সংঘাতের রাজনীতি আর নয়- দুই দল দেশেই আলোচনায় বসুক

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা রাজপথে সহিংসতার পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
বৃহস্পতিবার তাদের এ ধরনের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে লন্ডনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে এক সেমিনারে। ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডসের একটি কক্ষে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারের আয়োজক ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ানরা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পেঁৗছেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত দেশব্যাপী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন হরতাল ডেকেছে অন্তত ১৭ দিন। জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে তাদের ডাকে আরও হরতাল হয়েছে অন্তত ৩৭টি। এর বাইরেও বিএনপি হরতাল ডেকেছে। গণজাগরণ মঞ্চও হরতাল ডেকেছে। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের প্রতিটি হরতাল কর্মসূচিই কমবেশি সহিংস। হরতালে নিহতের সংখ্যা একশ'য়ের কাছাকাছি। আহত শত শত। নিরীহ নারী-পুরুষ এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণ যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি হরতাল-অবরোধে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে নিয়মিত অগি্নসংযোগ করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি যানবাহনে। হামলার শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবার ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে অপূরণীয়। এ থেকে নিকট ভবিষ্যতে মুক্তি মিলবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের ১৮ দলীয় মিত্ররা মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটিই রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতার প্রধান কারণ। পাশাপাশি একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির সহিংসতা ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে, সরকার পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে রাজি নয়। তাদের আরও অভিমত, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই বিএনপি ও জামায়াত তৎপর। লন্ডনের যে বৈঠকে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দুই পক্ষের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তাহলে সমাধান সূত্র আসবে কীভাবে? রাজপথে রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তির প্রবণতা বাংলাদেশে নতুন নয়। এ জন্য সংঘাত-হানাহানি দশকের পর দশক ধরেই চলছে। এতে অর্থনীতির ক্ষতি হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন গুরুতর বিঘি্নত হয়। রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য সামাজিক শক্তি, কেউই তা অস্বীকার করে না। তাদের আলোচনায় বসতেই হবে। এটা কেবল ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ানদের নয়, দেশের আপামর জনগণেরও প্রত্যাশা। দেশের সমস্যা সমাধানের উপায় অনুসন্ধানের জন্য প্রধান দুই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা লন্ডনে আলোচনায় বসতে পারলে দেশের অভ্যন্তরে অনুরূপ আলোচনায় বসতে আপত্তি থাকার কথা নয়। লন্ডনে তারা কোনো গোপন বৈঠক করেননি। গত ডিসেম্বরেও অনুরূপ একটি সেমিনার সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশবাসী আশা করবে, হাউস অব লর্ডসের মতো বাংলাদেশ জাতীয় সংসদেও দ্রুত অনুরূপ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ আলোচনা সংসদ অধিবেশনের সময়ে হতে পারে, সংসদ ভবনে সংসদ নেত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার অফিসেও হতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা উদ্ভাবন। বিএনপি সংসদে ফিরে আসা ইতিবাচক। এর সুযোগ নিতেই হবে এবং তার সূচনা করায় বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে ক্ষমতাসীনদের। বিএনপিকেও বুঝতে হবে, দাবি আদায়ে সহিংস রাজনৈতিক কৌশলে সরকারকে খুব একটা কাবু করা যায় না। তারা রাজপথের আন্দোলনে যতটা লাভবান হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি লাভ এনে দিয়েছে সিটি করপোরেশনগুলোর শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ।
লন্ডনের সেমিনারে বাংলাদেশে দুর্নীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিস্তার, সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা ইত্যাদি যেসব সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে, আমাদের রাজনীতিকরা তার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি রাখবেন, আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.