অভিভাবকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা আজ

জাতি আজ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবে পেশায়, কর্মে, মননে অসামান্য ব্যক্তিত্ব, বিবেকের কণ্ঠস্বর, অভিভাবকতুল্য, সদ্যপ্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে। আজ সোমবার সকাল ১০টায় সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হবে। এর পর দুপুর ১২টায় নেওয়া হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। সেখান থেকে বাদ জোহর গুলশানের আজাদ মসজিদে নেওয়া হবে। সেখানে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হবে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে দৃঢ়চিত্তে সামনের সারিতে থেকে বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার পরিচয় দেন। পেশাগত জীবনে বিচারাঙ্গনে, সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্বে পালনে প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়। সততা, নিষ্ঠা আর দল-মত-শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে প্রজ্ঞায় মানুষের পরম শ্রদ্ধার আসনে স্থান করে নিয়েছিলেন দৃঢ়চিত্ত এই ব্যক্তিত্ব। একই সঙ্গে মননশীল লেখক হিসেবে জাতিকে দিয়েছেন অযুত বছরের আলোর ঠিকানা। শিখিয়ে গেছেন বেঁচে থাকার দর্শন_ 'বেঁচে থাকার অধিকার হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।' বিশ্বে যত ভাষায় মাতৃভাষা নিয়ে কবিতা রচিত হয়েছে, তার প্রায় সবই বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার দুরূহ কাজটিও সম্পাদন করেছেন অমিত পরিশ্রমী এ মানুষটি। শনিবার রাতে সবাইকে শোকাচ্ছন্ন করে হঠাৎ চলে যান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হাসপাতালে গেছেন ঠিকই, কিন্তু শেষ চিকিৎসার কোনো সুযোগই তিনি দেননি। কর্তব্যরত চিকিৎসক সবাইকে কাঁদিয়ে জানিয়ে দেন, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। মুহূর্তেই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে জাতি। প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরীসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকে রাতেই ছুটে যান ইউনাইটেড হাসপাতালে। রাতে তার শ্যালক আলী ইফতিয়ার চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, সোমবার ভোরে তার মেয়ে নুসরাত হাবিব যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসবেন। সে পর্যন্ত তার মরদেহ ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে।
সর্বস্তরের মানুষের শোক :মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মৃত্যুতে দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ শোকগ্রস্ত। রোববার এই মহান ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দেশি-বিদেশি সংস্থা, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন। বিবৃতিতে বলা হয়, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে হারিয়ে জাতি সত্যিকারের অভিভাবককে হারিয়েছে। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। বিবৃতিতে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক বিবৃতিতে দলের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করে বলেন, রাজনৈতিক সংকটে তার সুচারু মন্তব্য তাকে জাতির অভিভাবকের আসনে বসিয়েছিল। তার মৃত্যুতে জাতি প্রকৃত একজন বাঙালি ও সংস্কৃতিমনা অভিভাবককে হারাল। জাতীয় পার্টির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দশম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এক বিবৃতিতে গভীর শোক জানিয়ে বলেন, দর্শন ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান দেশের বিচারিক অঙ্গনে তাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তার মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছিলেন একাধারে বিচারপতি, গবেষক, ভাষাবিদ ও শিক্ষক। 'বেঁচে থাকার অধিকার হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার'_ তার এই দর্শন জাতির কাছে অনন্য হয়ে থাকবে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক শোকবার্তায় বলেন, যারা তাকে কাছে থেকে দেখেননি, তারা বুঝতে পারবেন না কত চমৎকার মানুষ ছিলেন তিনি। জাতির এই দুর্দিনে তাকে হারিয়ে সবাই খুবই অসহায় বোধ করছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক এক শোকবার্তায় বলেন, দেশের বিচার ব্যবস্থায় অবদান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে জাতির সংকটময় মুহূর্তে দৃঢ়চিত্তে সাহসী দায়িত্ব পালনের জন্য বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জাতি যেমন একজন অভিভাবক হারিয়েছে, তেমনি টিআইবি একজন অকৃত্রিম বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীকে হারিয়েছে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর শোকবার্তায় বলা হয়, বিচার বিভাগের অন্যতম নক্ষত্র সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে অনুকরণীয় বিচক্ষণতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। তার মৃত্যুতে আদর্শবান শিক্ষক, খ্যাতনামা লেখক এবং প্রগতিশীল কৃতী সন্তানকে হারিয়েছে জাতি।
তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে রোববারও শোকবার্তা পাঠায় বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ওয়ার্কার্স পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, গণসংহতি আন্দোলন, ন্যাপ, ঐক্য ন্যাপ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ, সুশাসনের জন্য নাগরিক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাগরিক উদ্যোগ, মহিলা পরিষদ, জাকের পার্টি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, যুবমৈত্রী, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ফেডারেশন। রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীর কৃতী সন্তান, দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মৃত্যুতে রাজশাহীর সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পৃথক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছেন রাজশাহীর সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল খালেক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী সারওয়ার জাহান, রাজশাহী লেখক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক রুহুল আমিন প্রামাণিক, কবিকুঞ্জের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল হক কুমার ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আবুল হোসেন।

No comments

Powered by Blogger.