অবৈধ অস্ত্র গেল কোথায়? by শরিফ রুবেল

৪ঠা আগস্ট রোববার। দুপুর ১টা ৩০ মিনিট। ফেনীর মহিপালে জনসমুদ্র। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেন। মাত্র ৫ মিনিটে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখলে নেয় শিক্ষার্থীরা। অল্প সময়ে অবস্থা বেগতিক হয়ে যায়। অস্ত্রহাতে মাঠে নেমে পড়েন নিজাম হাজারী। সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের শত নেতাকর্মী। সবাই সশস্ত্র। প্রত্যেকের হাতে দেশি-বিদেশি নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। প্রথমেই সশস্ত্র ছাত্রলীগ যুবলীগ নেতারা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করেন। আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছোড়েন। গুলির শব্দে আশপাশ প্রকম্পিত হয়। গুলিতে শত শত আন্দোলনকারী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঘণ্টা ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। ঘটনাস্থলেই ১০ জন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ শত মানুষের সারি। এক নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হয় ফেনীবাসী। এমন দিন তারা আগে কখনো দেখেনি। সেদিনের ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে মানবজমিনের হাতে। ভিডিওতে দেখা গেছে ১০০ থেকে ১৫০ জন ব্যক্তির সবার হাতে প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়ে তারা দৌড়ে সামনে আগাচ্ছে আর ছাত্রদের উপর গুলি ছুড়ছে। এদের অনেকে মাথায় হেলমেট পরিহিত ছিল। তবে প্রকাশ্যে গুলি চালানো কয়েকজনকে চেনা গেছে। তারা হলেন ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি জিয়া উদ্দিন বাবলু, কাজীরবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান খোকন হাজারী। শুধু ফেনীতেই নয় ৪ঠা আগস্ট আওয়ামী লীগের ডাকা ‘এক দফা কবর দে’ কর্মসূচিতে দেশ জুড়ে অবৈধ অস্ত্রের পাহাড় দেখা গেছে। গত ১৬ই জুলাই থেকে ৫আ আগস্ট পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখেছে দেশের মানুষ। শহর, জেলা, উপজেলা, পাড়া, মহল্লায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে পুলিশের সঙ্গে দেশি-বিদেশি মরণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়। এই অস্ত্র দিয়েই তারা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ৫ই আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তখন থেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। তবে ৩৬ দিন ধরে ছাত্র-জনতার ওপর তাদের ব্যবহার করা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো হদিস মিলছে না। কোথায় গেল এসব অবৈধ অস্ত্র এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে বিপুলসংখ্যক এই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা না গেলে জনজীবন ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ।

প্রকাশ্যে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেন যারা:
গত ১৯শে জুলাই চট্টগ্রামে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে অস্ত্রধারী মহানগর যুবলীগ নেতা ‘ডাকাত ফিরোজ’ ছাত্র-জনতার ওপর বারবার গুলি ছোড়েন। এতে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হোন। অস্ত্রহাতে আরও শতাধিক নেতাকর্মীকে মাঠে দেখা যায়। এ ছাড়া গত ৪ঠা আগস্ট সাভার বাসস্ট্যান্ড ও রেডিও কলোনি এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর মেশিনগান দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, আতিক তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগার টানছেন আর সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। ১৯শে জুলাই সাভার থানা স্ট্যান্ডে সংঘর্ষেও তার হাতে পিস্তল দেখা যায়। সেদিনও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান এই আতিক। ৪ঠা আগস্টের আরেকটি ভিডিওতে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাজু আহমেদকে বিদেশি অস্ত্র দিয়ে গুলি চালাতে দেখা যায়। এদিন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালান উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মেহেদি হাসান তুষার, সাইদুর রহমান সুজন, দেওয়ান মাসুম, সাভার উপজেলা চেয়ারম্যানের শ্যালক মাজহারুল ইসলাম রুবেল। এ ছাড়া ১৯শে জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি গেট এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়েন নারায়ণগঞ্জ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তার ছেলে আয়ান ওসমান। এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায় প্রায় ঘণ্টা ধরে তারা ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে থাকেন। এ সময় তাদের সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২ জন সশস্ত্র যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন। প্রত্যেকের হাতে দেশি-বিদেশি প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। গত ৪ঠা আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়েন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হোসেন খান নিখিল ও মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি। ওই সময়
ঢাকা উত্তরের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। তারা বার বার ছাত্রদের ধাওয়া করে গুলি ছোড়েন। এতে শত শত শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। এদিন মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিতে ৫ শিক্ষার্থী মারা যান। ৪ঠা আগস্ট ঢাকার মোহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার কালভার্ট ফুট ওভারব্রিজের নিচে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। মোহাম্মপুর ৩৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ, সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের পিএস মাসুদুর রহমান বিপ্লবের হাতে শটগান, একে-৪৭ ও চাইনিজ রাইফেল দেখা যায়। সেদিন তাদের সঙ্গে থাকা শতাধিক নেতাকর্মীর সবার হাতেই বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। ৪ ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে গুলিতে এক শিশুসহ ৩ জন নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয় অন্তত ১৪৭ জন। তাদের সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। ৪ঠা আগস্ট বিকালে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি। তখন তার সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২ জনকে ছাত্রদের ধাওয়া করে গুলি চালাতে দেখা গেছে। ২রা আগস্ট উত্তরা ১১নং সেক্টরে শিক্ষার্থীদের মিছিলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় শটগান হাতে গুলি ছুড়তে দেখা যায় তুরাগ থানা যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসানকে। ওই সময় যুবলীগ নেতাদের প্রত্যেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। সেদিন গুলিতে ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়। ৪ঠা আগস্ট মানিকগঞ্জ সদরের খালপাড়ে ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় এসএমজি হাতে কার্লেস শুভ, শটগান হাতে সানি আহমেদ, পিস্তল হাতে যুবলীগ নেতা বাশারকে দেখা যায়। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আরও ছিলেন অভিজিৎ সরকার, রুবেল হোসেন ও রেয়াদ খান। তারা দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে গুলি চালান। গুলিতে ১ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গুলিবিদ্ধ হয় আরও শতাধিক। ৪ঠা আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা শত শত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে নামে। এদিন স্থানীয় এমপি সাইফুল ইসলামকে নিজের ব্যবহৃত অস্ত্র দিয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ইয়ারপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুমন ভূঁইয়া দুই হাতে দু’টি পিস্তল নিয়ে দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। সেদিন অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি চালান যুবলীগ নেতা রুবেল আহমেদ, ছাত্রলীগ নেতা নাদিম হোসেন, জুয়েল ও আরও অনেকে। গত ৩রা আগস্ট কুমিল্লা সদরের কান্দিরপাড়, টমছম ব্রিজে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় টমছম ব্রিজ এলাকায় জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আব্দুল আজিজ সিহানুক শটগান হাতে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছাত্রদের ধাওয়া করেন। ওই ৬০ জনের বেশি নেতাকর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। তারা শিক্ষার্থীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। এতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ লাইন মোড় ও আলেখাচর এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে দেখা গেছে মহানগর যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সহিদ, আমিনুল ইসলাম টুটুল, জহিরুল ইসলাম রিন্টু, আহমেদ নেওয়াজ পাভেল, হাবিব আল আমিন সাদি, সরকার মাহমুদ জাবেদ। এরা সবাই স্থানীয় এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারী।

জানতে চাওয়া হলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে এটা উদ্বেগজনক। পুলিশের প্রথমেই এই অস্ত্র হেফাজতে নিতে হবে। না হলে বড় বিপদ হতে পারে। এসব অস্ত্র বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসীদের কাছে চলে গেলে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। অস্ত্র উদ্ধারে জোরদার অভিযান চালানো উচিত। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার চেয়ে অস্ত্র অস্ত্র খেলার চর্চা বেশি হয়। সারা দেশে হাজার হাজার মানুষের হাতে অস্ত্র দেখা গেছে। এসব অস্ত্র কোথা থেকে এলো। রাজনীতির কারণে জনগণের ওপর অস্ত্র ব্যবহার করা সমীচীন নয়।

No comments

Powered by Blogger.