স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী

শওকত ভাই নেই। কত অজস্র স্মৃতি মনের আকাশে ভিড় করে আসছে। প্রতিদিনের কাজ করে যাচ্ছি, পড়ছি, লিখছি, লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি, অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করছি, পৃথিবীর কোনও কাজই থেমে নেই।

শওকত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে। তখন তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে অধ্যাপনা করছেন। আমিও চট্টগ্রামে কর্মরত। বেসরকারি সরবরাহ বিভাগে। স্ত্রী ও দু'টি ছোট মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। প্রথম পরিচয়ের লগ্ন থেকেই শওকত ভাই ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমাদের প্রগাঢ় অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে।
তার সঙ্গে আমার ও আমার স্ত্রীর দীর্ঘ আলাপচারিতা চলত সমকালীন ও ধ্রুপদী সাহিত্য নিয়ে, সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের নানা পথ অনুসরণের বিভিন্ন সম্ভাবনাকে ঘিরে। আমার স্ত্রীক নাম মেহের, ডাকনাম মেরী। ওই দুই নামকেই আমার নামের সঙ্গে যুক্ত করে কতো সি্নগ্ধ কৌতুক যে করেছেন শওকত ভাই। ডাকতেন মেরী-বোন, বলতেন আমার বোন তো বটেই, উর্দু ব্যাকরণ অনুযায়ী ভুল হল বটে কিন্তু সেটা ধর্তব্য নয়। কবে তার লেখা বই উপহার দিয়েছিলেন আমাদের দু'জনের নাম লিখে। তাতে লিখে দিয়েছিলেন, ঞড় গধৎু ধহফ ঐবৎ খধসন, লেখার শেষে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন, রাগ করবেন না, মানিক ভাই। মানিক আমার ডাকনাম। এই মানিক নাম নিয়েও তিনি কৌতুক করেছেন। তার লেখা প্রায় সব বই তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন, প্রতিটির প্রথম পাতায় নিজের হাতে দু'চার লাইন লিখে দিয়ে। অনুকরণীয় সেসব পঙক্তি এবং কী অনায়াসে মুহূর্তের মধ্যে তিনি এসব লিখতেন।
এ মুহূর্তে আমার সামনে শওকত ভাইয়ের দেয়া তার কয়েকটি বই সাজানো আছে। কত স্মৃতি টেনে আনে সেখানে অাঁকা তার কথাগুলি। একটি বই-এ লিখে দিয়েছেন:
"নির্দয় সংসারে সর্বদা মেহেরবান
সোদর কবীর চৌধুরী
ভগিনী গধৎু
যুগলেষু
মানুষে মানুষে অস্বাভাবিক ভাগ
টিকল না
পাকিস্তান থেকে মূর্খেরা কিছু
শিখল না।
সংখ্যাহীন শুভেচ্ছাসহ
শওকত ওসমান।"
তিনি আমার স্ত্রীর আটপৌরে নাম ও পোশাকি নাম দু'টোই ব্যবহার করেছেন। অন্য একটি বই-এ আবার লিখেছেন ইংরেজি ভাষায়:
"অ জবভৎধরহ
ঞড়
ঝরংঃবৎ গধৎু
অহফ
ঐবৎ খধসন
ভড়ৎ ঘড় ঝঃৎধরহ-
ডরঃয ধঢ়ড়ষড়মু
ঝযধশিধঃ ঙংসধহ"
'৯৫ সালের মে মাসে, তিন বছর আগে, তাঁর আরেকটি বই উপহার দেবার সময়ে লেখেন:
"লভ্য যাদের তারাই খানিক
ভাঙিয়ে খেতে পারে মানিক :
সপ্ত নৃপতির ঐশ্বর্য
কবীর চৌধুরী-কে
শওকত ওসমান-
'তাঁহার খধসঢ় ছাড়া ভগিনী গধৎু-র হিস্যাসহ
শ.ও."
আমার নাম নিয়ে মাঝে মাঝেই কৌতুক করতেন; বলতেন, আপনি তো সাত রাজার ধন 'মানিক' যদিও আমার বোনের মেষ। বছরখানেক আগে যখন তিনি বারডেমে খুবই অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী তখন আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। সে অবস্থাতেও কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি একটা কাগজে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখে দিয়েছিলেন: "ঝরংঃবৎ (যদিও হাসপাতালের নয়) গধৎু ও কবীর ভাইকে- শওকত ওসমান"
অল্প কিছুকাল আগে তাঁর একটি বেশ পুরনো গল্পগ্রন্থ "জন্ম যদি বঙ্গে" আমার স্ত্রীকে উপহার দেন শওকত ভাই। তাঁর শরীর ভাল যাচ্ছিল না। আমি তাঁকে দেখতে তাঁর মোমেনবাগের বাসায় যাই। কত কথা হয়েছিল সেদিন। চলে আসবার সময় তিনি আমার হাতে একটা বই তুলে দিলেন। লিখে দিলেন:
"ভগিনী মেরী কবীরের জন্য
উপহার দীন ও মস্নান
অনেক শুভেচ্ছাসহ
অবশ্যই মতি-প্রসন্ন
"শওকত ওসমান"
শওকত ভাই ও আমি যখন চট্টগ্রামে বাস করছি তখন আমরা কয়েকজন বিভিন্ন উপলক্ষে প্রায়ই আড্ডায় মিলিত হতাম।
কলিম শরাফী, সৈয়দ মুজিবুল হক, যিনি পরে ঢাকায় ইস্পাহানিদের প্রতিষ্ঠানে যোগদান, বোরহান উদ্দিন আহমেদ, যিনি পরে সরকারের উচ্চ স্তরের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হন, সৈয়দ নসরুলস্নাহ যিনি ছিলেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, বাঁশপাড়ার জমিদার বাড়ির বিনোদ বাবু, চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনের চেয়ারম্যান বারী সাহেব, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে লেখা প্রথম কবিতার রচয়িতা মাহবুব আলম চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন সংস্কৃতিমনা মানুষ একত্রিত হয়ে নানা বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করতাম। তখন থেকেই দেখেছি শওকত ওসমান কত জীবনঘনিষ্ঠ, সামাজিক বাস্তবতার সাহিত্যিক আদর্শে কতখানি আস্থাশীল, ব্যঙ্গ কৌতুক ও সরস কথকতার আড়ালে কী ভীষণ সিরিয়াস তিনি। ব্যাপক, গভীর, তীক্ষ্ম অনুসন্ধানী জীবনদৃষ্টি না থাকলে কী তার পক্ষে সম্ভব হত থুতুর মতো ছোট গল্প কিংবা জননী অথবা ক্রীতদাসের হাসির মতো উপন্যাস রচনা করা?
শওকত ভাই ছিলেন অত্যন্ত অনুভূতিশীল, আবেগপ্রবণ ও স্পর্শকাতর মানুষ। অন্যায়, অবিচার, মিথ্যার আধিপত্য ও মনুষ্যত্বের সর্বপ্রকার অপমান তাঁকে প্রচণ্ড বিচলিত করত। এর বিরুদ্ধে তিনি সারা জীবন তীব্র প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যবর্গ এবং স্বদেশের ঘৃণ্যতম জীব রাজাকার-আলবদররা যে জঘন্য সব কীর্তিকলাপ করেছে, হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগের মতো নারকীয় ঘটনাবলী ঘটিয়েছে তার জীবন্ত ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন তার লেখায়। একইভাবে স্বদেশপ্রেম ও মানবকল্যাণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ মানুষ যে কী রকম সাহসী হয়ে উঠতে পারে, প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে কীভাবে লড়তে পারে তার ছবিও তিনি এঁকেছেন ঈর্ষণীয় শৈল্পিক দক্ষতার সঙ্গে। আমি শওকত ভাইয়ের থুতু গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করি পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, আর তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি আরও দশ বছর পরে, ষাটের দশকের শেষ দিকে। আমার এইসব অনুবাদকর্ম এবং শওকত ভাইয়ের সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে বাংলা ও ইংরেজিতে বেশ কিছু লেখালেখি আমাকে তাঁর আরও কাছে এনে দেয়, যদিও আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের সম্পর্কই ছিল প্রধান। যখন শওকত ভাই শুনলেন যে, নিউইয়র্কে কর্মরত আমার মেজো মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে তখন তাঁর নিজের সন্তান সম্পর্কে এক চরম দুঃসংবাদ পেলেন। প্রায়ই তিনি আমাকে ফোন করে আমার মেয়ের খবর নিতেন। সে আগের চেয়ে এখন ভাল এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে এ কথা শুনে তিনি খুব খুশি হন।
গত ফেব্রুয়ারিতে আমার স্ত্রী যখন হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে বারডেমে ভর্তি হন তখনও শওকত ভাই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হন, নিজের অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি ওকে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে উপস্থিত হন, যদিও লিফটবিভ্রাটের কারণে ন'তলায় উঠে ওকে দেখে আসতে তিনি পারেননি। তবু প্রত্যেক দিন ফোন করে তার বোন কেমন আছেন সে খোঁজ নিতে তিনি ভোলেননি এবং এটা তিনি করতেন তাঁর অন্তরের টানে।
আরও কত স্মৃতি যে মনে পড়ে। আমরা দু'জন একবার একসঙ্গে এক শুভেচ্ছা সফরে ইরান গিয়েছিলাম। তেহরান, সিরাজ, ইস্পাহান প্রভৃতি শহরে একসঙ্গে ঘুরেছি, সাদীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে অমর কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি, ইস্পাহানের ঐতিহাসিক নানা স্থাপত্য কীর্তি ও বাজার দেখে মুগ্ধ হয়েছি। নানা মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তখন আবার নতুন করে লক্ষ্য করেছি শওকত ভাইয়ের জ্ঞানের পরিধি ও পড়াশোনার চিন্তার।
আমার এ স্মৃতিচারণের ইতি টানা কঠিন। মনটা এখনও অস্থির। অসাধারণ প্রাণবন্ত শওকত ভাই, আজীবন যোদ্ধা শওকত ওসমান, ভাই বন্ধু অভিভাবক শওকত ওসমান, ব্যঙ্গবিদ্রূপ ও তির্যক উক্তির অতুলনীয় শিল্পী শওকত ওসমান চলে গেছেন এ অমোঘ সত্যটি এখনও মেনে নিতে পারছি না আমি। তবু মেনে তো নিতেই হবে। মার্চের শেষের দিকের একটি ঘটনার উলেস্নখ করে এ লেখা শেষ করব। এবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্মান স্বাধীনতা দিবস পদক পাব আমরা দু'জনই, আরও কয়েকজনের সঙ্গে। ২৫শে মার্চ খুব ভোরে শওকত ভাই ফোন করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কখন ওসমানী মিলানায়তনে পেঁৗছুচ্ছি এবং কীভাবে যাচ্ছি। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমি অনুষ্ঠানের বিশ মিনিট আগেই পেঁৗছে যাব এবং যাব নিজের গাড়িতে। তিনি আমাকে জানালেন যে, তাঁকে নিয়ে যাবে সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের একটি গাড়ি এবং তার সঙ্গে থাকবেন একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। সুন্দর অনুষ্ঠান হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরস্কার প্রাপকদের গলায় পদক পরিয়ে দেন, তারপর সবাইকে নিয়ে একটা ছবি তোলার পর্ব। যে যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতে আমি তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। শওকত ভাইয়ের মঞ্চে উঠে আসতে একটু দেরি হয়। তিনি সহাস্যমুখে আমার কাছে এসে বললেন, মানিক ভাই, একটু সরুন, আমি হাসিনার পাশে দাঁড়াই, আপনার চাইতে বয়সে বড়তো বটে। প্রধানমন্ত্রীও হাসিমুখে সায় দিলেন। সেই ছবি এখন আমার চোখের সামনে। তার সঙ্গে আরও অজস ছবি। চিরদিন সে সব ছবি মনের পর্দায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
===========================================
সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন  স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী  গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম  গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী  গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায়  গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী  সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ'  গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান  ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি:লেজুড়বৃত্তির অবসান আজ জরুরি by বদিউল আলম মজুমদার  কৃষি আলোচনা- 'কৃষিজমি রক্ষার দায় সবার' by আফতাব চৌধুরী  শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর  আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ কবীর চৌধুরী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.