গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ- বিপ্রদাশ বড়ুয়া

শহরে কিছু অপরিচিত আগন্তুকের হামলা হতে পারে, এরকম একটা গুজব দেখতে দেখতে প্রায় প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেল। গুজবটাতে বিশ্বাস না করলেও পুলিশ কিন্তু এ ব্যাপারে কোনোরকম ঝুঁকি

নেয়নি। তারা জনসাধারণকে সতর্ক করে দিল। আর কোনো অপরিচিত আগন্তুককে দেখলে তক্ষুণি তা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবার জন্য ঘোষণা জারি করে দিল। এটা প্রত্যেকের কাছেই সদিচ্ছা ও শান্তির সময় বলে সরকার আক্রায় কারফিউ বলবৎ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্তটাও পুনর্বিচার করার সিদ্ধান্ত নিল। তবে সেই সঙ্গে জনসাধারণকে এই মর্মে সতর্কও করে দিল যে নিজে সুনিশ্চিত না হয়ে কেউ যেন কাউকে বাড়িতে নিয়ে না যায় বা গাড়িতে তুলে না নেয়। বিশেষ করে শহরে নির্জন রাস্তাগুলোতো নয়ই।
তরুণী গিল্ডা কোবলাভি এসবের কিছুই শোনেনি। কারণ সে এতদিন আবুরি পর্বতমালার রুদ্ধ পৃথিবীতে ছিল। ওর মা-বাবা ওকে বড়োদিনের উৎসবের সময় বাড়িতে আসতে চিঠি দিয়েছিলেন। ও কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যাত্রার সময়টা ক্রমাগত স্থগিত রেখেছে বা পিছিয়ে দিয়েছে। শেষে জিনিসপত্র গোছগাছ করে একটা লরিতে চেপেই আক্রায় রওনা দেয়। মাত্র মাইল কুড়ির তো ব্যাপার। একেবারে নির্ভেজাল রোমাঞ্চবিহীন চেনা নির্বিঘ্ন পথ- হয়তো এমনটিই ভেবেছিল সে।
কিন্তু অর্ধেকটা পথ পেরিয়েই লরিটা বিকল হয়ে গেল একটা শব্দ করে। অন্য যাত্রীরা ভোর হওয়া অব্দি ওখানেই একসঙ্গে অপেক্ষা করে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। গিল্ডা কিন্তু অধৈর্য হয়ে পায়ে হেঁটেই আক্রার দিকে রওনা দিয়ে বসল। ভাবল মোটে তো দশ মাইলের মামলা, আবহাওয়াটাও ঠান্ডা ঠান্ডা বেশ মনোরম। আর মালমাত্রাও তো তেমন নেই যে বইতে হবে। আর বছরের এই সময়টায় রাস্তায় প্রচুর গাড়িটাড়িও পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।
মাইল দু'য়েক যাওয়ার পর ব্যথা শুরু হওয়ায় সে পা থেকে উঁচু গোড়ালির জুতো-জোড়া খুলে নিল। দু'পাশের অরণ্য সম্পূর্ণ নীরব নিথর। আলো খুব সামান্যই, বলা যায় একেবারেই নেই। হঠাৎ ওর খালি পায়ে ঠান্ডা আর নিথর কী যেন একটা লাগল। রাস্তার ঠিক মাঝখানে স্তূপের মতো পড়ে আছে জিনিসটা। গিল্ডা বুঝতে পারল ওটা একটা বড় সাপ। ঠিক তখনই পেছনে, বেশ দূরে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনতে গেল সে। গিল্ডা অপেক্ষা করে রইল। গাড়িটা কাছাকাছি আসতেই সে উদভ্রান্তের মতো নাড়তে লাগল ওর আতঙ্কিত রুমাল। গাড়িটা থামল। ভেতর থেকে একজন ওকে ইশারায় ডাকল। গাড়ির চোখ ধাঁধানো ঝলমলে আলোয় গিল্ডা দেখল সাপটা রাস্তা জুড়ে কুন্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে। সুন্দর কিন্তু ভয়ঙ্কর।
'আক্রায় যাচ্ছ?' চালকের আসনে বসা লোকটি জিজ্ঞেস করল।
'গাড়ি দিয়ে সাপটাকে মারো।'
'কী দরকার! ওটা একেবারেই নিরীহ। তাছাড়া ঘুমুচ্ছে। তুমি কি আক্রায় যাচ্ছ?
হঁ্যা
'আমরা কি তোমাকে পেঁৗছে দিতে পারি? আমরা এই তিন জন। তুমি সংখ্যাটাকে চার করতে পারে।'
'বিচ্ছিরি সাপটার কাছ থেকে তোমাদের গাড়িটা একটু এগিয়ে নাও!'
গাড়িটা সামনের দিকে এগিয়ে নিল, গিল্ডা অনুসরণ করল।
'মনে হচ্ছে তুমি ভয় পেয়েছে', ওদের একজন বলল, 'আমরা তোমাকে গলা টিপে খুন করতে যাচ্ছি না তাই বলে!'
'হা হা!' আরেকজন হাসল।
'আর আমরা শয়তান-টয়তানও নই!' দ্বিতীয় জন বলল।
'তুমি কি ভাবছ, আমি একটা ভূত?' তৃতীয় জন স্বাভাবিক গলায় গমগমিয়ে আরো বলল, 'আমি তোমার মতো সে ফ একটি মানুষ।'
'তোমরা ভারি অদ্ভুত তো! এই বড়োদিনের সময় খুন-খারাবি, ভূত আর শয়তান নিয়ে কথা বলছ! তোমাদের সঙ্গে যেতে আমার ভয় করছে।'
'আরে এসো, এসো! আমরা যা বলেছি ভুলে যাও। আমাদের তাড়া আছে। দু'টোর সময় রাস্তার সাঁকোটাকে টেনে নামিয়ে দেয়া হবে।'
গিল্ডা গাড়িতে দিয়ে উঠল, কিন্তু আচমকাই ও যেন লোকটার কথার অর্থ উপলব্ধি করতে পারল। আর বলল, 'সাঁকো? কিন্তু আক্রার পথে তো কোনো সাঁকো নেই! আমি নেমে যাব। তোমরা ভূতপ্রেত আর শয়তান। আমাকে নেমে যেতে দাও!'
'ওসব দুশ্চিন্তা বাদ দাও। তুমি কি আমাদের এক রাতের স্বাধীনতাকে নষ্ট করে দিতে চাও?'
গাড়িটা শুধু চলছে, শুধু তাই নয়- উড়ে চলছে। কানের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া হাওয়া গুঞ্জন তুলছে গিল্ডার কানে। একবার সে বেশ জোরে দুম্ করে একটা আওয়াজ শুনল, ভাবল কেউ বুঝি বন্দুকের গুলি ছুড়ল। ওরা তখন গিল্ডাকে বলল, ওদের গাড়িটা খুব জোরে ছুটলে বাতাসে অমন শব্দ হয়।
'বড়োদিন তোমার আনন্দের হোক, গিল্ডা', ওদের একজন বলল।
'শুভ বড়োদিন, গিল্ডা কোবলাভি', বলল আরেক জন।
'পৃথিবীতে শান্তি আসুক, সব নশ্বর জীবের কল্যাণ হোক', অন্য জন বলল।
গিল্ডা বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে যায়, 'আমার নামটা তোমাদের কে বলল?'
'ভালো করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখো, গিল্ডা কোবলাভি। তুমি কি আমার চেহারায় কোনো সাদৃশ্যই দেখতে পাচ্ছ না? আমি কি এতই বদলে গেছি? অবশ্য আজ তিন বছর হল আমি মরে গেছি। আমি কোবিনা কোফি। না, তোমাকে ভয় খেতে হবে না। এক সময় আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু বস্ন্যাক ডান্ডিজ রিদমের এক সামান্য গিটার বাদকের জন্য তোমার কতটুকু সময়ই বা ছিল? একটুও না। হঁ্যা, হেনরির জন্য, ওর সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর মোটা মাইনের জন্য- তুমি যখন আমাকে ছেড়ে দিলে, তখনই সবকিছু শেষ হয়ে গেল।'
গিল্ডা ফের লোকটির দিকে তাকাল এবং দেখল। তার মুখটা সত্যিই সেই গিটার বাদকের মতো- যার প্রেমের প্রতিদান সে কোনোদিনই দেয়নি। মনে পড়ে গেল সে কীভাবে বস্ন্যাক ডান্ডিজ রিদমের অনুষ্ঠান শুনত। গিল্ডার ভালোবাসা জয় করে নেয়ার আশায় কীভাবে সেই গিটার বাদক নিজের রোজগারের সব টাকা ওর হাতে তুলে দিত। হেনরিও ওই ক্লাবে আসত। গিল্ডা আরো ভাবল, এই মুহূর্তে কোথায় আছে হেনরি? কেউ কেউ বলে সে নাকি কুমাসিতে চলে গেছে।
'কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?' গিল্ডা বলল, 'তুমি তো মৃত! তুমি আর আমাদের মধ্যে নেই। কোফি, তুমি যখন ওই সব মাদক ব্যবহার করতে শুরু করেছিলে, আমি কি তোমাকে সাবধান করে দিইনি? বলো?'
'এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, গিল্ডা! আমি তো মরেই গেছি! কিন্তু জানো, অন্য দুনিয়াতে ওরা সাধারণত বছরে একটি রাত আমাদের স্বাধীনতা দেয়। আমার মনে হয় এই ব্যবস্থাটা বেশ ভালোই। ওই একটি রাতে আমরা যেখানে ইচ্ছে যেতে পারি। যা খুশি করতে পারি। কিন্তু ভোরের আগেই আমাদের নিজের জায়গায় ফিরে যেতে হয়। বুঝলে- তা না হলেঃ'
'না হলে, কি?' গিল্ডা জানতে চাইল।
'তা আমি জানি না। তবে সাঁকোটা উঠে গেলে, অর্থাৎ দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আর ভেতরে ঢুকতে পারব না। আবার মরে গেছি বলে পৃথিবীতেও ফিরতে পারব না।'
'আহা বেচারা!' শিউরে চিৎকার করে উঠল, 'একেবারে ত্রিশঙ্কু, একদিকে শয়তান আর একদিকেঃ ড্রাইভার, তুমি ভাই গাড়িটা একটু আস্তে করো, আমি এক্ষুণি নেমে যাব!'
'আর সামান্য একটু পথ। শিগগির আমরা পেঁৗছে যাব!
গাড়ির গতি ক্রমে দ্রুততর হয়েছে, তবু ওরা এখনো আক্রায় পেঁৗছায়নি। অথচ মাত্র দশ মাইল পথ ছিল। পথের পাশে এমন কিছুই নেই যা দেখে বোঝা যায় ওরা ঠিক কোন জয়গাটা রয়েছে। গাড়ির জানালাগুলো মেঘ আর ধুলোয় ঢাকা, অথচ ওরা চলেছে বাঁধানো সেই একই রাস্তা দিয়ে। গিল্ডা বুঝতেই পারছে না জায়গাটা পাহাড়ী না সমতল, গাছপালা আছে নাকি শুধুই ঘাস।
'আমাদের অন্য দু'জনকে তুমি চেনো? ওই কোনে আছে কুডজো মেনশা।'
'কোন কুডজো, কোফি? নিশ্চয়ই সেই ফুটবল খেলোয়াড়টি নয়। তাকে আমার মনে আছে। শেষ বার নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে সকার উইজার্ডসকে নেতৃত্ব দিয়ে সে কাপটা ফের জিতে এনেছিল। তোমরা কি স্বর্গেওঃ মানে বলতে চাইছি, তোমরা কি বিগতদের দেশেও ফুটবল খেল নাকি?'
'হঁ্যা', কুডজো উত্তর দিল, 'ঠিক ফুটবল না হলেও অনেকটা ওই ধরনের বলতে পার।'
'আর অন্য জন হচ্ছে অ্যালান', ওদের কথায় বাধা দিয়ে কোফি বলল, 'ওকে তো তোমার মনে আছে, অ্যালান আর্মটেফিও।'
'ও অ্যালান, আমার প্রিয় চিত্র-অভিনেতা!' গিল্ডা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাকে কি এখন আমার সব কজন অতীত-প্রেমিকের মুখোমুখি হতে হবে? এযে চরম অত্যাচার! আমি আর সহ্য করতে পারছিনে। দয়া করে গাড়িটা থামাও!'
আমরা তিনজনই মৃত। আমরা তোমাকে গাড়িতে তুলে নিয়েছি ঘটনাচক্রে নয়, নিজেদের ইচ্ছে ও পছন্দে। আমাদের ব্যবস্থায় তোমার লরিটা বিকল হয়েছিল। তুমি অন্যদের ফেলে রেখে হাঁটা দিয়েছিলে তাও আমাদের ইচ্ছেয়। স্বাধীনতার এই একটা রাতে আমাদের হারাবার কিছু নেই।'
'বেশ! আমি অ্যালানকেই চাই, ব্যাস। তোমাদের মধ্যে একমাত্র ওকেই ভালোবাসতাম আমি। কিন্তু ও আমার ভালোবাসা অবজ্ঞায় অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করেছে। তোমরা বাকি দু'জন আমাকে ভালোবাসতে, কিন্তু তোমাদের সম্পর্কে আমার কোনো তাপ-উত্তাপ ছিল না। অ্যালানকে আমি ভালো না বেসে পারিনি। আমি এখনো ওকে ভালোবাসি। বিগতদের দেশেও আমি ওকে অনুসরণ করব। করে যাব।'
'তুমি পাগল, তুমি উন্মাদ, গিন্ডা। তা হবার নয়। তাছাড়া আমরা সেজন্য আসিনি। আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পালা তোমারও আসবে একদিন। ততদিন তুমি অপেক্ষা করে থাকো।'
'আমি অ্যালানকে চাই। আর কিছু শুনতে চাই না। ও আক্রা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি এতগুলো বছর ওর জন্য অপেক্ষা করে আছি। আমি ওকে ভালোবাসি। আমার কাছে ও কোনোদিন মরতে পারে না।' বলে গিল্ডা থামল।
'অ্যালান! আমাকে কিছু বলো, অ্যালান! যা হোক কিছু তো বলো!'
অ্যালান যেখানে বসে ছিল সেখানেই রইল। গাড়ি এবার আগের চেয়েও দ্রুত ছুটে চলল। চালকের আসনে বসা লোকটি ফের গিল্ডাকে জিনেস করল, ও নামতে চায় কি না। এবার ওরা শহরের চৌহদ্দিতে পেঁৗছে গেছে। রাস্তার ধারের ফলকে লেখা রয়েছে, গতিসীমা ঘন্টায় তিরিশ মাইল। কিন্তু গিল্ডা বলল ওর ইচ্ছে, অ্যালান ওর সঙ্গে গিয়ে ওর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করবে, আর তাঁদের কাছে দেয়া নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে।
'কিন্তু আমরা তো বলেছি তা অসম্ভব! বছরে একটিমাত্র রাত আমাদের মুক্তির অনুমতি মেলে। সূর্য ওঠার আগেই আমাদের ফিরে যেতে হয়।'
'এখন তুমি যাও', কুডজো বলল, 'ওই শোনো, বড়োদিনের গান, ক্রিসমাস ক্যারল।' গিল্ডা ওদের সঙ্গে মাঝরাতের প্রার্থনাসভায় গেল। সেখান থেকে গেল নাচের আসরে। পুরোনো দিনের মতো কোফি বাদকদলের সঙ্গে বসে তার প্রিয় গিটার বাজায়। সাংঘাতিক বাজনা তার। বিষণ্ন আর গম্ভীর সুর। একটা মুখোশ পরে ছিল সে, যাতে কেউ তার মুখ দেখতে না পায়। কিন্তু বাজনা শুনে অনেকেই বলতে লাগল, লোকটা পরলোকগত কোবিনা কোফির মতো বাজাচ্ছে।' কোফিকে তারা ভালো করে মনে রেখেছে। নির্ভুল।
নাচের পর ওরা তিনজন বলল, ওদের ফিরে যেতে হবে। গাড়িটা ওরা একটা গ্যারেজে ফেরত দিয়ে, তারপর চলে যাবে। গিল্ডা অ্যালানকে অনুসরণ করল। সমুদ্রের ধারে গিয়ে পেঁৗছল ওরা। কাছেই সৈকতাবাস। গ্যারেজের দরজা না খুলেই ওরা গাড়িটা ফেরত দিল। ফিরে এসে গিল্ডাকে বলল, এবার তারা গিল্ডা থেকে বিদায় নেবে।
গিল্ডা কেঁদে দিল। কাতর অনুুনয় করল। কিন্তু আচমকা দেখল, সে একা, ওরা নেই। কিন্তু ওকে তো আক্রায় মা-বাবার কাছে ফেরার পথ খুঁজে নিতে হবে। ফিরে যেতে হবে জীবনের লক্ষ্যে পেঁৗছুবার জন্য, শুধুমাত্র গিল্ডা কোবলাভি হয়ে বেঁচে না থেকে তার চেয়ে বেশি কিছু হয়ে ওঠার জন্যঃ লড়াই করতে হবে, লড়াই। একটা একটা করে সে নিজের পোশাক খুলতে শুরু করল, শুধু নিচের হালকা অন্তর্বাসটুকুই রইল। তারপর অগাধ জলে নিজেকে ছুঁড়ে দিল, তলিয়ে গেল দশ গজ সাঁতার কাটার আগেই।
বড়োদিনের সকালে চোখ মেলর গিল্ডা। এক জেলে চোখ নামিয়ে ওকে দেখছিল। ওকে চোখ মেলতে দেখে জেলেটির বলিরেখাময় মুখে হাসি ফুটল। নেচে উঠল চোখ-দুটো।
আমি কোথায়?
গিল্ডার কথার জবাবে লোকটি বলল, 'আক্রা বাতিঘর।' গিল্ডা চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। সত্যিই-উল্টো দিকে সৈকতাবাস, ট্যাক্সি দাঁড়ানোর জায়গা, সুন্দর পোশাক পরে রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে সবাই, হাঁটছে আর আনন্দ করছে। ঘটনাটি কি তাহলে সত্যিই ঘটেছিল? না কি ওর সঙ্গে একটা কৌতুক অভিনয় হয়ে গেল? ওর সারা মন এক দুর্লভ আনন্দে ভরে আছে। অথচ তার সঙ্গে মিশে আছে এক অদ্ভুত অস্পষ্টতা। ওর মনে হচ্ছিল ও যদি জেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, ও কী করে এখানে এল, অথবা সে ওর তিন প্রেমিককে দেখেছে কি না! আবার ভাবল তাহলে ওকে হয়তো বুড়ো জেলের কাছে বোকা বনে যেতে হতে পারে।
বাতিঘরের ঠিক ওপারেই অসংখ্য ঝুপড়ির মধ্যে এই জেলেটির বাড়ি। সেখানে তাল আর নারকোল গাছের তলায় বসে ওরা 'কেংকে' বেচে ধোয়া পোশাকগুলো সারি সারি শুকোতে থাকে ঝুপড়িগুলোর পেছনে। বাতাস ভরে থাকে চুলার শিকে মাছ ঝলসানোর ধোঁয়ায়। কিছুটা সুরুয়া খেয়ে নিল গিল্ডা। তারপর ভাবতে শুরু করল, মাকে গিয়ে কি বলবে! ব্যাখ্যা অবশ্য শুরু করতে হবে সান্ধ্য পোশাকটা থেকেই, যা সে এই সকালেও পরে রয়েছে।
'গিল্ডা, তুই ফিরে এলি! শুভ বড়োদিন! প্রতিবেশীরা বলল।
'শুভ বড়োদিন', জবাব দিল গিল্ডা। তারপর অস্ফুটে নিজেকে বলল, 'আমিও একটা রাতের স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তু তা নিয়ে আমি কি করেছি, জানি না।'
গিল্ডা পরে অচেনা হানাদারদের গুজবটা শুনেছিল। কিন্তু প্রবল বিভ্রান্তিতে সে আর স্বীকার করতে পারেনি সে ও তাদের দেখেছে।
----------------------------
সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সিঃ ১৯২১ সালে নাইজেরিয়ার মিন্নার-এ আফ্রিকার এই মহান কথাসাহিত্যিকের জন্ম। আফ্রিকার রাজধানীতে যেমন নক্রুমা, কথাসাহিত্যেও তেমনি এক্ওয়েন্সিকে গণ্য করা হয়। 'নাইজেরিয়ার ড্যানিয়েল ডিফো' নামেও বর্ণিত তিনি। পড়াশুনা ইবাদানের স্কুল, ঘানার আকিমোতা কলেজ এবং ইবাদানের বনবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান থেকে। শেষ করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেষজ বিজ্ঞান পড়ে। শিক্ষা জীবনের মতো কর্মজীবনও বিচিত্র। প্রথম ইংরেজি ও বিজ্ঞানের অধ্যাপক, লাগোসে ভেষজ বিজ্ঞানে অধ্যাপনা, নাইজেরীয় চিকিৎসা সংস্থার চিকিৎসা বিজ্ঞানী। নাইজেরিয়ার লাগোসে তথ্যমন্ত্রকের অধীনে ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের অন্যতম প্রধান ছিলেন। নাইজেরীয় তথ্য মন্ত্রণালয়ে পরিচালকও হয়েছিলেন। ১৯৬৭-৭১ সালের গৃহযুদ্ধের সময় পূর্ব নাইজেরিয়ার বায়াফ্রাতে বেতার বিভাগে যুক্ত ছিলেন।
তাঁর প্রকাশিত পুস্তকের মধ্য 'শহুরে মানুষ' (১৯৫৪), 'ঢাক বাজিয়ে ছেলে' (১৯৬০), 'মালায় ইলার পাসপোর্ট' (১৯৬০), 'জাগুয়া নানা' (১৯৬১), 'সুন্দর পালক' (১৯৬৩), 'পিপল অব দ্য সিটি' নানা কারণে অত্যন্ত উলেস্নখযোগ্য। গল্পসঙ্কলন 'লোকোটাউন'। বহু ছোট গল্প সংগ্রহে তাঁর গল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। 'শুধু একটি রাত' গল্পে মৃতদের সঙ্গে জীবিতের অলৌকিক ভ্রমণ পাঠককে লৌকিক-অলৌকিক রাজ্যে নিয়ে যায়। তখন গল্প আর গল্প থাকে না হয়ে যায় বাস্তব কথামালা। এক তরুণীর তিন প্রেমিকের মুখোমুখি হয়ে এই স্বীকারোক্তি সত্য হয়ে যায় রাতটি ভোর হয়ে যাওয়ার মতো।]
===============================
গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত  স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী  সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী  গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায়  গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী  সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি:লেজুড়বৃত্তির অবসান আজ জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার  কৃষি আলোচনা- 'কৃষিজমি রক্ষার দায় সবার' by আফতাব চৌধুরী  শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর  আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ বিপ্রদাশ বড়ুয়া


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.