দখলমুক্ত হয়নি আনন্দমোহন বসু’র বাড়ি

ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উপমহাদেশের প্রথম ‘র‌্যাংলার’ আনন্দমোহন বসুর জন্মভিটার এখন বেহালদশা। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এই সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা আর ভূমি বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় লিজের নামে বাড়িটি দখলে রেখেছেন এক প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিবার। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে আনন্দমোহন বসুর এই জন্মভিটাটি সংরক্ষণের জন্য এলাকাবাসী ও সুধীজনদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনায় এটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গত ২রা জানুয়ারি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরদিন ৩রা জানুয়ারি মন্ত্রণালয় থেকে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসককে আনন্দমোহন বসুর বাড়ি থেকে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি ইটনা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা ও সরজমিন তদন্ত করে উচ্ছেদের বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন প্রেরণের কথা বলা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি বাড়িটি অবৈধ দখলমুক্ত হয়নি।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতার নির্দেশে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সোমবার দুপুরে বাড়িটিতে গিয়ে সেখানে সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদের সাইনবোর্ড ও নোটিশ ঝুলিয়েছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী কাস্টোডিয়ান সাইফুল ইসলাম এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এসময় স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার রায় এবং স্থানীয়রা উপস্থিত ছিলেন।

সরজমিন দেখা গেছে, আনন্দমোহন বসুর অরক্ষিত জন্মভিটায় অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে বসতবাড়িটি। ৩.১১ একর আয়তনের বাড়িটিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়িটি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। আনন্দমোহন বসুর আতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এ অবস্থায় ঐতিহ্যের নিদর্শন এসব স্থাপনা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্মস্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শণার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। অথচ সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন এ বাড়িটি। বলাকুট নদীর তীরে অবস্থিত বাড়িটির ভবনগুলো আয়তাকার ভূমি নকশায় নির্মিত, যাতে ইটের গাঁথুনিতে চুন-সুরকির ব্যবহার করা হয়েছে। মূল ভবনটি ইংরেজি বর্ণ ‘ইউ’ আকৃতির একতলা বিশিষ্ট স্থাপনা। কক্ষগুলোর সম্মুখ বারান্দার ছাদ হিসেবে ঢেউটিন ব্যবহার করা হয়েছে। প্রত্যেকটি বারান্দার সামনে একটি করে সিঁড়ি রয়েছে। উত্তর পাশের সিঁড়িতে হাতির মাথা সদৃশ নকশা করা। তিনটি কক্ষের প্রবেশ দরজায় ফুল, লতাপাতা, প্রাণি ও জ্যামিতিক নকশা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি কক্ষে ভোল্টেড ছাদ এবং ফুল ও লতাপাতার নকশা এবং একটি কক্ষের ছাদে লোহার ভিম ও কাঠের কড়িবর্গা রয়েছে। এ বাড়িতেই ১৮৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন ভারতীয় উপমহাদেশে অটোক্রোম লুমিয়ের স্লাইড ব্যবহার করে রঙিন ছবির পথিকৃৎ আলোকচিত্রী হেমেন্দ্রমোহন বসু। দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে বাড়িটি বন্দোবস্ত মোকদ্দমামূলে স্থানীয় প্রভাবশালী হাজী আমির উদ্দিনের পরিবারের দখলে রয়েছে। বাড়িটি দখল করার সময় বাড়িটির বিপুল পরিমাণ মূল্যবান জিনিসপত্র তখন তারা নিজেদের অধিকারে নিয়ে যান। বর্তমানে তার ছেলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল হাই বাড়িটি দখলে রেখেছেন।

No comments

Powered by Blogger.