কালের আয়নায়-এই রায় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

মানুষ মহাশত্রুরও মৃত্যু কামনা করে না। কিন্তু একাত্তরের ঘাতকদের নেতা গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ না হওয়ায় হতাশায় মুহ্যমান হয়েছি_ এ কথা বলতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করছি না।
তার ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশের কথা শুনে মনে মনে হেসেছি। সৌভাগ্যবান পুরুষ বটে গোলাম আযম। দীর্ঘ ৯১ বছর ধরে বেঁচে আছেন। আরও ৯০ বছর বাঁচবেন, তার কোনো সম্ভাবনা নেই। বড়জোর আরও পাঁচ-দশ বছর। এই কয়েক বছরও তিনি জেলে অথবা হাসপাতালে থাকলে বার্ধক্য এবং বার্ধক্যজনিত নানা অসুখের অজুহাতে ফাইভ স্টার হোটেলের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকবেন। সেই সুযোগ-সুবিধা তিনি এখনই পাচ্ছেন। স্বগৃহের পরিচর্যার চেয়েও এই সরকারি পরিচর্যা হবে উত্তম।
সুতরাং ঘরে বাস করার চেয়ে সরকারের মেহমান হয়ে বাস করার আনন্দই আলাদা। এখনও তাকে ঘরের খাবার খেতে দেওয়া হচ্ছে, নিকট পরিজনদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হচ্ছে। কারাদণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার পরও এসব দেওয়া হবে। সুতরাং গোলাম আযম একাত্তরের শিশুঘাতী, নারীঘাতী বর্বরতার জন্য তো শাস্তি পেলেনই না, বরং পুরস্কৃত হলেন। এমন সৌভাগ্যবান মানবতার শত্রু পৃথিবীতে ক'জন আছেন?
ভারতে রাজত্ব করাকালে ব্রিটিশ শাসকরা মহাত্মা গান্ধীকে গ্রেফতার করত। কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মতো সাধারণ জেলে পাঠাত না। তাকে দিলি্লর আগা খাঁ প্রাসাদে বন্দি রাখা হতো। সেখানে তার জন্য দুগ্ধবতী ছাগল পালন, ছাগলের পরিচর্যাকারী নিয়োগ, মহাত্মাজির প্রিয় খাবার তৈরি করা, তার উপাসনা ও চরকা কাটার ব্যবস্থা ইত্যাদি সব রাখা হতো।
একবার নাকি ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে প্রশ্ন উঠেছিল, মহাত্মা গান্ধীকে জেলে রাখতে সরকারকে কত টাকা ব্যয় করতে হয়। টাকার অঙ্ক শুনে এক পার্লামেন্ট সদস্যের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। তিনি নাকি বলেছিলেন, এমন ব্যবস্থা হলে আমি সারাজীবন জেলে থাকতে রাজি আছি। এই খরচের কাছে তো ফাইভ স্টার হোটেলে মাসের পর মাস থাকার খরচও তুচ্ছ।
সুতরাং বলা চলে, বাংলাদেশের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান পুরুষ জামায়াত নেতা গোলাম আযম। রাম ছাড়া রামায়ণ লেখা যায় না। কিন্তু গোলাম আযম ছাড়া একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়ে গেল অথবা হবে। এটাকে কি এখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তিদানের জন্য গত তিন দশক ধরে যে উত্তাল গণআন্দোলন, লাখো শহীদ পরিবারের আকুল আকুতি তার সফল পরিণতি বলা চলবে? না, ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা বলবেন, এটা ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক চাতুর্য! ডাকাত সর্দারকে সর্বোচ্চ সাজা না দিয়ে তার সহচরদের সেই সাজাদান। এই বিচারের নাম হওয়া উচিত ছিল, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের নায়কের সহচরদের বিচার।
গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় গোটা যুদ্ধাপরাধী বিচারেরই চরিত্র এবং চেহারা পাল্টে গেছে। আপাতত এই রায়ের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ থামানো গেলেও এই রায়ের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে সুদূরপ্রসারী। এই প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শিবিরে হতাশা ও পরাজিতের মনোভাব বাড়াবে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলবে। একটি মানুষের ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধের কথা, লাখো মুক্তিযোদ্ধার আত্মাহুতির কথা, তাদের স্বজনের আর্ত আহাজারির কথা ভুলে গিয়ে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার রাজনীতির জন্য যে কাজটি করলেন, তাতে ভবিষ্যতে একদিন তাদেরও ইতিহাসের আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, তিনি গোলাম আযমের বিচারের রায়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন। ফলে তার মন্ত্রী ও অমাত্যরাও কোরাসে বলবেন, আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি, তা আর বিচিত্র কী? আমি সবিনয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানাচ্ছি, আমি এই রায়ে সন্তুষ্ট হইনি। সন্তুষ্ট হয়নি দেশের লাখো কোটি মানুষ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের একজনও। যদি এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সব আসামিকে দীর্ঘমেয়াদি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে গোলাম আযমকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হতো, তাহলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার_ এই কথাটি সার্থক হতো। গোলাম আযমের রায়ের পর 'একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার' এই কথাটি এখন আর কোনো অর্থ বহন করে না। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের নির্দেশদাতার লঘু শাস্তি হবে এবং নির্দেশ পালনকারীরা পাবে গুরু শাস্তি_ এটা কি বিচার?
আওয়ামী লীগের কিছু বন্ধু আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, গোলাম আযমকে সর্বোচ্চ শাস্তি না দেওয়ার পেছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করেছে। একটি, তার অতি বৃদ্ধ বয়স। অন্যটি হলো, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ কর্তৃক গোলাম আযমকে সর্বোচ্চ শাস্তিদান না করার জন্য চাপ প্রয়োগ। সৌদি আরব সেখানে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে ফেরত পাঠানোরও হুমকি দিয়েছিল। এক আওয়ামী মন্ত্রী আরও একটু এগিয়ে বলেছেন, গোলাম আযমকে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আমরা একটু নমনীয় হয়ে একটা কূটনৈতিক সাফল্যও অর্জন করেছি। সৌদি আরব উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি অবৈধ শ্রমিককে বৈধতাদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
এক শ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রীর এক ধরনের আত্মপ্রতারণামূলক কথা আমাকে বিস্মিত করেনি, বিরক্ত করেছে। প্রথম কথা, বয়স কি অপরাধ মার্জনার বিবেচনার বিষয় হয়? তাও আবার মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ? এ ব্যাপারে হেগের আন্তর্জাতিক আদালত কী বলে? নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় নুরেমবার্গ আদালত কী বলেছে? আইখম্যানকে কী করে বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো? একজন মানুষের সারা জীবনের অপরাধ কি কেবল বয়সের বিবেচনায় ঢাকা পড়ে যেতে পারে? গোলাম আযমকে তার প্রাপ্য সর্বোচ্চ শাস্তি না দেওয়ার অন্য কারণগুলো ঢাকা দেওয়ার জন্যই এই বার্ধক্যের অজুহাত কি তৈরি করা হয়নি!
এখন সৌদি আরবসহ কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টির অজুহাত। আমাকে কি বিশ্বাস করতে হবে, শেখ হাসিনার মতো যে সাহসী নেত্রী ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশ্নে মহাশক্তিধর আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের চাপ ও হুমকির কাছে মাথানত করেননি; পদ্মা সেতুর মতো বিরাট জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে একজন মাত্র মন্ত্রীকে সরানোর জন্য বিশ্বব্যাংক যে চাপ সৃষ্টি করেছিল, তার কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে 'বাপের বেটি'র সাহস ও মর্যাদাবোধ দেখাতে পারেন, তিনি দু'তিনটি মুসলিম দেশের চাপের কাছে সহসাই নতজানু হয়েছেন? এটা কি বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো যুক্তি নয়?
আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশ যাতে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে তার জন্য জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক দু'তিনটি মুসলিম দেশের, বিশেষ করে সৌদি আরবের চাপ ছিল হাসিনা সরকারের ওপর। সরকার সেই চাপ সাহসের সঙ্গে অগ্রাহ্য করেছে। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিই বলেছেন, তাদের কূটনীতি সফল। '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সৌদি আরবের আপত্তি নেই। এখন প্রশ্ন, আগে যেখানে চাপটা ছিল একেবারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার, কখন সেটা পাল্টে গিয়ে কেবল গোলাম আযমের প্রাণরক্ষার চাপে পরিণত হলো তা দেশের মানুষ জানে কি?
যদি সত্যই সৌদি আরবসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ গোলাম আযমের প্রাণরক্ষার জন্য বাংলাদেশের ওপর গুরুতর চাপ সৃষ্টি করে থাকে এবং বাংলাদেশ সরকার বিদেশে, বিশেষ করে সৌদি আরবে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের জীবিকা রক্ষার জন্য এই চাপের কাছে নমনীয় হয়ে কোনো ডিল করে থাকে, তাহলে এই ডিলটা কি অন্যভাবে হতে পারত না? একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানের জামায়াত নেতা মওলানা আবুল আলা মওদুদী পাঞ্জাবে কাদিয়ানিবিরোধী দাঙ্গা বাধিয়ে ৫০ হাজার মুসলমান নর-নারীর মৃত্যুর কারণ ঘটান। দাঙ্গা ও গণহত্যায় উস্কানিদানের অভিযোগে লাহোর হাইকোর্টে তার বিচার হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। যথারীতি জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরব এই মৃত্যুদণ্ড রদ করার জন্য পাকিস্তানের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্ট করে। তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে মওদুদীবিরোধী জনমত এত তীব্র ছিল যে, কোনো পার্লামেন্টারি সরকার এই সৌদি চাপের কাছে মাথানত করতে সাহসী হয়নি।
এরপর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতায় আসেন, সৌদি আরব আইয়ুব সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। আইয়ুব সরকার মওদুদীকে প্রাণভিক্ষা দেয়। মওদুদীকে এই প্রাণভিক্ষা দানের নেপথ্যের খেলা সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে করাচির একটি ইংরেজি দৈনিকে একটি খবর প্রকাশ করা হয়েছিল। সরকারি তরফে এই খবরের কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি।
খবরটি ছিল, সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের আইয়ুব সরকার একটা ডিল করেছিল। দেশের জনমতকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য মওলানা মওদুদীর প্রাণদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হবে। মওলানা মওদুদী প্রাণভিক্ষা চেয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে মার্সিপিটিশন করবেন। প্রেসিডেন্ট তা বিশেষ ক্ষমতাবলে মঞ্জুর করবেন। এভাবে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের পাকিস্তানি নেতা, আরেক হত্যাযজ্ঞের নায়ক মওলানা মওদুদী ফাঁসিতে ঝোলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বিচারে যদি গোলাম আযমের ব্যাপারে মওদুদীর বিচারের অনুসরণ করা হতো, তাহলে ব্যাপারটা নৈতিকতার দিক থেকে প্রশ্নবোধক হলেও দেশের মানুষ এই ভেবে সান্ত্বনা পেত যে, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধের জন্য দায়ী সাব্যস্ত এই লোকটির অন্তত সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হয়েছে। তারপর কোনো কারণে যদি তার প্রাণ রক্ষা পায় তা অন্য কথা।
গোলাম আযমের বিচারের এই একটি রায় দেশের রাজনীতিতে ধীরে হলেও যে বহমান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তা হবে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অশুভ। একটি মাত্র রায় অর্থাৎ একাত্তরের বর্বরতার পালের গোদার বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরাজয়ের সব হতাশা ও বেদনা মুছে দিয়ে আওয়ামী লীগসহ দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরে আবার আশা ও উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনত। মহাজোটের ঐক্য আবার সুদৃঢ় হতে পারত। সেটি হতে পারল না।
গোলাম আযমের অনুসারী ও সহচর যেসব যুদ্ধাপরাধী মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে, তারাও এই ভেবে এখন সান্ত্বনা পেতে পারে যে, তাদের নির্দেশদাতা ও নেতা যখন সর্বোচ্চ শাস্তি এড়াতে পেরেছে, তখন তারাও আপিলে বা অন্যভাবে শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ শাস্তি এড়াতে পারবে। আর আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মতিভ্রমের জন্য যদি বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসে, তাহলে তো কথাই নেই। বিচার, ট্রাইব্যুনাল তখন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। এই কথাটি আওয়ামী লীগের জন্যও সত্য। এই ঘন এবং গভীর অন্ধকারে একটি মাত্র আশা, যদি হতাশামুক্ত হয়ে গণশক্তি জেগে ওঠে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের মতো যদি আবার তা গর্জে ওঠে।
লন্ডন, ১৯ জুলাই শুক্রবার, ২০১৩

No comments

Powered by Blogger.