সমাপনী পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ by মোঃ সিদ্দিকুর রহমান

শিক্ষা শিশুর জন্মগত অধিকার। শিশুর অধিকার অর্জনের পথ মসৃণ ও কণ্টকমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিশু যাতে তার অধিকার, আনন্দঘন পরিবেশ গ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা পারিবারিক পরিবেশে শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এ নির্যাতন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। বর্তমান সরকার শিক্ষাকে শিশুর কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে বিদ্যালয় পর্যায়ে খেলাধুলা, নাচ, গান প্রতিযোগিতা তথা সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। বছরের শুরুতে রঙিন আকর্ষণীয় ছবি সহকারে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে। শিশুদের জন্য মজার গল্প, মিনাকার্টুন বই সরবরাহ করছে। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা একই মানের করার লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা চালু করেছে। এতে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশুর ওপর অমানবিক বইয়ের বোঝা হ্রাস পেয়েছে। ফলে অধিকাংশ অভিভাবকের মনে ধারণা জš§াতে শুরু করেছে, জ্ঞান অর্জনের জন্য অপ্রয়োজনীয় বইয়ের বোঝার দরকার নেই।
এ অবস্থায় আবারও শিশুকে বাধ্য করা হচ্ছে নোট-গাইডের বোঝা বহন করতে। বর্তমানে ইউআরসি সাবক্লাস্টারসহ পাঠদান সংক্রান্ত বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে তেমন কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। শিক্ষকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নোট-গাইড বা জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে সমাপনী পরীক্ষার পরিবর্তিত মানবণ্টন, প্রশ্নের নমুনা সম্পর্কে জানেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের অনেক ক্ষেত্রে বছরের ৬ মাস গড়িয়ে যায়। ২০১২ ও ২০১৩ সালের জন্য শিক্ষকদের কাছে পরিবর্তিত মানবণ্টন সংক্রান্ত কোনো কপি আদৌ পৌঁছেনি, যা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নোটবইয়ের বদৌলতে পেয়েছেন। এক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হলেও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় নোট-গাইড কৌশলে বিক্রির প্রমাণ মিলেছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশ-প্রজ্ঞাপন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে যায়। অথচ শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ সমাপনী পরীক্ষার তথ্য পাঠানো হয় না। জানতে চাওয়া হলে জবাব আসে ইন্টারনেটে পাবেন, এখনও হয়নি। ভাবখানা এমন, সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ইন্টারনেটের আওতাভুক্ত।
শিশুদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষকদের ডিসেম্বরের আগে ধারণা দেয়া প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তক অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রশ্ন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়ে থাকেন। অথচ ২০১৩ সালে নতুন পাঠ্যপুস্তকের মানবণ্টনের নমুনা প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা দেয়ার পরিবর্তে দেয়া হয়েছে পুরনো ধ্যান-ধারণা। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করত অনেকটা ঈদের খুশির আমেজ। তাদের মনে পরীক্ষা ভীতি বলে তেমন কিছু ছিল না। বেশির ভাগ স্কুলে শতভাগ পাস এবং এ অথবা এ প্লাসের ছড়াছড়ি। এতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যে বিভিন্ন স্কুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তথা বিদ্যালয়ের অধিকতর সুনাম অর্জনের মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। মে ২০১৩-তে বাজারের গাইডবইয়ে সমাপনী পরীক্ষার নমুনা প্রশ্ন দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষকরা মিলিয়ে দেখে তা হুবহু এক, যা বিলম্বে হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর দরকার ছিল। যার ফলে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরনো ধারণা মোতাবেক পরীক্ষা নিতে বাধ্য হয়। নতুন মানবণ্টন নমুনা প্রশ্ন আগের বছরের তুলনায় ব্যাপক। অথচ শিক্ষার্থীদের ওই সময়ে উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।
আড়াই ঘণ্টা সময় হলে শিক্ষার্থীরা অনায়াসে লিখতে পারবে। অপরদিকে শিশু শিক্ষার্থীদের ২ ঘণ্টার বেশি সময়ে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা হলে জীবনের প্রথম পরীক্ষা হবে ক্লান্তি ও বিষাদময়। তাই পরীক্ষা তাদের মনে বিতৃষ্ণা জš§াবে। ২০১৩ সালের বাংলা ও ইংরেজি প্রশ্নপত্রে পাঠ্যবইবহির্ভূত অনুচ্ছেদ থাকবে। জীবনের শুরুতে পাবলিক পরীক্ষায় পাঠ্যবইবহির্ভূত অনুচ্ছেদ থেকে ২৫ নম্বরের প্রশ্ন থাকলে শিশুর মনে অজানা প্রশ্ন সম্পর্কে পরীক্ষার আগে ভীতি-উৎকণ্ঠা জš§াবে। প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে লিখতে পারবে কি-না এ নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা থাকবে। শতকরা ৯০ ভাগ শিশুর জন্যই উত্তর দেয়া দুরূহ হবে। বাংলায় ১৩ নম্বর প্রশ্নে এলোমেলো কবিতার লাইনগুলো পর পর সাজিয়ে লেখা প্রশ্নের উত্তর যথার্থভাবে দিতে হলে শিশুকে বড় বড় কবিতা মুখস্থ করতে হবে।
কম মেধাসম্পন্ন শিশুর জন্য বড় কবিতা মুখস্থ করা কঠিন। ১৫ নম্বর ফরম পূরণ প্রশ্ন পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের স্ববিরোধী। যেখানে পরীক্ষার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কোড নম্বর ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বিস্তারিত তথ্য লিখে খাতার টপশিটে কোড নম্বর দেয়ার প্রয়োজন নেই। ইংরেজি ৭ নম্বর প্রশ্নে জবধৎৎধহমব করে গল্প লেখার জন্য পুরো অধ্যায় ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। বাংলা কবিতার মতো কোন বাক্যের পর কোন বাক্য লিখতে হবে এবং ঘড়ঁহ, চৎড়হড়ঁহ সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এখানে পুরো গল্প বা অধ্যায় অনেকটা মুখস্থ করার মতো আয়ত্ত করা শিশুর কাছে অনেকটা যন্ত্রণাদায়ক। গণিত বিষয়ে প্রশ্নের মানবণ্টন ও নমুনা প্রশ্নের জন্য ২ ঘণ্টা সময় যথেষ্ট। আমার পর্যবেক্ষণে প্রশ্নের মানবণ্টনে তেমন কোনো সমস্যা পরিলক্ষিত হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে উদাহরণের প্রদত্ত অংকগুলো অনুশীলনীর সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয়ে বিগত পরীক্ষাগুলোয় ৫টি রচনামূলক ও ভুল/শুদ্ধ নির্ণয় কর প্রশ্ন ছিল। ২০১৩ সালে ৫টির পরিবর্তে ৮টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এবং ভুল/শুদ্ধ প্রশ্ন নেই। ৮টির মধ্যে ২টি যোগ্যতাভিত্তিক। যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দিতে শিক্ষার্থীকে চিন্তাভাবনা করে লিখতে হয়। তাতে বেশি সময় লাগে। এতে সব প্রশ্নের উত্তর কমপক্ষে আড়াই ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন।
এবার প্রশ্নপত্র বহির্ভূত সমস্যা নিয়ে আলোকপাত করছি। প্রতিবছর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সমাপনী পরীক্ষার কাজের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসগুলোতে ডেপুটেশনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে নিয়োজিত করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক পাঠদান ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। ৫০০-১৫০০ শিক্ষার্থীর জন্য প্রতি কেন্দ্রে একই বরাদ্দ দেয়া হয়। এ বরাদ্দ ও ২ জন এমএলএসএস নিয়োগ অপ্রতুল। কোড নম্বর বসানোর জন্য নিয়োজিত শিক্ষকদের সম্মানী সর্বমোট ৫০০ টাকা, যা দিয়ে যাতায়াতের ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়। সারাদেশের সাধারণ মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার স্লোগানকে বাস্তবায়িত করতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষার ফিসের নামে টাকা নেয়া স্ববিরোধী অথচ বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষার ফিসের নামে ৩ বার টাকা আদায় করা হয়। বিগত বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমাপনী পরীক্ষার ফি ছিল ৪০ টাকা অথচ এ বছরে করা হয়েছে ৬০ টাকা। এটি অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের পরপন্থী।
এসবদ্ধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য কতিপয় প্রস্তাব পেশ করছি : * প্রশ্নের মানবণ্টন, নমুনা প্রশ্নসহ পরীক্ষা-সংক্রান্ত সব বিষয় ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা। * পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনীতে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নের ধারণা দেয়া। * পরীক্ষার সময়সূচি ২ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে বাংলা ও ইংরেজিতে পাঠ্যবই বহির্ভূত অনুচ্ছেন বাদ দেয়া। * কবিতার লাইনগুলো সাজিয়ে লেখার পরিবর্তে আগের মতো কবির নামসহ ১০ লাইন লেখা। * বাংলা প্রশ্নে ফরম পূরণ পরীক্ষার গোপনীয়তার স্বার্থে বাদ দেয়া। * ইংরেজি ৭ নম্বর জবধৎৎধহমব করে গল্প লেখা প্রশ্ন না রাখা। * বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ধর্মবিষয়ক রচনামূলক প্রশ্ন ৮টির পরিবর্তে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নসহ সর্বমোট ৫টি করা। * ভুল/শুদ্ধ নির্ণয় করা ও মিলিয়ে লেখা সংযুক্ত করা। * গণিত বইয়ে উদাহরণের আলোকে সমস্যা সমাধানে পর্যাপ্ত অংক রাখা। * শিক্ষকদের পরীক্ষা-সংক্রান্ত দাফতরিক কাজে নিয়োগ না করে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড বা এ কাজে অস্থায়ীভাবে লোক নিয়োগ করা। * পরীক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষার্থী অনুযায়ী বরাদ্দ ও পর্যাপ্ত এমএলএসএস নিয়োগ করা। * কোড নম্বর বসানোর দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষদের সন্তোষজনক সম্মানী প্রদান করা। * প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্যবইয়ের মতো পরীক্ষা-সংক্রান্ত ফি প্রথা বাতিল করে সরকারিভাবে প্রশ্ন ও কাগজসহ সমুদয় খরচের ব্যবস্থা করা। * শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া অতিরিক্ত ২০ টাকা শিগগির ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করা। এসব পরামর্শের আলোকে সমাপনী পরীক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো দূর করা সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করছি।
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান : প্রাথমিক শিক্ষাবিষয়ক গবেষক; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি

No comments

Powered by Blogger.