এমন দেশটি কোথাও খুঁজে...

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের যে গানটি আমাদের শিহরিত করে, শিরায় অনুরণন তোলে, আবেগে জড়িয়ে পড়ে অধিরতা_ সে গানটির প্রথম কলি নতুন মাত্রা, নতুন অভিধা পেয়েছে। দ্বিতীয় কলিটি এখন যেন উপহাসেরই নামান্তর। 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে_ আমার জন্মভূমি।' এই গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার পরম উৎস ছিল। এখন এ গানটির প্রথমাংশ বিপরীতার্থে মানুষ গুনগুন করে। বেদনায় দীর্ণ হয় তাদের হৃদয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মর্মান্তিক সব ঘটনায় চোখ অশ্রুরুদ্ধ হয়। এত মৃত্যু, এত হাহাকার, এত দীর্ঘশ্বাস! ক্ষমতায় থাকা কিংবা সহিংস পথে ক্ষমতায় যাওয়ার রক্তঝরা পথের সঙ্গে মিশে আছে কত না অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাস। পেট্রোল বোমায় প্রাণ হারাচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু। ভয়ঙ্কর ভীতি গ্রাস করেছে 'সকল দেশের রানী' বলে পরিচিত আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায়। জীবন-জীবিকার পথও প্রায় রুদ্ধ। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, ঘোরতর অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চতুর্দিক। এরই মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হলো_ এ নির্বাচনের ফসল নতুন সরকার গতকাল শপথ নিল। খালেদা জিয়া তাত্তি্বক অর্থে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। যুদ্ধে এক পক্ষ জয়ী হয়েছে, আপাতত পরাজিত হয়েছে অন্য পক্ষ। মাঝখানে নিরীহ মানুষ_ যারা উলুখাগড়া, তাদেরই সর্বনাশ হচ্ছে। এসব মন্তব্য তাদের, যারা রাজনীতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেন। এসব মন্তব্য তাদের, যাদের বেশিরভাগই টেলিভিশনের টক শোতে কথা বলেন, সংবাদপত্রে কলাম লেখেন। তাদের সব কথা, সব পরামর্শ অরণ্যে রোদন মাত্র।
একাধিক বিশিষ্টজন সমকালকে সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে'র কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ সত্যি এক অদ্ভুতুড়ে দেশের অভিনব উদাহরণ। কোথায় আমরা এমন দেশ খুঁজে পাব, যেখানে দর-কষাকষি করে একটি দল সরকারে থাকছে, বিরোধী দলেও থাকছে। গাছেরটাও খাচ্ছেন, তলারটাও কুড়োচ্ছেন। অনেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কথা বলেন। সে তো ভিন্ন প্রেক্ষাপট। রক্তাক্ত যুদ্ধের পর নেলসন ম্যান্ডেলাও প্রতিপক্ষ সাদাদের নিয়ে যথাযথ অর্থে ঐকমত্যের সরকার গঠন করেছিলেন, সেখানে ছিল না কোনো বিরোধী দল। দেশের মঙ্গলের জন্য সব মন, সব প্রাণ এক হয়েছিল। বিশ্লেষকরা বলেছেন, চোখ বুজে দৃশ্যটি কল্পনা করুন, জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত বিল সংসদে আলোচনা হলো। 'গৃহপালিত' বলব না। বলব, 'নতজানু' বিরোধী দল। সরকার ও বিরোধী দল সমস্বরে উচ্চারণ করল 'হ্যাঁ'। স্পিকার সংসদীয় ভাষায় বললেন, 'হ্যাঁ' জয়যুক্ত হলো, 'হ্যাঁ' জয়যুক্ত হলো, 'হ্যাঁ' জয়যুক্ত হলো। এভাবে 'হ্যাঁ' জয়যুক্তের পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি যে বিপন্ন হবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তা-ও স্মরণ করিয়ে দিতে চান। তারা বলছেন, কথার চাতুরী নয়, অহংবোধ নয়। মানুষের কথা শুনুন, তাদের কথা বুঝুন, একই সঙ্গে অন্তরাত্মার কথাও শুনুন। তারা বলছেন, হরতাল-অবরোধ-হত্যা বন্ধ করুন। মানুষ মারার রাজনীতি আর নয়। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে সংবিধানস্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার সুযোগ দিন। তাদের আবার সংলাপে ডাকুন। সে ডাকে কোনো শর্ত ছাড়াই বিরোধী দল সাড়া দিক। যুক্তির মারপ্যাঁচে অন্ধকারের পথে না হেঁটে দু'পক্ষই 'আলোর পথযাত্রী' হোন। যত দ্রুত সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে আর একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করুন। বিদেশিদের চাপের কাছে নতিস্বীকার নয়, জনমতকেই শিরোধার্য করুন। এতে দু'পক্ষই জয়ী হবে।

No comments

Powered by Blogger.