বিষয় ফলোঅন

৩০৩ রানের লিড নিয়েও ইংল্যান্ডকে আবার ব্যাটিং করতে দেখে এটাই কি প্রথম মনে হয়েছে আপনার? হতেই পারে। রানের ব্যবধানে যত বড় পরাজয়ই হোক না কেন, ইনিংস পরাজয়ের লজ্জাটা বোধ হয় আরও বেশি।
এই ‘লজ্জা’ শব্দটা ফলোঅনের সঙ্গেও খুব ব্যবহূত হয়। তা ফলোঅনের সঙ্গে একটু অপমান তো মিশে থাকেই। কোনো দলকে যখন ফলোঅন করতে বলা হয়, তাতে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে এই বিদ্রূপটাও—আমরা একবার ব্যাটিং করে যা করেছি, দেখি তোরা দুবারে তা করতে পারিস কি না!
তা অ্যালিস্টার কুক এত উদার হলেন কেন? উদারতা-টুদারতা কিছু নয়, আধুনিক ক্রিকেটে এখন এটাই রীতি। একসময় যেমন ফলোঅন করানোটাই ছিল নিয়ম, গত কিছুদিন তেমনি না-করানোটা। নয় বছর আগের কলকাতা টেস্টের প্রভাব?
২০০১ সালে ইডেন গার্ডেনে ৩৮৩ রানের লিড নিয়েও ভারতকে ফলোঅন করানোর পর হারতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। সেই টেস্ট ম্যাচটি চর্মচক্ষে দেখার সুযোগটাকে সাংবাদিকতা জীবনের মহাসৌভাগ্য বলে মানি। টেস্টের তৃতীয় দিন কলকাতার প্রায় সব পত্রিকাই সে দিনই ওই টেস্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল। স্বীকার করে নেওয়া উচিত, আমার ম্যাচ রিপোর্টেও ছিল সেই ইঙ্গিতই। এটা অনুমান করা কার সাধ্য ছিল যে, ভেঙ্কট লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড় ফলোঅন ইনিংসে পুরো চতুর্থ দিন অবিচ্ছিন্ন থেকে ৩৭৬ রানের জুটি গড়বেন! প্রথম ইনিংসে ১৭১ রানে অলআউট ভারত ইনিংস ছাড়বে ৭ উইকেটে ৬৫৭ রান তুলে!
তার পরও তো ওই টেস্ট ড্রই হয়! পঞ্চম দিন লাঞ্চের একটু আগে ভারতের ইনিংস ঘোষণা, চা-বিরতির সময়ও অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে ১৬১। অথচ শেষ সেশনে ৩১ বল ও ৮ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে ধসে পড়ল স্টিভ ওয়াহর দল। প্রথম ইনিংসে হ্যাটট্রিকসহ ৭ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৬—অথচ হরভজনের কীর্তি চাপা পড়ে গেছে লক্ষ্মণের মহাকাব্যিক ২৮১ রানের নিচে।
এটাও মনে আছে, পঞ্চম দিন সকালেও ভারতকে ব্যাটিং করতে দেখে মহাবিরক্ত হয়েছিলাম। ম্যাচটাকে এমন নষ্ট করার কোনো যুক্তি আছে নাকি! পরে যুক্তিটা জেনেছি জন রাইটের ইন্ডিয়ান সামার বইটা পড়ে। টেস্টের চতুর্থ দিন রাতে কোচ রাইট ও অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, এমন একটা অবস্থায় গিয়ে ডিক্লেয়ার করতে হবে, যখন অস্ট্রেলিয়ার বিন্দুমাত্র জয়ের সম্ভাবনাও থাকবে না। শুধুই ম্যাচ বাঁচানোর জন্য ব্যাটিং করাটা অস্ট্রেলিয়ার চূড়ান্ত অপছন্দ। ওদের এই বিরক্তিটা হবে ভারতের আসল ‘বোলার’!
ফলোঅন করাব কি করাব না সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অধিনায়কদের এখন মনে পড়ে যায় ওই কলকাতা টেস্টের স্মৃতি। তবে অ্যালিস্টার কুকের সিদ্ধান্তে অবশ্যই এর ভূমিকা নেই। ফলোঅন করালে বাংলাদেশের কেউ ভেঙ্কট লক্ষ্মণ হয়ে যেতে পারেন, এই ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। কুক ফলোঅন করাননি এই গরমে বোলারদের একটু স্বস্তি দিতে। ইদানীং ফলোঅন না করানোর যে প্রবণতা, তাতে এটিই থাকে সবচেয়ে বড় কারণ। এর সঙ্গে আরেকটি বিবেচনা, চতুর্থ ইনিংসে বোলিং করার সুযোগ।
আরও কিছু কারণও যোগ হয়েছে এর সঙ্গে। আশির দশকের শুরুতেও টেস্টে ‘রেস্ট ডে’ ছিল। বোলারদের বিশ্রাম-টিশ্রাম নিয়ে তাই ভাবতে হতো না। আরেকটা কারণ, এখন টেস্টে অনেক দ্রুত রান ওঠে। দ্বিতীয়বার ব্যাটিং করেও তাই প্রতিপক্ষকে অলআউট করার জন্য যথেষ্ট সময় মেলে।
১৯০০ সাল পর্যন্ত ফলোঅনটা অধিনায়কদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করত না। এটি ছিল বাধ্যতামূলক। ব্যাপারটা অধিনায়কের ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ার পরও অনেক দিন সে রকমই ছিল। প্রথমে ব্যাটিং করা দল ২০০ বা এর বেশি রানে এগিয়ে থাকলে প্রতিপক্ষ দলের দুই ওপেনার প্যাড-ট্যাড পরে ফেলতেন। ফলোঅন করাতে অনীহাটা সেভাবে প্রথম দেখাতে শুরু করেন মার্ক টেলর। একটা বড় কারণ তো অবশ্যই তাঁর দলে শেন ওয়ার্ন নামে জনৈক লেগ স্পিনারের উপস্থিতি। ওয়ার্নকে চতুর্থ ইনিংসে লেলিয়ে দেওয়ার সুযোগ কোন অধিনায়ক না কাজে লাগাতে চাইবেন!
কলকাতা টেস্টেও শেন ওয়ার্ন ছিলেন। তার পরও পাঁচ বছরেরও বেশি সময় পর প্রতিপক্ষকে ফলোঅন করাতে একটু ভাবেননি স্টিভ ওয়াহ। একে তো ৩৮৩ রানের লিড, তার ওপর এর আগে টানা ১৬ টেস্ট জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। অথচ হকচকিত স্টিভ ওয়াহ দেখলেন, জ্যাক ব্ল্যাকহাম ও কিম হিউজের সঙ্গে লেখা হয়ে গেছে তাঁর নাম। ফলোঅন করিয়েও টেস্ট হারার ‘কীর্তি’ শুধু এই তিন অধিনায়কেরই। কী আশ্চর্য, তিনজনই অস্ট্রেলিয়ান!
ব্ল্যাকহামেরটা টেস্ট ক্রিকেটের আদি যুগের ঘটনা। ১৮৯৪-৯৫ অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার সেই পরাজয়ের মূলে অনাবৃত উইকেটের যুগে বৃষ্টিভেজা সিডনির উইকেটে দুই ইংলিশ বাঁহাতি স্পিনারের আনপ্লেয়েবল হয়ে ওঠা। দ্বিতীয় ঘটনাও অ্যাশেজেই। ১৯৮১-এর সেই হেডিংলি টেস্টকে ক্রিকেট ইতিহাস জানে ‘বোথামের টেস্ট’ বলে। ফলোঅন ইনিংসে পঞ্চম উইকেট পড়ার পর যখন ব্যাটিং করতে নামেন, ইংল্যান্ড তখনো ১২৬ রানে পিছিয়ে। বোথামের অপরাজিত ১৪৯-এ ১২৯ রানের লিড। তার পরও তো অস্ট্রেলিয়ারই জেতার কথা। ৪৩ রানে ৮ উইকেট নিয়ে উল্টো ইংল্যান্ডকে জিতিয়ে দিলেন বব উইলিস।
বোথাম-উইলিস তো মনে রাখবেনই। রডনি মার্শ ও ডেনিস লিলিও ওই টেস্টটিকে কোনো দিন ভুলতে পারবেন না। অস্ট্রেলিয়া দলের এই দুজনকে আলাদা করা কেন? কারণ ইংল্যান্ডের জয়ের পক্ষে ৫০০-১ বাজির দর জেনে এঁরা দুজন লোভ সামলাতে পারেননি। ব্যাপারটা এমনই অসম্ভব ছিল যে মজা করে ধরা সেই বাজির কথা সবাইকে বলেও বেড়িয়েছেন।
ফলাফল—বাজিতে যা জিতেছিলেন, জরিমানা দিতে হলো তার চেয়ে বেশি!

No comments

Powered by Blogger.