ধর্মীয় মেলবন্ধনের অনন্য দৃষ্টান্ত by চৌধূরী মনজুর রুমি

একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন। সিঁড়িতে বা লিফটে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের দেখা হচ্ছে অহরহ। একজন আরেকজনকে অভিবাদন জানাচ্ছেন হাসিমুখে। শান্তির ধরণী গড়ার লক্ষ্যে এবং সন্তানদের সুন্দর একটি ভবিষ্যৎ উপহার দেয়ার বাসনায় চমৎকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মহড়া চলছে একই ছাদের নিচে। এ দৃষ্টান্তই একদিন সারা পৃথিবীতে ছড়াবে আলোকচ্ছটা। যেখানে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি এবং এক আদর্শে বিশ্বাসী অন্য আদর্শে বিশ্বাসীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজ বিশ্বাস ও আদর্শ প্রচার করবেন, অশান্তির পথে নয় কখনোই। সবাই একে অপরকে শুধু বলবেন, ‘আপনার ওপর শান্তি আসুক।’
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের পেট্রিপালটজে নির্মিত হচ্ছে ‘হাউস অব ওয়ান’- এক ছাদের নিচে তিন ধর্মের উপাসনালয়। বিশ্বব্যাপী যখন ধর্মীয় দ্বন্দ্ব-বিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে- তখন মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মধ্যে একতা আনার উদ্দেশ্যে এমন একটি প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, যা একসময় সব ধর্মের মাঝে সৃষ্টি করবে সহমর্মিতা। যে স্থানে এটি নির্মিত হচ্ছে, সেখানে সম্প্রতি প্রতীকী ইট হাতে দেখা গেছে মুসলিম ইমাম কাদির সানচি, খ্রিস্টান ধর্মযাজক গ্রেগর হোবার্গ এবং ইহুদি রাব্বি (ধর্মযাজক) তোভিয়া বেন-চোরিনকে। এটি নতুন এক উদ্যোগের অংশ, যার উদ্দেশ্য ধর্মীয় যোগসূত্র স্থাপন। এমন আরেকটি উদ্যোগের বাস্তবায়ন এগিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমাতে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ট্রাই ফেইথ ইনিশিয়েটিভ’। সেখানে সম্প্রতি নির্মিত একটি সিনাগগের (ইহুদিদের উপাসনালয়) পাশাপাশি একটি চার্চ এবং একটি মসজিদ নির্মাণের প্রচেষ্টা চলছে।
বার্লিনের উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে মূলত দুটি কারণে- ভবিষ্যতে আন্তঃসাংস্কৃতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং এ শহরের মানুষের ধর্মের প্রতি অনীহার অবসান ঘটানো। এ শহরের বেশিরভাগ বাসিন্দা আজকাল কোনো ধর্মেরই অনুসারী নয়। এ প্রেক্ষাপটে মুসলিম ইমাম চাইছেন ‘ইন্টারকালচারাল ডায়ালগে’র মাধ্যমে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে। খ্রিস্টান রেভারেন্ড পূর্ব জার্মানির দমনপীড়ন প্রত্যক্ষ করেছেন, দেখেছেন বার্লিনের পতনের পর ঐক্যের ক্ষমতা। এমনি এমনি তো আর বলা হয় না ‘ইউনিটি ইজ স্ট্রেংথ’। তিনিও চান পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের মহিমা ফিরিয়ে আনতে। আর ইহুদি রাব্বি, যিনি যে কারণেই হোক ইসরাইলের হয়ে তিনটি যুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিলেন, তিনি এখন ফিলিস্তিনের প্রতি অন্যায়ের ক্ষত নিরাময়ে আÍনিয়োগ করছেন। তার এ দৃষ্টান্ত হয়তো বিশ্বে ইসরাইলের ঔদ্ধত্য কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে ভূমিকা রাখবে।
এক ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি অন্য ধর্মবিশ্বাসীর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ধারণাটি যে একেবারেই অভিনব তা নয়। উনিশ শতকের মহান মানবতাবাদী সাধক স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা উদ্ধৃত করা যায়। ১৯০০ সালের ২৫ মার্চ আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোর বে অঞ্চলে তিনি তার বিখ্যাত ‘মুহাম্মদ’ ভাষণে ইসলামের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে চিহ্নিত করেছিলেন ‘সাম্যবাদের আচার্য’ হিসেবে। প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লেভ তলস্তয় তার শেষ জীবনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর পর তার পকেটে পাওয়া গিয়েছিল স্যার আবদুল্লাহ্ সোহরাওয়ার্দীর বাছাইকৃত হাদিসের সংকলন। ১৯৩৮ সালের ২৪ মার্চ এর দ্বিতীয় সংকলনের মুখবন্ধে মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন, ‘মোহাম্মদের (সা.) বাণী মানব জাতির সম্পদ।’ বিখ্যাত জার্মান কবি গ্যাটে ইসলাম সম্পর্কে গভীর লেখাপড়া করে বলেছিলেন, ‘এই যদি হয় ইসলাম, তাহলে আমাদের প্রত্যেক চিন্তাশীল ব্যক্তিই হচ্ছে মুসলমান।’
আসলে সব ধর্মেরই মূলকথা হল নম্রতা। ধর্মগুলোর মধ্যে দৃশ্যত পার্থক্য থাকলেও মানুষকে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ রাখতে ধর্মানুভূতির প্রায়োগিক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ মানুষে মানুষে বন্ধন সৃষ্টির যেসব
উপাদান রয়েছে, সেগুলোর মূলে রয়েছে ধর্ম-সংস্কৃতি।
কিন্তু আজ ধর্মকে শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত করতে পৃথিবীব্যাপী নানা ধরনের অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই ধর্মকে ঘিরে এক শান্তিপূর্ণ আদান-প্রদান ও সহমর্মিতা আজকের পৃথিবীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে সব ধর্মের মানুষই রাখতে পারে অবদান।
এবার শান্তিতে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই, যিনি নারী শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন এবং ভারতের কৈলাস সত্যার্থী, যিনি কাজ করেন শিশু অধিকার নিয়ে। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে নিজের সন্তানদের গড়তে একজন মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই শিক্ষিত ও সচেতন মা-ই পারে তার সন্তানকে শান্তির পতাকাবাহী হিসেবে গড়ে তুলতে। আমরা তো স্বপ্ন দেখতেই পারি, একজন মুসলমান ও একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর এই শান্তি পুরস্কার অর্জন পৃথিবীতে সহমর্মিতার সংস্কৃতিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সর্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ আমরা দেখতে পেয়েছি বিভিন্ন ধর্মের মেলবন্ধনের প্রয়াস থেকে, যা এ লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য ধর্মাবলম্বীর প্রতি সহমর্মিতার অনন্য দৃষ্টান্তটি রেখে গেছেন ইসলামের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)। আমরা সবাই সে ঘটনাটি জানি। এক বিধর্মী বৃদ্ধা প্রতিদিন তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। নবীজি নীরবে সেই পথ দিয়ে হেঁটে চলে যেতেন। একদিন তিনি দেখলেন পথের মাঝে কাঁটা নেই। নবীজির মন অজানা আশংকায় ভরে গেল। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই বৃদ্ধার কিছু হয়েছে। প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ওই বৃদ্ধা অসুস্থ। নবীজি বৃদ্ধাকে দেখতে তার বাসায় গেলেন। বৃদ্ধা ভাবলেন, এবার বুঝি নবীজি প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু নবীজি বললেন, তিনি অসুস্থ জেনে তাকে দেখতে এসেছেন, তার শুশ্রূষা করতে এসেছেন। বিধর্মীর প্রতি ভালোবাসার এমন উদাহরণ থাকার পরও আজও কিছু মানুষ ধর্মের নামে পৃথিবীতে সহিংসতা ছড়ায়। তাই আজ এ ধরনের উদাহরণ ছড়িয়ে দিতে হবে সারা বিশ্বে।
এ লেখা শেষ করব উইলিয়াম ল-এর ‘The Spirit of Prayer’ অভিসন্দর্ভের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘ধর্মগুলোর মধ্যকার পার্থক্য শুধু বাহ্যিক। মানুষের পাপমুক্তির পথ একটিই আর তা হচ্ছে মানুষের আত্মায় ঈশ্বরের অধিষ্ঠান নিশ্চিত করা। ধর্মবিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের পথ কি ভিন্ন? এটা হতে পারে না। ঈশ্বর এক, মানব প্রকৃতি এক, পাপ মুক্তির পথও এক। পাপ মুক্তিতে আত্মাকে ঈশ্বর পানে ধাবিত করাই হচ্ছে পথ।’
ধর্ম ও অন্যান্য আদর্শের দ্বন্দ্বের অবসানে সত্যিকার শান্তির পথটি খুঁজে বের করাই হচ্ছে আজকের প্রধান কাজ। মানুষ এ পথেই অগ্রসর হবে, এ প্রত্যাশা করি।
চৌধূরী মনজুর রুমি : ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.