভিযোগও আনে। কিন্তু বিচারপতি হাবিবুর রহমান যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছেন, সে বিষয়ে তাদেরও সংশয় ছিল না।
তার প্রয়াণে শূন্যতার সৃষ্টি হবে। দেশ প্রয়োজনীয় সময়ে দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হবে। ব্যক্তিগতভাবে তার অভাব বোধ করব। আরও একটি বিষয়ে মনোকষ্ট থাকবে অনেকদিন। জাতীয় জাদুঘরের মৌখিক ইতিহাসের একটি প্রকল্প রয়েছে। এ জন্য বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল। ৩১ ডিসেম্বর বিয়ের অনুষ্ঠানের খাবার টেবিলে এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমি ইতিহাসের ছাত্র, তবে ইতিহাসবিদ নই। তিনি যেন সাক্ষাৎকার দেন, সে জন্য ড. আনিসুজ্জামানও অনুরোধ করেন। আমরা সেখানে বসেই একটি তারিখ চূড়ান্ত করার চেষ্টা করি। কথা হয়, ১৮ জানুয়ারির পর দেখা করব। কিন্তু তিনি যে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন।
তার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.