ইভটিজিং’ স্পষ্টতই যৌন হয়রানি by শীপা হাফিজা ও চিররঞ্জন সরকার

বখাটেদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের সমাজে হরহামেশাই ঘটছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় পিংকী নামের এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। ‘ইভটিজিং’-এর প্রকোপ বর্তমানে এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের সিমি, মিরপুরের ফাহিমা, খুলনার রুমি, গাইবান্ধার তৃষা, স্বপ্না ও সাভারের তিথির মতো অসংখ্য কিশোরী নিজের জীবনের সমাপ্তি টেনেছে আত্মহননের মধ্য দিয়ে। এসব মৃত্যু শুধু মৃত্যুই নয়, একেকটি আমাদের অভিশপ্ত সামাজিক জীবনের বিষাদময় কাহিনী।
‘ইভটিজিং’ কথাটি আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় খুবই ব্যবহার করা হয়। রাস্তায় মেয়েদের দেখে টিটকিরি দেয়া—এককালে ‘ইভটিজিং’ বলতে সেটিই বোঝানো হতো। টিজিং কথাটির আভিধানিক অর্থ পরিহাস, জ্বালাতন ইত্যাদি। তাই ‘ইভটিজিং’ শুনলে মনে হয়, সেটি দুষ্টুমি হতে পারে; কিন্তু সে রকম গুরুতর অন্যায় নয়। ‘ইভটিজিং’ বলে এভাবে অন্যায়টিকে হালকা করে দেখার একটা প্রবণতা থাকে। সভ্যসমাজে শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। সেখানে এ আচরণ যৌন হয়রানি (sexual harassment) হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কখনো কখনো একে একটি রোমান্টিক ইমেজ দিতে টিজিংকারী পুরুষদের ‘রোমিও’ বলে। রোমান্টিকতার পর্দার আড়ালে এর নেতিবাচক পরিণতিগুলো তাই আমাদের চোখে পড়ে না।
যৌন হয়রানি কী
যৌন হয়রানি হচ্ছে সেই ধরনের কর্মকাণ্ড ও আচরণ, যা মানুষের যৌনতাকে উদ্দেশ্য করে মানসিক ও শারীরিকভাবে করা হয়। যেকোনো ব্যক্তিই যৌন হয়রানির শিকার হতে পারেন, তবে আমাদের দেশে সাধারণভাবে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন বেশি। যৌন হয়রানি কর্মক্ষেত্রে, গৃহে, সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে মর্যাদাহানিকর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নির্যাতিতের অনুভূতিই শুধু বলতে পারে, বিষয়টি যৌন হয়রানির আওতায় পড়ে কি না। মানসিকতা, স্থান, কাল এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরও তা নির্ভরশীল। একই ঘটনা ভিন্ন ব্যক্তি ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এই হয়রানির ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। যেমন—ঠাট্টা-মশকরা, অঙ্গভঙ্গি, ইশারা, তিরস্কার, অবহেলা থেকে শুরু করে তা ধর্ষণ পর্যন্ত গড়াতে পারে।
২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়েছে, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো ধরনের নির্যাতন যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে: যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য বা রসিকতা, ্প গায়ে হাত দেওয়া বা দেওয়ার চেষ্টা করা, ্প ই-মেইল, এসএমএস, টেলিফোনে বিড়ম্বনা, ্পপর্নোগ্রাফি বা যেকোনো ধরনের চিত্র, অশ্লীল ছবি, দেয়াল লিখন, ্প অশালীন উক্তিসহ আপত্তিকর কোনো ধরনের কিছু করা, কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে সুন্দরী বলা, ্প কোনো নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, যেকোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা, ্প মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করা, যৌনসম্পর্ক স্থাপনের দাবি বা অনুরোধ, ্প অন্য যেকোনো শারীরিক বা ভাষাগত আচরণ, যার মধ্যে যৌন ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন।
দায়ী আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও নিষ্ক্রিয়তা
‘ইভটিজিং’-এর শেকড় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যবোধের মধ্যেই মিশে রয়েছে। শিশুর বেড়ে ওঠা ও সামাজিকীকরণের মধ্যেই নারীর প্রতি এই বিদ্বেষ ও সহিংস মনোভাব আত্মস্থ হয়ে পড়ে এবং তা ছেলে শিশুর ব্যক্তিত্বের অংশে পরিণত হয়। পরিণত জীবনে যাকে মুছে ফেলা কঠিন হয়। ঘরের অভ্যন্তরে বাবা বা অন্যান্য পুরুষ চরিত্রের রূঢ় আচরণ মেয়ে বা নারীদের অপমান করার সহজাত প্রবণতা থেকে ছেলেরা আত্মম্ভরী, বিদ্রূপাত্মক ও আশপাশের কম শক্তিধর মানুষকে হেয় করার মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকে এবং মেয়েরা শত অত্যাচার-অনাচারেও রা না করে মেনে নেওয়ার প্রবণতাকে ধারণ করে নেয়। এ ধরনের সামাজিকীকরণের মাধ্যমেই ছেলেরা রাগী, উদ্ধত ও সিদ্ধান্ত প্রদানে আগ্রহী হয় এবং মেয়েরা মেনে নেয়া, কথা না বলা ও সিদ্ধান্তহীনতার চরিত্র ধারণ করে। এভাবে উভয়েই অসম্পূর্ণ মানুষ হয়ে বড় হয়। এই চক্র থেকে উত্তরণ পেতে হলে শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার দিকে সর্বপ্রথম নজর দিতে হবে, যাতে তারা উভয়ের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠতে শেখে।
আইনের ব্যাখ্যা নেই
আমাদের দেশে ‘ইভটিজিং’-এর ঘটনা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে ঘটছে। অথচ প্রচলিত আইনের কোনো ধারায় ‘ইভটিজিং’ বা হয়রানি বলে কিছু নেই। তবে হয়রানিমূলক কাজকে বিভিন্ন আইনে অপরাধ বলে ধরে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। তবে ১৪ মে ২০০৯ যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের এক যুগান্তকারী রায় ঘোষণার পর এ সংক্রান্ত অস্পষ্টতা অনেকটাই দূর হয়েছে। এখন প্রয়োজন হাইকোর্টের এ রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন।
যৌন হয়রানির ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যা
‘ইভটিজিং’-এর মতো মেয়েদের প্রাণসংহারক একটি গুরুতর অপরাধকে হালকাভাবে দেখার এবং এর দোষ মেয়েদের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতাই এর ব্যাপ্তি বাড়াতে সহায়তা করছে। আমাদের রক্ষণশীল সমাজের ধারণা—মেয়েদের জায়গা ঘরে আর ছেলেদের জায়গা ঘরের বাইরে। এমনও বলা হয়ে থাকে, মেয়েরা ‘অশালীন পোশাক’ পরে রাস্তাঘাটে চলাচল করে বলেই হয়রানির ঘটনা ঘটে। অথচ বৃদ্ধা বা অবগুণ্ঠিত নারীদের ক্ষেত্রেও যৌন হয়রানি অহরহ ঘটার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের সমাজ হয়রানকারীদের না দুষে উল্টো মেয়েদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তাদের মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। অন্যদিকে অপরাধীরা দ্বিগুণ উত্সাহে এ কাজ চালিয়ে যায়। সমাজের চাপ এবং নিরুত্সাহের কারণে এ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হতেও সমস্যা হয়।
উত্ত্যক্ত ও হয়রানির পথ ধরে অপহরণ, ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, জোরপূর্বক বিয়ে, আত্মহত্যা, পরিবারের এলাকা ত্যাগ, মা-বাবা ও ভাইয়ের হতাহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে। এর নেতিবাচক প্রভাবও তাই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়েই পড়ে। বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন বখাটেরা নিজেদের বিকৃত বিনোদন পাওয়ার জন্য নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। ভয়-ভীতি ডিঙিয়ে যখন নির্যাতিতা মেয়েটি পরিবারের সদস্যদের কাছে ঘটনাটি খুলে বলে তখন তাকে যে পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয় সেটি আরও দুর্বিষহ। পরিবারের মূল্যবোধের কথা চিন্তা করে মেয়েটির জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়ে বিয়ের মাধ্যমে তাকে ঠেলে দেওয়া হয় ভিন্ন এক জগতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের বাল্যবিয়ে গ্রামে হয়ে থাকে। স্কুল থেকে মেয়েশিশু শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার অন্যতম একটি কারণ হলো বাল্যবিয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে দেখা গেছে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি।
যৌন হয়রানি কেন হচ্ছে
কেন আমাদের দেশে যৌন হয়রানি এত বেশি—এ বিষয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। কিছু গবেষকের মতে, এ ব্যাপারে স্যাটেলাইট চ্যানেল, টিভি নাটক, বিজ্ঞাপন এবং হিন্দি সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। নাটক ও বিজ্ঞাপনে এবং বলিউডের বহু সিনেমায়ই নায়ক মজা করে নায়িকাকে শিস দিয়ে, গান গেয়ে, অঙ্গভঙ্গি করে করে যৌন হেনস্তা করে; নায়িকা প্রথম বিরক্ত হলেও পরে তার হাতেই ধরা দেয় এবং নায়কের প্রেমে পড়ে। বহু যুবক হয়তো এ আশায়ই মেয়েদের ধাওয়া করে। কিছু গবেষকের বিশ্বাস, যেসব মেয়ে অন্তপুর থেকে বাইরের জগতে পড়াশোনা বা কাজ করতে বের হচ্ছেন—তাদের দমিত করাই এ ধরনের যৌন হয়রানির মুখ্য উদ্দেশ্য। কারণ যাই হোক, মহামারির মতো যৌন হয়রানি ঘটছে, এটি সমগ্র জাতির পক্ষেই কলঙ্কজনক এবং উদ্বেগের।
মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ
একজন নারী নানা উপায়ে নির্যাতিত হয় একমাত্র নারী হওয়ার কারণে। সমাজ নারীকে মনে করে ভোগের বস্তু। একজন মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে তাকে দেখা হয় না। প্রবঞ্চনা, শঠতা আর নির্যাতনে এভাবেই নারীকে করা হচ্ছে দুর্বল। আমাদের সংস্কৃতিতে নারীর ‘সম্ভ্রম’ বিবেচনা করা হয় সতীত্বের দিক বিচার করে। অথচ একজন নারী সমাজের কিছু বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ দ্বারা সম্ভ্রম হারালে তখন মেয়েটিকেই অসতী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সমাজের এ ধরনের বিপরীত আচরণ পরিবর্তন করতে হবে। যে মেয়েটি তাঁর সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে, তার পেছনেও এই সম্ভ্রমবোধ কাজ করেছে বলে ‘সম্ভ্রমহীন অর্থহীন’ জীবনের চেয়ে সে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছে। অভিভাবকেরা বাল্যবিয়ের ভয়াবহ ফলের কথা জানলেও সম্ভ্রমহানি তার চেয়েও ভয়াবহ মনে করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। অভিভাবকেরা সন্তানদের বিষয়ে ভুল ধারণা নিয়ে সমাজে বেঁচে আছেন। তাদের এই ভুল ধারণার মূল্য দিতে হচ্ছে অসহায় মেয়েদের। প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজের মেয়েরা কি এভাবে বলি হয়েই চলবেন? আর আমরা একটু আহা-উহুর মধ্য দিয়েই আমাদের যাবতীয় দায়িত্ব শেষ করব? সম্মিলিতভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ার কাজটিতে আর কতকাল অবহেলা দেখানো হবে?
শীপা হাফিজা: ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ও জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির পরিচালক; চিররঞ্জন সরকার: উন্নয়নকর্মী

No comments

Powered by Blogger.