৫৪ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল আইন এখনই হচ্ছে না! by আশরাফুল হক রাজীব

আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার গ্রহণ করি তার অর্ধেকেরও বেশি খাবারে মেশানো আছে ভেজাল। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট দেড় যুগের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছে, ভেজাল ব্যবহার অব্যাহতভাবেই চলছে।
এর মধ্যে ২০১১ সালেও ৫৪ শতাংশ খাবারে পাওয়া যায় ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান। এসব খাবার খেয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। আগামী প্রজন্মকেও বুদ্ধিহীন, পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খাদ্য ভেজাল করতে বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মনোসোডিয়াম, ইথোফেন, ক্যালসিয়াম, কার্বাইড, ফরমালিন, চক পাউডার, ইউরিয়া, মার্জারিন, পশুর চর্বি, খনিজ তেল, রেড়ির গুঁড়া, ন্যাপথলিন, সুডান কালার, ইটের গুঁড়া, কাঠের গুঁড়া, ডিডিটি, রোডামিন সাইক্লোমেট। কলা, আম, পেঁপে, টমেটো, আনারস কৃত্রিম উপায়ে পাকানো হয়। এসব ফল দীর্ঘ সময় তাজা রাখতে ব্যবহার করা হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথোফেন। ফরমালিন মেশানো দুধ দিয়ে তৈরি হচ্ছে মজাদার মিষ্টি, যা গর্ভবতী মা ও শিশুদের জন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। চিনিতে চক পাউডার ও ইউরিয়া মেশানো হচ্ছে; দুধে ফরমালিন ও স্টার্চ; মাখন ও ঘিতে মার্জারিন ও পশুর চর্বি মেশানো হচ্ছে। সরিষার তেলে দেওয়া হচ্ছে রেড়ির তেল, মরিচের গুঁড়া ও খনিজ তেল। সয়াবিন তেলে মেশানো হচ্ছে পাম অয়েল, ন্যাপথলিন। শুকনা মরিচের গুঁড়ায় বিষাক্ত সুডান কালার। চকোলেটে মেশানো হচ্ছে স্যাকারিন ও মনোসোডিয়াম; জুসে কৃত্রিম রং এবং শুঁটকি মাছে মেশানো হচ্ছে ডিডিটি। সবুজ শাকসবজিতে কৃত্রিম রং দেওয়া হচ্ছে। কোমল পানীয়র সঙ্গে মেশানো হচ্ছে রোডামিন বি। মাছে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। খাবার সুস্বাদু করার জন্য সাইক্লোমেট ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সাইক্লোমেট মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এ জন্য ১৯৬৯ সালে খাবারে সাইক্লোমেট ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন মিষ্টি, তরল পানীয়, জুস, জেলি, জ্যাম, পুডিং, আইসক্রিমে মাত্রাতিরিক্ত স্যাকারিন ব্যবহার করা হয়। বেশি ব্যবহারে শরীরে নানা সমস্যা সৃষ্টি করে বলে স্যাকারিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে সতর্ক চিহ্ন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি ১০৭টি পণ্যের ৪০০ রকমের পরীক্ষা করে। ভেজাল পরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর গড়ে প্রায় আট হাজার নমুনা ব্যবহার করে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত বছর গবেষণাগারে পাঁচ হাজার ৩২২টি পণ্য পাঠানো হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ৫৮৮টিতে ভেজাল পাওয়া গেছে। ২০১১ সালে পাঁচ হাজার ৮১২টি পণ্যের মধ্যে ৫৪ শতাংশেই ভেজাল পাওয়া গেছে। ১৯৯৫ সাল থেকে পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ৪৮ থেকে ৫৪ শতাংশ খাদ্যেই ভেজাল রয়েছে। বর্তমান নির্বাচিত সরকারের সময় খাদ্যে বেশি ভেজাল মেশানো হয়েছে। সেই তুলনায় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ভেজাল কম মেশানো হয়েছে। সেই সময় পরীক্ষার জন্য নমুনাও বেশি পাঠানো হতো।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক ও ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির চিফ অ্যানালিস্ট ডা. মো. আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, গবেষণার ফলই বলছে খাবারে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। অর্ধেকের বেশি খাবার ভেজাল হলে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রতিদিন ভেজাল গ্রহণের ফলে পাকস্থলীতে সমস্যা হচ্ছে। কিডনি বিকল হচ্ছে। মস্তিষ্কের রোগের প্রকোপ বাড়ছে; ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ভেজাল থেকে বের হয়ে আসার জন্য আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ দরকার।
প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করে ভেজাল চিহ্নিত করলেও তারা নিজস্ব উদ্যোগে বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে পারে না। কোন পণ্যের ওপর গবেষণা হবে তার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা উপজেলা স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অধীনে চাকরি করেন। তাঁরা বিভিন্ন বাজার ও প্রতিষ্ঠান থেকে নমুনা জব্দ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠান। সেই নমুনা পরীক্ষা করে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষের শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, বুক জ্বালাপোড়া করা, বমি হওয়া, ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া, কথা বলতে বা কিছু গিলতে সমস্যা হওয়া। এ ছাড়া হাত-পা অবশ হওয়া, শরীরের চামড়া ঠাণ্ডা ও ভিজে যাওয়া বা রক্তচাপ কমে যেতে পারে।
এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিভিন্ন আইনের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেছেন, ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে ফল দিয়ে তৈরি করা জুস, জ্যাম, জেলি ও সিরাপ তৈরির উপাদানগুলোর নাম ও পরিমাণ সুস্পষ্ট উল্লেখ করার কথা বলা আছে। কিন্তু বাজারে বিভিন্ন ফলের রস বিক্রি হচ্ছে। কোন ফল দিয়ে এসব জুস তৈরি হয়, তা সুনির্দিষ্টভাবে লেখা থাকে না। এসব পণ্যের পেটেন্ট দিয়ে থাকে বিএসটিআই। পণ্যের প্যাকেটে ফুড রুলস অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে ফলের নাম ও বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ লিখতে হবে। এসব ধাপ অনুসরণ না করলে বিএসটিআই থেকে বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। বিষাক্ত কেমিক্যাল আমদানিকারকদের তালিকা তৈরি ও রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। আমদানি করা পণ্যের চাহিদা তৈরি ও ব্যবহারে সমন্বয় করতে হবে। সারা দেশে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা ভেজাল পণ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু তাঁরা ভেজাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না। তাঁদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া দরকার। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সরাসরি বাজার থেকে পণ্য কিনে পরীক্ষা করতে পারে না। তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাঠানো নমুনার ওপর নির্ভর করতে হয়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে সরাসরি পণ্য সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার অধিকার দেওয়া দরকার।
এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আইনটির খসড়ায় সরকার ইতিমধ্যে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে খসড়া আইনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে আইন মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ আইন নিয়েও সংশয় রয়েছে। বর্তমান সরকার তার অবশিষ্ট মেয়াদে আইনটি শেষ করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া খসড়া আইনটিতে বিভিন্ন দপ্তরকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অধীনে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছেড়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আসতে রাজি কি না, সেই মতামত নেওয়া হয়নি।
স্যানিটারি ইন্সপেক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব সুলতান আহমদ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে যেতে রাজি আছি কি না, তা জানতে চায়নি সরকার। এ বিষয়ে আমাদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। আর নতুন আইনে গেলেই যে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে, সেই বিষয়েও কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল পাওয়া গেলে আমরা কোনো মামলা করতে পারি না। নতুন আইনে কী বিধান রাখা হয়েছে, তা আমাদের জানানো হয়নি।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ১৮টি কাজ করেন। তার মধ্যে একটি মাত্র কাজ হচ্ছে ভেজাল প্রতিরোধ। অবশিষ্ট কাজের জন্য তাঁকে কেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অধীনে নেওয়া হবে, তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। এ ছাড়া তাড়াহুড়া করে আইনটি প্রণয়ন করা উচিত নয় মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, সব কিছু শেষ করে সংসদে উপস্থাপনের মতো পর্যাপ্ত সময় সরকারের হাতে নেই। এ অবস্থায় আইন করার কৃতিত্ব নেওয়ার মানসিকতা থেকে সরকারের বের হয়ে আসা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.