আজ বিদায় নিচ্ছে 'বিতর্ক' কমিশন-অর্ধকোটি টাকা খরচে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের সুপারিশমালা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না সন্দেহ by আবুল কাশেম

বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি শেষ 'বিতর্কিত' গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের। আজই এর শেষ দফায় বর্ধিত কর্মমেয়াদের অন্তিম দিন। ২০১২ সালের ১৬ জুন গঠিত হওয়ার পর দফায় দফায় সময় নিয়ে ওই কমিশন সরকারের কাছে দেওয়া
তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯ টুকরা করার সুপারিশ জমা দিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সংস্থাটির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদায় নেওয়ার জন্য সব কিছু গোছগাছ করে রেখেছেন। আজ শেষ দিনের মতো অফিস করে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুরনো অফিসে ফিরবেন তাঁরা।
গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে নরওয়ের টেলিনরের মালিকানাধীন মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের লাইসেন্স স্থগিত করার সুপারিশ করা হয়। গ্রামীণ সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত পরিচালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়ার কথাও বলা হয় কমিশনের সুপারিশে। এ দুটি বিষয় ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে ঘরে-বাইরে।
পরে একটি কর্মশালার জন্য তৈরি করা কার্যপত্রে গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯ বা এর বেশি টুকরা করার সুপারিশ করে চূড়ান্ত বিতর্কের জন্ম দেয় কমিশন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ওই প্রতিবেদনের কোনো সুপারিশই সরকার এখনো বাস্তবায়ন করেনি। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনোয়ার উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে গ্রামীণ ব্যাংক রিভিউ কমিটি গঠন করেছিল সরকার। ওই কমিটির কোনো সুপারিশও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এরপর তিন মাসের জন্য গঠন করা গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন ১৫ মাস সময় নিয়ে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেই সুপারিশ আদৌ বাস্তবায়ন করা যাবে কি না এবং এর জন্য পর্যাপ্ত সময় সরকার পাবে কি না, তা নিয়েও নানা আলোচনা আছে। কারণ কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে এরই মধ্যে দেশে-বিদেশে প্রবল বিরোধিতা হয়েছে। পাশাপাশি ২৫ অক্টোবর সরকার পদত্যাগ করলে অর্থমন্ত্রী খুব বেশি সময়ও হাতে পাচ্ছেন না। কিন্তু দেশে-বিদেশে বিরোধিতার মুখে ওই কমিশন গঠন ও প্রতিবেদন খাতে সরকারের অর্ধকোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে কমিশনের তিন সদস্যের বেতন-ভাতার পেছনেই গেছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা। গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯ টুকরা বা গ্রামীণফোনের লাইসেন্স স্থগিতের সুপারিশ সরকার গ্রহণ করেনি। বরং এর ফলে সরকার আরো বিব্রত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদেই বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংককে টুকরা করার কোনো উদ্দেশ্য সরকারের নেই। আর গ্রামীণফোনের লাইসেন্স স্থগিত করা নিয়ে নরওয়ে সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাপক দেনদরবার হয়েছে। এতে দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যদিও কমিশনের চেয়ারম্যান বিভিন্ন সময় বলেছেন, তিনি ব্যাংকটিকে ১৯ টুকরা করার কথা বলেননি, বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন।
কমিশনের জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কী আছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। কারণ চূড়ান্ত গোপনীয়তার সঙ্গে প্রতিবেদন জমা দিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান বিদেশে চলে গেছেন। আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও সে প্রতিবেদন হাতে নিয়ে বিদেশে অবস্থান করছেন।
জানা গেছে, গত ১০ জুলাই কমিশনের সদস্য ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মোসলেহউদ্দিন আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যান মামুন-উর রশীদ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দপ্তরে গিয়ে অর্থমন্ত্রীর হাতে প্রতিবেদনটি তুলে দেন। গত ১৭ জুলাই জাপান ও সিঙ্গাপুর সফরে যাওয়ার সময় মন্ত্রী প্রতিবেদনটি সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এর একটি অনুলিপি দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হকের কাছে। তিনিও ১৭ জুলাই দুই সপ্তাহের জন্য মালয়েশিয়া গেছেন। আর গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের চেয়ারম্যান যুক্তরাজ্যে আছেন বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ৪ জুলাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ২০ জুলাই পর্যন্ত কমিশনের মেয়াদ রয়েছে। কমিশন এ সময়সীমার মধ্যেই প্রতিবেদন দেবে এবং সে মোতাবেক ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
এদিকে সরকার ও কমিশনের তরফ থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী বিভিন্ন সংস্থার পরিচালন কাঠামো নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউই কিছু বলেননি। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কমিশন ও সরকার- দুই পক্ষই গোপনীয়তা রক্ষা করে চলছে।
গত বছর ১৬ জুন গঠিত কমিশনে প্রথমে পাঁচ সদস্যকে নিয়োগ দেয় সরকার। এর মধ্যে দুজন দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান। ফলে গঠিত হয় মূলত তিন সদস্যের কমিশন। এর প্রধান করা হয় সাবেক সচিব মো. মামুন-উর রশীদকে। হিসাব করে দেখা গেছে, এ সময় কমিশনের সদস্যদের বেতন বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা। এর অফিস, কমিশনের সদস্যদের গাড়ি ও টেলিফোন সুবিধা বাবদ প্রায় সমপরিমাণ টাকা চলে গেছে।
গত ২ মে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের সদস্যদের বেতন বাড়ানো হয়। ওই দিন সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বেতন ৬৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৪ হাজার টাকা করে। এর বাইরে কমিশনের সদস্যদের সহায়তার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রেষণে প্রায় ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে আসা হয়।
গত বৃহস্পতিবার গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের কর্মকর্তা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা সেলের উপপ্রধান রবিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, '২০ জুলাই (শনিবার) আমাদের শেষ অফিস। ফাইলপত্র সব গুছিয়ে ফেলেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় আছি।'
কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, '২০ জুলাইয়ের মধ্যেই প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা। সেটা জমা দেওয়া হয়েছে কি না, আমরা জানি না। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরাই সবকিছু করেন। আমরা কর্মকর্তারা শুধু তাঁদের দাপ্তরিক সহযোগিতা করেছি। আমরা প্রতিবেদন সম্পর্কে কখনো কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে কিছু জানতে চাইনি। তিনিও নিজে থেকেও কিছু বলেননি।'
চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে কি না- প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ২০ জুলাই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই এ মেয়াদের পর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।
২ জুলাই গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। ওই কর্মশালার কার্যপত্রে গ্রামীণ ব্যাংক ১৯ বা এর বেশি টুকরো করার সুপারিশ করা হয়। এর আগেই এ পরিকল্পনার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তখন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে এ ধরনের কর্মশালা আয়োজনের এখতিয়ার কমিশনের নেই বলে জানানো হয়। ফলে কর্মশালাটি স্থগিত হয়ে যায়।
২ জুলাই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গ্রামীণ ব্যাংক কমিশনের চেয়ারম্যান মামুন-উর রশীদ বলেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, বাংলাদেশ শিল্পব্যাংকের মতো কয়েকটি কাঠামোর সুপারিশ থাকবে। নতুন কাঠামোর ওপরই এর তদারকি সংস্থা ঠিক করা হবে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ব্যাংকের এমডি নিয়োগে কোনো সুপারিশ থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.