রাজনীতির সপ্তাহ-আমাদের এত মানবতা! by মোস্তফা মামুন

গোলাম আযমের রায়ের চার রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
১. সরকার বা আওয়ামী লীগ খুশি।
২. বিএনপি নিশ্চুপ।
৩. গণজাগরণ মঞ্চ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের বেশির ভাগ মানুষ হতাশ।
৪. গোলাম আযমের পরিবার এবং জামায়াতে ইসলামী ক্ষুব্ধ।
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াটা তিন রকম।
এখানে,
১. সরকার, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষ আনন্দিত।
২. বিএনপি এবারও নিশ্চুপ।
৩. মুজাহিদ পক্ষই শুধু ক্ষুব্ধ।
এই চার রকম, তিন রকম কিংবা নানা রকম প্রতিক্রিয়া কেন হবে? কেন এক রকম প্রতিক্রিয়া হবে না! এদের অপরাধ পুরো দেশের বিরুদ্ধে, সেই অপরাধের
শাস্তির দিনে এমন বিভক্তি আসলে গৌরবের বদলে একটা জাতীয় লজ্জা বয়ে আনে। ভাবা যায়, যারা এই দেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে এবং বিরোধিতাটাকে শুধু কথায় আটকে না রেখে নেমে পড়েছে নৃশংস নিষ্ঠুরতায়, তাদের শাস্তিতেও আমরা সবাই খুশি হতে পারি না। তত্ত্বকথা আওড়াই। রাজনীতির সম্বন্ধ খুঁজি। স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক মান ইত্যাদি বলে বলে নিজেদের আরো হাস্যকর করে তুলি।
কয়েক মাস আগে একটা টিভি টকশোতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য এবং আওয়ামীপন্থী একজন বুদ্ধিজীবী। শুরুর হাসিখুশির পর একসময় দুজনের মধ্যে তর্ক শুরু হয়ে গেল। স্বাভাবিক। সেই তর্কের এক পর্যায়ে এসে বিএনপির নেতাটিকে মনে হলো বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী আর আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীটিকে মনে হলো আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, কারণ ওই নেতার চেয়েও কট্টর তাঁর অবস্থান, আরো যুক্তিহীন তাঁর বক্তব্য। তো এমনি একজন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী মুজাহিদের রায়ের রাতে টিভিতে উপস্থিত। দেখেই বোঝা গেল, স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিক মান ইত্যাদি নিয়েই তিনি বেশি উদ্বিগ্ন। মুজাহিদের অপরাধ যেন গৌণ, বিচারে মানবাধিকার রক্ষিত হলো না লঙ্ঘিত হলো তাই নিয়ে বেচারার দারুণ দুশ্চিন্তা। এতে সমস্যা নেই কোনো, এই কথাগুলো এঁরা বছরের পর বছর ধরে বলছেন। কিন্তু সেদিনও বলবেন! মুজাহিদের মানবতাবিরোধী অপরাধ যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রমাণিত, যে দিনটা গোটা জাতির জন্য একটা কলঙ্কমুক্তির দিন। তাও যখন ৪২ বছরের দগদগে স্মৃতি নিয়ে সেখানে উপস্থিত মুজাহিদের নির্মমতার সরাসরি শিকার এক শহীদ পরিবারের সন্তান। এসব নয়-ছয় বললেন এবং আবেগাক্রান্ত শহীদ সন্তানের কাছে বেশ খানিকটা অপমানিতও হলেন। পরদিনও একই দৃশ্য। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আরেকজন নেতার মুজাহিদের পক্ষে ওকালতি এবং আরেক দফা অপমান। দুঃখের এবং লজ্জার তথ্য, এই নেতাটি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা!
সেই মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁর দল ও জোটের বক্তব্য তাঁরা ক্ষমতায় গেলে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। এবং সেটা হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক মানের। তাঁদের কথার ভিত্তিতে কয়েকটা উন্মুক্ত প্রশ্ন,
১. আচ্ছা গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাকা চৌধুরীবিহীন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাটা কি তাঁদের কাছে আছে? থাকলে কি দয়া করে জাতিকে জানাবেন!
২. তাঁরা স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিক মান ইত্যাদি নিয়ে খুব হৈচৈ করেন। আমাদের দেশে একটা বিচারব্যবস্থা আছে, প্রতিদিন তাতে হাজারও মানুষের বিচার হচ্ছে, কই তাদের বিচারের ক্ষেত্রে তো আন্তর্জাতিক মানের জন্য চিৎকার আমরা শুনতে পাই না। এ দেশের সাধারণ মানুষের বিচার হতে পারবে দেশীয় মানে, কিন্তু যারা মানবতার বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধ করেছে তাদের ক্ষেত্রে বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের! নিজামী-মুজাহিদরা তাহলে তাঁদের বিচারে আমাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে উঁচুস্তরের অসাধারণ মানুষ।
না, নিজামীরা ভাগ্যবান বটে। এ দেশের বিরোধিতা করে, এ দেশের মানুষের প্রতি নৃশংসতা দেখিয়ে তার পরও এ দেশের কিছু মানুষের কাছে তারা অসাধারণ মানুষ। তার পরও তাদের প্রতি মানবতা দেখাতে আমরা কী মরিয়া!
২.
মানবতার কথাটা বেশি করে আসছে গোলাম আযমের বেলায়। যে মানুষটার নাম উচ্চারিত হলে অভিধান থেকে 'মানবতা' শব্দটি পালানোর পথ খুঁজে বেড়ায়, সেই মানুষটি কি মানবতার বিবেচনা পাওয়ার দাবিদার? আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটররা পর্যন্ত মনে করছেন, দাবিদার নন। অথচ তিনিই সেই মানবতা ভোগ করে পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে মোটামুটি ভিআইপি মর্যাদায় আছেন। খাচ্ছেন, দাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন। আবার খাবারের যে বাহারি তালিকা বের হয়েছে তা দেখে জীবনসংগ্রামে পর্যুদস্ত কোনো মুক্তিযোদ্ধার যদি মনে হয় 'ভুলই করেছিলাম বোধ হয়' তাহলে তাঁকে খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে না।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে এক অদ্ভুত ঐক্যের ফর্মুলা চালু হয়েছিল। সেই ঐক্যের প্ল্যাটফর্মটা এ রকম যে সেখানে চোর-ডাকাত-ফেরেশতা সবাই সমান। সংগ্রামী রাজনীতি আর সুবিধাবাদিতায় কোনো ভেদাভেদ নেই। তাই খুনিরাও এখানে পুনর্বাসিত হয়ে গেল, ঘৃণার ডাস্টবিন থেকে উঠে এসে রাজনীতিতে জায়গা করে নিল স্বাধীনতাবিরোধীরাও। শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন, আবদুল আলীম-সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা মন্ত্রী, নিজামী-আব্বাস আলী খানরা রাজনৈতিক নেতা। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগরা যখন এভাবে মূলস্রোতে ঢুকে গিয়ে তাদের পুরনো দিনের কথা প্রায় ভুলিয়ে দিচ্ছে, তখনই একদিন ঘটল একটা ঘটনা। বায়তুল মোকাররমে গোলাম আযম জুতাপেটার শিকার। প্রকাশ্য দিবালোকে। এরপর জুতাপেটা হতে পারেন এমন জায়গা তিনি এড়িয়ে চললেন সাবধানে কিন্তু এটা জানা গেল, বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনিই সবচেয়ে ঘৃণ্য। 'রাজাকারদের বিচার চাই' বলে আশির দশকে মাঝেমধ্যে যেসব দেয়াল লিখন হতো, তাতে ছবি থাকত মূলত একজনেরই, গোলাম আযম। টুপিতে পাকিস্তানের পতাকা অঙ্কিত গোলাম আযমের ছবি দেখে বড় হয়নি এমন মানুষও পাওয়া যাবে না বাংলাদেশে। এর মানে গোলাম আযম বাংলাদেশের বিরোধিতার, যুদ্ধাপরাধের নৃশংসতার প্রতীক। সেই মানুষটির যখন সর্বোচ্চ শাস্তি হয় না তখন সেটা আবেগকে অবশ্যই আক্রান্ত করে। হরতাল দিয়ে বা রায় প্রত্যাখ্যান করে সেই আবেগ প্রকাশ যৌক্তিক কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে, যখন আপিলের সুযোগ আছে তবু গোলাম আযম সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিদার। কাজেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ হবেই। কিন্তু আশ্চর্য আওয়ামী লীগ সঙ্গে সঙ্গেই খুশি। আর তাতে করেই সন্দেহের নানান উঁকিঝুঁকি। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যেমন তেমনি নিচের দিকের অনেককেও দেখছি তারাও সন্তুষ্ট। কারণ, তাদের মনে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে ভোটের বাজারে যেমন সুবিধা হবে বলে তারা মনে করেছিল, সিটি নির্বাচনের ফল সে কথা বলছে না। তাদের একটা অংশের ধারণাটা এ রকম, আওয়ামী লীগের শরিক বামপন্থী কিংবা দলের ভেতরের সেই অংশ এ বিষয়ে চাপ দিচ্ছে খুব। কিন্তু বিচারে ফাঁসির মতো দণ্ড হলে জামায়াতের পক্ষ থেকে যে কঠিন প্রতিক্রিয়া হয় সেটা মাঠে নেমে সামাল দিতে হয় আওয়ামী লীগকেই। তখন আর সেভাবে জোটসঙ্গীদের পাওয়া যায় না, তাদের সেই শক্তিও নেই। তাই আহত-নিহত হতে হয় আওয়ামী লীগের কর্মীদেরই। সেই ঝামেলা তারা মোকাবিলায় তৈরি ছিল, কিন্তু ভোটের ফল দেখে মনে হচ্ছে, এতে করে দুই দিকেই ক্ষতি হচ্ছে। একদিকে সহিংসতার শিকার হওয়া, অন্যদিকে ভোট কমা। কাজেই একটু মধ্যপন্থী পথে হাঁটাই ভালো। সে জন্যই কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়াতে যখন আওয়ামী লীগ সরকারে থেকেও ক্ষুব্ধ হয়, গণজাগরণ মঞ্চকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, তখন গোলাম আযমের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ খুশি হয়ে লাফালাফি শুরু করে। দেখতে দেখতে সন্দেহ হয়, তাহলে কি আওয়ামী লীগ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল! ভোটে হারলে তখন নিজেদের সব কাজকেই যেমন ভুল মনে হয় আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে সিটি নির্বাচনটা সে রকম কুপ্রভাব ফেলেনি তো! আওয়ামী লীগকে কিন্তু বুঝতে হবে তারা বাঘের পিঠে উঠে যখন বসেছে তখন আর নামার সুযোগ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে যদি উদারতা কিছু দেখায়ও তাতে কি ওই পক্ষের একটা ভোটও তারা পাবে? পাবে না। বরং নিজেদের পক্ষের ভোট কমতে থাকবে। হ্যাঁ, এই পক্ষের মানুষের বিকল্প নেই, কিন্তু তারা হয়তো সে ক্ষেত্রে ভোটই দিতে যাবে না। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে যা ঘটে সাধারণত। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা তাদের ভোট দেয়, কিন্তু সরকারে যাওয়ার পর প্রত্যাশামতো প্রাপ্তি না হওয়াতে তখন আর ভোট দিতে খুব আগ্রহ দেখায় না। সিটি নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের বড় একটা অংশ এ কারণে ভোটই দিতে যায়নি বলে খবর। আর যদি এটা করে ভোটে হেরেও যায়, তবু মাথা উঁচু করে বলার সুযোগ থাকবে। আর পুরস্কার! এখন না পেলেও কোনো না কোনো সময় পাবে। ব্যাপকভাবে পাবে। রাজনীতি এক দিন বা এক মুহূর্তের অঙ্ক নয়। চলতে থাকা চিরকালীন সমীকরণ। ৪২ বছর পরও তো আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের অবদানের পুরস্কার পেয়ে চলছে। বিরোধীরা যত কথাই বলুক, আওয়ামী লীগ একসময় অসম্ভব মনে হওয়া কাজটি শুরু করেছে, এই কৃতিত্ব তো তাদের কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। এখানে দ্বিধা তাই ভোট কমাবে। দৃঢ়তা ভোট ঠিক রাখবে।
৩.
আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিপন্থী দুজন বন্ধু একটা ধারাবাহিক তর্কে অংশ নিচ্ছেন। শুরুটা ২০০৮ নির্বাচনের ঠিক আগে।
আওয়ামীপন্থী বন্ধু : আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গ আছে। ক্ষমতায় গেলে এদের বিচার হবে। দেশ কলঙ্কমুক্ত হবে।
বিএনপিপন্থী বন্ধু : কিসের বিচার! সব ভোট নেওয়ার জন্য ভাঁওতাবাজি। এদের বিচার বাংলাদেশে সম্ভবই না!
দেড়-দুই বছর পর যখন বিচার শুরু হয়ে গেছে তখন আবার তর্কে মুখোমুখি।
আওয়ামী বন্ধু : বিচার তো শুরু হয়ে গেল!
বিএনপি বন্ধু : শুরু হয়েছে কিন্তু শেষ হবে না। ঝুলিয়ে রাখবে। রায় হবে না।
কিছুদিন আগে আবার বিতর্ক।
আওয়ামী বন্ধু : রায় তো হয়ে গেল। ফাঁসিও হয়ে গেছে কয়েকজনের।
বিএনপি বন্ধু : রায় হয়েছে কিন্তু কার্যকর হবে না। ঝুলিয়ে রাখা হবে। সব রাজনীতি।
আওয়ামী বন্ধু : যদি কার্যকর হয়ে যায়!
বিএনপি বন্ধু : (খানিকটা চিন্তিত) দেখা যাক। হলে তো ভালো কিন্তু অত সহজ নয়।
ঠিক এমন তর্ক আমরা প্রায় সবাই কমবেশি শুনি। কিন্তু স্বাধীন দেশে তর্কটা তো এমন হওয়ার কথা নয়। হওয়া উচিত এ রকম,
সরকার পক্ষ : আমরা বিচার করে ফেলেছি। শাস্তিও নিশ্চিত হয়ে গেছে।
বিরোধী পক্ষ : আমরা এলে সঙ্গে সঙ্গেই শাস্তি কার্যকর করে ফেলব। তোমরা সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারোনি। আমরা এসে সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করব।
সরকার পক্ষ ভোটের সময় বলবে, আমরা ওদের বিচার করেছি। শাস্তিও দিয়েছি।
বিরোধী দল বলবে, ওরা বিচার করেছে। এখন আমাদের সুযোগ দিন সেগুলো কার্যকর করার। একটা দল সব সুযোগ পাবে, এমন তো হওয়া উচিত না।
মানুষ বিপদে পড়ে যাবে। কাকে রেখে কাকে বাছবে। আবার আনন্দিতও হবে। সবাই যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায়।
এ অবশ্য স্বপ্নের দৃশ্য। সেই দৃশ্যে সবাই যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি চায়। আর বাস্তব দৃশ্যে যুদ্ধাপরাধীরা ঠিকই এর-ওর আঁচল ধরে পথ পেয়ে যায়। তাই শাস্তির দিনেও সবাই খুশি হতে পারি না।
৪২ বছর বয়সী স্বাধীন দেশের জন্য এ বড় লজ্জার কথা। বড় লজ্জার!

No comments

Powered by Blogger.