কেমন আছেন আইভি by মতিউর রহমান চৌধুরী

কেমন আছেন আপা। ভাল আছি, ভাল নেই। নিজের কথা যদি বলেন, আল্লাহ অনেক ভাল রেখেছে। আর যদি জনগণের কথা জানতে চান, তাহলে বলবো ভাল নেই।
জনপ্রত্যাশা অনেক। জানবাজি রেখে আমাকে জনগণ ভোট দিয়েছিল। ভয়ভীতি কিংবা মৃত্যুকেও তারা পরোয়া করেনি। তাদের মুখে হাসি ফোটানোই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। চেষ্টা করছি দিনরাত। যেটুকু পারছি সেটুকু ভাগ করে নিচ্ছি তাদের মধ্যে। তবে অন্তহীন সমস্যার মধ্যে রাতারাতি সব কিছু বদলে দেয়া যে সম্ভব নয় তা বোধ করি সবাই জানেন। কথাগুলো একনাগাড়ে বলছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভি। শনিবার এক ফ্লাইটে ব্যাংকক থেকে ঢাকা আসছিলাম। লাউঞ্জে কথা হলো প্রায় এক ঘণ্টা। সৌভাগ্যক্রমে ব্যাংকক এয়ারওয়েজের ঢাকাগামী ফ্লাইটে পাশাপাশি আসনেই বসেছিলাম। সেখানে কথা হলো দুই ঘণ্টারও বেশি সময়। তিনি আসছিলেন জাপান থেকে। জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা’র আমন্ত্রণে কোবে শহরে গিয়েছিলেন। স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম শহীদ খানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল সপ্তাহব্যাপী সফরে গিয়েছিল। সবাই জানেন কি এক বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি জনরায় পেয়েছিলেন। নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তিনি নির্বাচিত হন, সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। বললেন, জনগণ আমার শক্তি, সাহস। তারা আমাকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছে অনেক আশা নিয়ে। তাদের কথা দিয়েছিলাম আমি আলী আহমদ চুনকার মেয়ে। বাবা কোনদিন কোন অপশক্তির কাছে মাথা নুইয়ে কথা বলেননি। আপস করেননি কোন লোভ-লালসার কাছে। আমিও করবো না। আল্লাহতায়ালা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। লেখাপড়া করেছি বিদেশে। ইচ্ছা করলে বিদেশেই থেকে যেতে পারতাম। সুযোগ ছিল, এখনও আছে। কিন্তু জনসেবা করতে চেয়েছি বলেই নারায়ণগঞ্জের মাটিতে ফিরে আসা। বাবা বলতেন- মা রে, আদর্শচ্যুত হবে না কখনও। সত্যের সঙ্গে আপস করবি না। দেখবি জীবনে সাফল্য আসবে। আজ তিনি গর্বিত। বাবাকে কথায় কথায় স্মরণ করেন। বলেন, বাবার আদর্শ ধারণ করে নারায়ণগঞ্জকে এগিয়ে নিতে চাই। বাধা-বিপত্তি আসছে। আসুক, তাতে ভয় পাই না। কারণ আমি সঠিক পথে আছি। জনগণের সঙ্গে বেইমানি করিনি। করবো না। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে না এটা জেনে অনেকেই হতাশ হয়েছিলেন। বলেছিলেন, জনরায় ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা হবে। চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। যাহোক, সেদিন সমর্থকদের বলেছিলাম জনগণই আমার আর্মি। জনগণ এতে আরও শক্তিশালী হয়েছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও পরে বলেছেন, এটা ছিল এক অভিজ্ঞ রাজনীতিকের সাহসী উচ্চারণ। বিমানে খেতে চাইলেন না। একটা আইসক্রিম খেলেন শুধু। মুটিয়ে গেছি দেখেন না। এরপরও আইসক্রিম! দুপুরে তেমন একটা খান না। অতিথি কেউ গেলে সাধারণত খান। মায়ের হাতের রান্না ভীষণ পছন্দ। কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতে ভালবাসেন। সময় পেলে আড্ডা। স্বামী-বাচ্চাদের অনেক মিস করেন। সময় নেই তাই যাওয়া হয় না সুদূর নিউজিল্যান্ডে। এবার এক মাসের ছুটি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেড় বছর হয়ে গেল সাফল্য কেমন? ধীরগতি। কারণ, এদেশে ফাইল নড়ে তো নড়ে না। তবে আমি সৌভাগ্যবান। নানা স্যাবোটাজের মধ্যেও বেশ কিছু প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। জাইকা ৪শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। সন্ত্রাস দমন নিয়ে হতাশার কথাই বললেন আইভি। ত্বকী হত্যা তাকে কাঁদায়, বিচলিত করে। বললেন, এই সুন্দর ফুটফুটে মেধাবী ছেলেটিকে কি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলো সন্ত্রাসীরা। কারা এর পেছনে সবাই জানেন। কোন অ্যাকশন নেই। প্রশাসন নীরব। পুলিশকে নড়ানো যাচ্ছে না। ঘরোয়া আলোচনায় তারা বলে, কি করবো আপা। আমাদের যে হাত-পা বাঁধা। কারা বাঁধলো জবাব নেই। জবাব আছে, নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে। তারা জবাব দিয়েই চলেছে। একদিন না একদিন ত্বকীর হত্যাকারীরা ধরা পড়বেই। শাস্তি তাদের পেতেই হবে। ত্বকীর বাবার কাছে কি জবাব দেবো বলুন? নারায়ণগঞ্জ এক বিশাল সিটিতে পরিণত হয়েছে এখন। অবকাঠামোগত সাপোর্ট ছাড়াই। নানা কিসিমের মানুষের বসবাস এই শহরে। মানুষ পরিবর্তন চায়। আমিও তাদের দলে। কিন্তু সবাই জানেন, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঢাকার অতি কাছে অথচ মনে হয় অনেক দূরে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মনে হয় যেন দূরত্ব বেড়েই চলেছে। যাত্রাবাড়ি ক্রস করতে গিয়েই দিনের অর্ধেক শেষ। মাঝখানে ট্রেন চালু হলো। সবাই নড়েচড়ে বসলো। ওমা ক’দিনের মধ্যেই বন্ধ। ট্রেনে নাকি যান্ত্রিক গোলমাল। এমন ট্রেন কেন আনা হলো? কে বলবে, কার কাছে জবাব চাইবো। যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার চালু হলে হয়তো জনদুর্ভোগ কিছুটা কমবে। আড্ডা যখন চলছিল তখন পাশের সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন বাংলাদেশের এক জনযোদ্ধা। যিনি জনগণের ভাগ্য বদলাতে আর নারীকে ক্ষমতায়ন করতে যুগের পর যুগ পরিশ্রম করে চলেছেন। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। বৃটিশ স্যার উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদের কথা বলছি। দু’জনই উঠে গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি সোফা থেকে উঠে আইভিকে বললেন, আরে তুমি কেমন আছো? মনে হলো অনেক কালের চেনা। সত্য কথা কি, সেটাই ছিল প্রথম দেখা। আবেদ ভাই বললেন, তোমার পরিচয় তুমি নিজেই। তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। বলি, একটি মেয়ে কিভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আবেগাপ্লুত আইভি বললেন, এত বড় মানুষ আমাকে চেনেন। সবাই চেনে আপনাকে। জানেন ভাই, জাপানে থাকাকালে কয়েকটি বাংলাদেশী পরিবার আমাকে সত্তর মাইল-আশি মাইল ড্রাইভ করে দেখতে এসেছে। সবার এক কথা, আপা বাংলাদেশ আপনাকেই চায়। লজ্জাই পেলাম। এত প্রশংসা কি আমার প্রাপ্য। প্রশংসা মানুষকে সাহসী করে, বিপথেও নিয়ে যায়। আমার ভয়টা সেখানে। বললাম, ভয় নেই, আপা ছিলেন, আপা থাকবেন। তাহলেই দেখবেন সব ঠিক, বিলকুল ঠিক। শেষ কথা, গণতন্ত্রে যেমন ‘শতফুল বিকশিত হোক’ প্রবাদটি চালু আছে তেমনি একজন আইভি নয়, বাংলাদেশ চায় শত শত আইভি। যারা দেশ ও মানুষের সঙ্গে কখনও বেইমানি করবে না। বিমানটি ঢাকা অবতরণ করলো। মজার আড্ডার যবনিকাপাত। আবারও হয়তো দেখা হবে, কথা হবে।

No comments

Powered by Blogger.